দেবদাসের বিরহে আজও কাতর পার্বতীর হাতিপোতা
তাহার জন্য একটু প্রার্থনা করিও...।
‘দেবদাসে’র পাঠকদের কাছে এই ছিল শরৎচন্দ্রের অন্তিম অনুরোধ। বর্ধমানের হাতিপোতা গ্রামটি সে অনুরোধ রেখেছে। শুধু প্রার্থনা নয়, নান্দাই পঞ্চায়েতের অধীন গ্রামটি দেবদাসেই মজে রয়েছে।
দেবদাস এখানেই এসেছিল, পার্বতীকে শেষ বার দেখতে চেয়ে এই বটতলাতেই ধুঁকে ধুঁকে মরেছিল এ রকমই বিশ্বাস করে হাতিপোতা। গ্রামবাসীরা নিঃসন্দেহ, এই গ্রামের প্রাক্তন জমিদার ভুবনমোহন চৌধুরীর দ্বিতীয় স্ত্রী তালসোনাপুরের পার্বতীই ‘দেবদাস’ উপন্যাসের নায়িকা। শরৎচন্দ্র গ্রামে এসে এখানকার জমিদারবাড়ি স্বচক্ষে দেখেছিলেন। দেবদাসের কাহিনি নিছক কল্পনা নয়। হাতিপোতা গ্রাম থেকেই সেই কাহিনিসার শরৎবাবু সংগ্রহ করেছিলেন বলে গ্রামবাসীদের দাবি।
কালনার হাতিপোতা গ্রামে ক্লাবঘর।
শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’ উপন্যাসে হাতিপোতা গ্রামের নাম রয়েছে ‘‘পার্বতীর পিতা কাল বাটী ফিরিয়াছেন। এ কয় দিন তিনি পাত্র স্থির করিতে বাহিরে গিয়াছিলেন।...প্রায় কুড়ি-পঁচিশ ক্রোশ দূরে বর্ধমান জেলার হাতিপোতা গ্রামের জমিদারই পাত্র।” উপন্যাসের শেষ দিকে রয়েছে, “গাড়ি যখন পাণ্ডুয়া স্টেশনে আসিয়া উপস্থিত হইল তখন ভোর হইতেছে। সারারাত্রি বৃষ্টি হইয়াছিল, এখন থামিয়াছে। দেবদাস উঠিয়া দৌড়াইল। নীচে ধর্মদাস নিদ্রিত।”
কিন্তু বাস্তবের হাতিপোতাই যে দেবদাস-কাহিনির উৎস, তার প্রমাণ কী? উপন্যাসে বর্ণিত হাতিপোতা যে নান্দাই পঞ্চায়েতেরই হাতিপোতা, তারই বা সাক্ষ্য কোথায়? গ্রামবাসীরা কিন্তু নিশ্চিত, এ গ্রাম সে গ্রাম না হয়ে যায় না! এ পার্বতী সে পার্বতী না হয়ে পারে না!
নান্দাই পঞ্চায়েত প্রধান ঈদের আলি মোল্লা বলেন, কথাসাহিত্যিকের লেখায় রয়েছে, পাণ্ডুয়া স্টেশন থেকে ১৬ ক্রোশ দূরে হাতিপোতা গ্রাম। কিলোমিটার হিসাব করলে দাঁড়ায় প্রায় ৪০। “আমরা মোটরবাইকে চেপে দেখেছি এই হিসেব যথাযথ। এমনকী দেবদাসকে নিয়ে গাড়োয়ান যে পথে পাণ্ডুয়া থেকে গ্রামে পৌঁছেছিল, সে রাস্তারও অস্তিত্ব রয়েছে।” প্রাক্তন পঞ্চায়েত প্রধান আরজেদ শেখ গ্রামের আর এক প্রবীণ বাসিন্দা ইজেরধার মোল্লা-র কথা মনে করিয়ে দেন। মোল্লা ১১৫ বছরেরও বেশি বেঁচেছিলেন। বছর কুড়ি আগে মারা যান। “যত দিন জীবিত ছিলেন, শরৎবাবুর দেবদাস লেখার যাবতীয় বর্ণনা দিতেন।’’ গ্রামের আর এক বাসিন্দা ইউনুস মোল্লার দাবি, ‘‘পূর্বজদের কাছে জেনেছিলাম, জঙ্গলে ভরা যে কাছারিবাড়িটি গ্রামে ছিল, সেটি ভুবন চৌধুরীর। তাঁর সঙ্গে তালসোনাপুর গ্রামের পার্বতীর বিয়ে হয়েছিল।” বছর পঁচিশ আগেও নদীর পাড়ে সেই ভগ্ন কাছারিবাড়ির অস্তিত্ব ছিল। বর্তমানে গ্রামের মানুষ সেটিকে ঈদগাহ হিসাবে ব্যবহার করেন। অন্য প্রবীণেরা সায় দেন। তাঁরা সকলেই বাপ-ঠাকুরদার মুখে জমিদার ভুবন চৌধুরী আর তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী পার্বতীর কথা শুনেছেন। “এমনকী উপন্যাসে গাড়োয়ান যে বটতলায় অসুস্থ দেবদাসকে শুইয়ে রেখেছিল, ঠিক সেই ধরনের একটি বটগাছও গ্রামে বহু দিন জীবিত ছিল।”
