‘সব বিচারপতি চোর, তা বলিনি’ মমতার মন্তব্য নিয়ে
দু’টি মামলা হাইকোর্টে
বিচার ব্যবস্থা ও আদালত সম্পর্কে বিভিন্ন সংবাদপত্র ও বৈদ্যুতিন চ্যানেলে প্রচারিত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মঙ্গলবারের বক্তব্যের ‘সত্যতা’ জানতে কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমকে হলফনামা দিতে বলল কলকাতা হাইকোর্ট। বৃহস্পতিবার বিচারপতি কল্যাণজ্যোতি সেনগুপ্ত ও বিচারপতি অসীম মণ্ডলের ডিভিশন বেঞ্চ তিন সপ্তাহের মধ্যে দু’টি ইংরেজি সংবাদপত্র ও দু’টি বাংলা চ্যানেলকে হলফনামা জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। চার সপ্তাহ পরে মামলাটির শুনানি হবে। বৃহস্পতিবার আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য হাইকোর্টের কাছে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার জন্য স্বতঃপ্রণোদিত ফৌজদারি মামলার আবেদন জানান। তারই ভিত্তিতে এই নির্দেশ।
একই বিষয়ে প্রধান বিচারপতি জে এন পটেল এবং বিচারপতি জয়মাল্য বাগচির ডিভিশন বেঞ্চে এ দিন একটি জনস্বার্থ মামলাও করা হয়। সেটি করেন আইনজীবী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। আগামী শুক্রবার মামলাটির শুনানি হবে।
বিধানসভার ৭৫-বছর পূর্তি উৎসব উপলক্ষে মঙ্গলবার বিধানসভা ভবনে আয়োজিত আলোচনাসভায় মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, “কেন টাকা দিয়ে বিচারের রায় কেনা যাবে?” বৃহস্পতিবার তাঁর সেই সব বক্তব্য নিয়েই আদালত অবমাননার এবং জনস্বার্থের মামলাগুলি হয়।
আর এ দিনই মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “সব বিচারপতি চোর, তা বলিনি। সব আইনজীবী চোর বলিনি। অনেক বিচারপতি জীবনে এক পয়সা খাননি।” তাঁর বক্তব্য, “আমি বলেছি, কেন বিচারের বাণী নীরবে, নিভৃতে কাঁদবে? আদালতে লক্ষ লক্ষ মামলা পড়ে আছে। মানুষ বিচার পায় না। বিচার বিভাগ, রাজনীতি বা প্রশাসনের সংস্কারের কথা বলেছি। স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন, আমাদের যেখানটায় ঘাটতি, সেটা বলা যদি অপরাধ হয়, তবে সেই অপরাধ আমি হাজার বার করব। মানুষের হয়ে কোটি বার কথা বলব। যা বলেছি, আবার বলব। সবারই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে। এটা আমার স্বাধীনতা।” এরই সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন, “আমি খুশি! আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। কোর্ট যা বলবে আমি তা মানতে বাধ্য ঠিকই। কিন্তু যদি সুযোগ পাই, আমিও যা বলার বলব। মনে রাখবেন আমিও এক জন আইনজীবী। দেশের হয়ে, মানুষের হয়ে বা আমার নিজের হয়ে লড়ার অধিকার আমার সব সময় রয়েছে।”
মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী। বৃহস্পতিবার দেবাশিস রায়ের তোলা ছবি।
রাজনৈতিক দলগুলিতেও আলোড়ন পড়েছে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য নিয়ে। সিপিএম মমতার সমালোচনা করলেও কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আপাত ভাবে মমতার পাশে দাঁড়িয়েছেন। কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী সলমন খুরশিদ গোড়া থেকেই বলে আসছেন, মমতা বর্ষীয়ান রাজনীতিক এবং মুখ্যমন্ত্রী। তাই তিনি কী বলেছেন, কোন প্রেক্ষিতে বলেছেন, তা খতিয়ে দেখা উচিত। তাঁর যুক্তি, বিচার ব্যবস্থার দায়বদ্ধতা বাড়াতেও মমতা এ কথা বলে থাকতে পারেন।
বিচারালয়কে ‘চোখ না-রাঙিয়ে’ সমাজবিরোধীদের সম্পর্কে কড়া অবস্থান নিতে বর্তমানকে ‘পরামর্শ’ দিয়েছেন প্রাক্তন। বৃহস্পতিবার রাজ্য সিপিএমের সাপ্তাহিক মুখপত্রের সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠানে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরাসরি না-হলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রসঙ্গ টেনে বলেন, “এখন কেউ আক্রমণ থেকে ছাড় পাচ্ছে না। কারও কিছু বলার অধিকার নেই। শুধু একটি কণ্ঠস্বরই মাথা তুলবে!” প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর আরও সংযোজন, “আইনশৃঙ্খলা নিয়ে বেশি কিছু না-বলাই ভাল! চরম নৈরাজ্য! সরকার বিচারপতি, বিচারালয়কেও চোখ রাঙাচ্ছে! কেন? সমাজবিরোধীদের সম্পর্কে একটু কড়া হোন না!” দিল্লিতে দলের নেতা নীলোৎপল বসুর বক্তব্য, মমতাই ৪০টি বিচারবিভাগীয় কমিশন গঠন করেছেন। এখন তিনিই আদালতের রায় কেনার কথা বলছেন।
এমন মন্তব্য না করাই ‘বাঞ্ছনীয়’ ছিল বলে মনে করলেও বিজেপি সরাসরি মমতাকে আক্রমণের পথে যায়নি। দলের নেতা ও আইনজীবী রাম জেঠমলানীর যুক্তি, “আমার মনে হয়, মমতা সামগ্রিক ভাবে বিচার ব্যবস্থার দিকে আঙুল তুলতে বা তাকে অবমাননা করতে চাননি। উনি নিশ্চয়ই জানেন, বিচার ব্যবস্থায় এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা প্রশংসার দাবি রাখেন।”
প্রাক্তন অ্যাটর্নি জেনারেল সোলি সোরাবজি অবশ্য কড়া ভাষায় মমতার সমালোচনা করেছেন। তাঁর মতে, মমতার মন্তব্য দায়িত্বজ্ঞানহীন। বিশেষ করে এক জন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর এই মন্তব্য করা উচিত হয়নি। কার্টুন-কাণ্ডে রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের রায়ে ক্ষুব্ধ হয়েই তিনি এই মন্তব্য করেছেন বলে মনে করছেন সোরাবজি। তাঁর মতে, “এর থেকে সহিষ্ণুতার অভাব প্রকাশ পায়। কেউ তাঁর কর্তৃত্ব বা কাজ নিয়ে প্রশ্ন তুললেই আক্রমণের মুখে পড়তে হয়।” আইনজীবী হরিশ সালভের আশঙ্কা, সরকারের প্রধানরা যদি এমন মন্তব্য করতে থাকেন, সংবিধান ও গণতন্ত্রের কাজেই সমস্যা তৈরি হবে।
আদালত ও বিচার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে এ দিন আইনজীবী সুব্রত মুখোপাধ্যায় প্রধান বিচারপতি জে এন পটেল ও বিচারপতি জয়মাল্য বাগচির ডিভিশন বেঞ্চের কাছে জনস্বার্থের মামলা শোনার জন্য বলেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, কত জন কত কিছু বলেন, তা নিয়ে হাইকোর্টের মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। তিনি জানতে চান, আদালতের প্রতি বার অর্থাৎ আইনজীবীদের আস্থা আছে কি না। সুব্রতবাবু বলেন, মুখ্যমন্ত্রী যদি বলেন, টাকা দিয়ে রায় কেনা যায়, তা হলে আবেদনকারীরা বিভ্রান্ত হতে বাধ্য। তাই আবেদনকারীদের স্বার্থেই জনস্বার্থের মামলার শুনানি হওয়া উচিত। এর পরে এই ডিভিশন বেঞ্চ মামলার আবেদন প্রথাগত ভাবে জমা দিতে বলে।
আজ, শুক্রবার প্রধান বিচারপতি হাইকোর্টে আসবেন না। তাই পরের শুক্রবার মামলাটির শুনানি হবে। প্রধান বিচারপতি নির্দেশ দেন, বিভিন্ন সংবাদ-চ্যানেলে দেখানো মুখ্যমন্ত্রীর সংশ্লিষ্ট বক্তব্যের সিডি-সহ অভিযোগের আবেদন একটি বন্ধ খামে হাইকোর্টের প্রশাসনিক বিভাগে অভিযোগ-সহ জমা দিতে হবে। হাইকোর্টের প্রশাসনিক প্রধান স্বয়ং প্রধান বিচারপতি।
বিচারপতি কল্যাণজ্যোতি সেনগুপ্ত এবং বিচারপতি অসীম মণ্ডলের ডিভিশন বেঞ্চে মুখ্যমন্ত্রীর সংশ্লিষ্ট বক্তব্য সম্বলিত কিছু সংবাদপত্রের কাটিং ও টিভি চ্যানেলের সিডি নিয়ে যান আইনজীবী বিকাশরঞ্জনবাবু। কোর্টের কাছে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে আদালত অবমাননার ফৌজদারি মামলার জন্য আবেদন জানানোর পরে ডিভিশন বেঞ্চ বিকাশ ভট্টাচার্যের জমা দেওয়া বিভিন্ন সংবাদপত্রের কাটিং ও বিভিন্ন চ্যানেলের সিডি দেখার জন্য সময় চায়। বেলা দু’টোর সময় বিচারপতি কল্যাণজ্যোতি সেনগুপ্ত জানান, তিনি সিডি ও সংবাদপত্রের কাটিং দেখেছেন। তিনি জানতে চান, মুখ্যমন্ত্রী কি এ কথা বিধানসভায় বলেছেন? বিকাশবাবু জানান, মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভার ৭৫ বর্ষ উদযাপনকে কেন্দ্র করে একটি আলোচনাচক্রে বক্তৃতা করছিলেন। বিধানসভার অধিবেশনে নয়। আইনজীবী সুদীপ্ত রায়ও এই মামলায় অংশগ্রহণ করতে চেয়ে আবেদন জানান। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি টেলিফোনে তাঁকে জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী নিজের অনুভূতির কথা বলেছেন। বিশাল সংখ্যক মানুষের সমর্থন নিয়ে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। তাঁর হয়ে সুদীপ্তবাবু মামলায় অংশ নিতে চান। বিচারপতি তাঁকে ওই ব্যক্তির নাম লিখে দিতে বলেন। বিচারপতি বলেন, কোন আবেদন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, কোনটা সঙ্গত, সেটা বিচার করতে পারবে না, হাইকোর্ট এমন দুর্বল নয়। এর পরেই ডিভিশন বেঞ্চ চারটি সংবাদ সংস্থাকে হলফনামা দিতে বলে। সুপ্রিম কোর্টেও এ দিন মুখ্যমন্ত্রী মমতার বিরুদ্ধে একটি আদালত অবমাননার আবেদন জমা পড়ে। আবেদনকারী জম্মু-কাশ্মীর প্যান্থারস পার্টির নেতা ও আইনজীবী ভীম সিংহ।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.