গ্রামবাসীদের দাবি, এক আত্মীয়ের মুখে হাতিপোতা গ্রামের কথা জানতে পেরেছিলেন শরৎবাবু। নদীপথে তিনি এসেছিলেন গ্রামে। গ্রামবাসীরা তাঁকে ভুবনমোহন চৌধুরীর কাছারিবাড়িটি দেখিয়েছিলেন। কবেকার কথা এ সব? হাতিপোতার মানুষ মনে করেন, ১৮৯৫ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে শরৎচন্দ্র এখানে এসেছিলেন। আর, ‘পারো’কে শেষ বার দেখতে দেবদাস এসেছিলেন তারও প্রায় ৫০ বছর আগে।
সেই ক্লাবের দেওয়ালে টাঙানো আছে পুরনো সেই কাছারি বাড়ির ছবি।
শরৎচন্দ্রের জীবনপঞ্জির সঙ্গে এই কাহিনি মিলছে কি? হাতিপোতা গ্রামে আসা বা কোনও সত্য ঘটনার আদলে দেবদাস কাহিনি-নির্মাণের উল্লেখ শরৎ-জীবনীতে সে ভাবে নেই। ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্র বললেন, শরৎচন্দ্র অভিজ্ঞতামূলক কাহিনি লিখতেন। কোনও ঘটনার কথা শুনে থাকতেও পারেন। “তবে এমন কিছু আমার অন্তত জানা নেই।”
শরৎচন্দ্র নিজে মনে করতেন, দেবদাস তাঁর খুব উৎকৃষ্ট রচনাও নয়। কম বয়সের কাঁচা লেখা বলে তিনি উপন্যাসটি ছাপাতে অবধি চাননি। তিনি যখন রেঙ্গুনে, ভারতবর্ষ পত্রিকার অন্যতম কর্ণধার প্রমথনাথ ভট্টাচার্য লেখাটি সংগ্রহ করে ১৯১৬ সালের চৈত্র সংখ্যায় প্রথম কিস্তি প্রকাশ করেন। বই আকারে ‘দেবদাস’ ছাপা হয় ১৯১৭ সালে। দেবদাস-পার্বতী-চন্দ্রমুখীর ত্রিকোণ তার পর থেকে আজ পর্যন্ত ‘আইকন’ হয়ে বেঁচে রয়েছে রাধা-কৃষ্ণ, লয়লা-মজনু বা হীর-রঞ্ঝার কিংবদন্তির মতোই। কেন এত জনপ্রিয় দেবদাস? গৌতম ভদ্রের মতে, দেবদাস হল ভারতীয় মধ্যবিত্তের মজনু। রক্ষণশীলতার গণ্ডি টপকানোর ইচ্ছা এবং একই সঙ্গে রক্ষণশীলতাকে বাঁচিয়ে রাখা, আপস করার দোটানায় দীর্ণ সে। ব্যর্থ প্রেমিকের পিছুটানের শ্রেষ্ঠ প্রতীক। ১৯২৭ থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত বাংলা-সহ ভারতের বিভিন্ন ভাষায় এক ডজনেরও বেশি সিনেমা হয়েছে দেবদাস নিয়ে। বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানে একাধিক রিমেক হয়েছে তার।
হাতিপোতার কাছে ‘দেবদাস’ নিয়ে সিনেমার মাহাত্ম্যও আলাদা। সিনেমা এলেই দল বেঁধে দেখতে যায় হাতিপোতা। মনিরুল ইসলাম, আরজেদ শেখদের চোখে সেরা ‘দেবদাস’, শাহরুখ খান। বশির শেখের কথায়, ‘‘গ্রামের সব যুবকই ওর মতো প্রেমিক হবার স্বপ্ন দেখে।’’ তাই গ্রামের ক্লাব থেকে ফুটবল কোচিং ক্যাম্প, হোমিও চিকিৎসাকেন্দ্র থেকে অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবা সবেতেই জড়িয়ে থাকে দেবদাসের নাম। হাতিপোতা গ্রামের সব থেকে বড় উৎসব, দেবদাস স্মৃতি মেলা। ১২ বছর ধরে এই মেলা দেবদাসের বিরহ-স্মৃতি উদ্যাপন করে চলেছে। গোটা হাতিপোতাই যেন এখন রুখুসুখু দেবদাস। পার্বতী নয়, খোদ দেবদাসের বিরহে।
—নিজস্ব চিত্র



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.