ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী
চেতলায় ধর্ষণ ‘সাজানো’, প্রকট তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বই
পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ডের পরে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘সাজানো ঘটনা’! যা নিয়ে প্রভূত বিতর্ক বেধেছিল। মহানগরে চেতলা-কাণ্ডের পরে এ বার দেখা গেল, ধর্ষণের অভিযোগ সত্যিই ‘সাজানো’ হতে পারে!
তবে পার্ক স্ট্রিটের সঙ্গে এই ঘটনার তফাত চেতলার ‘সাজানো’ ঘটনার পিছনে ধরা পড়ছে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর দলেরই গোষ্ঠী-লড়াই! যাতে জড়িয়ে পড়েছেন তৃণমূলের এক বর্ষীয়ান বিধায়ক, এক মন্ত্রী এবং তাঁর কাউন্সিলর-ভ্রাতৃবধূ। এই ঘটনায় সরকার পক্ষ যে কত ‘অস্বস্তি’তে, তা ধরা পড়েছে প্রবীণ মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্যে। সুব্রতবাবু বলেছেন, “কারও বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ প্রত্যাহার করলে, যিনি তা করলেন, তিনিও ধর্ষণকারীর মতোই সমান দোষী। এই ব্যাপারে সরকারেরও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা উচিত।”
আর স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী এমন ঘটনায় স্বভাবতই ক্ষুব্ধ। দলীয় স্তরে তিনি ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। দলের দুই শীর্ষ স্থানীয় নেতা মুকুল রায় ও সুব্রত বক্সীকে ঘটনার পিছনে তথ্যানুসন্ধান করতে বলা হয়েছে বলে তৃণমূল সূত্রের খবর। প্রকাশ্যে অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী তির ঘুরিয়ে দিয়েছেন অন্য দিকে। বেহালায় মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এক অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “ব্রেকিং নিউজের নামে মিথ্যা ধর্ষণ চালানো হচ্ছে। রটনা শুরু হয়ে যাচ্ছে। আমরা মহিলাদের সম্মান করি। মহিলাদের পাশে দাঁড়াই।”
ধৃত ছেনোকে আনা হল আলিপুর কোর্টে। বুধবারের নিজস্ব চিত্র।
চেতলার অভিযোগকারিণী এ দিন তাঁর বয়ান বদলে জানান, পুলিশের কাছে তিনি ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। পুলিশ জানিয়েছে, দফায় দফায় জেরায় ওই মহিলা দাবি করেছেন, ‘চাপ’ দিয়ে তাঁকে দিয়ে ওই অভিযোগ করানো হয়েছিল। যদিও কারা তাঁকে ‘চাপ’ দিয়েছিল, সে কথা ওই মহিলা বলেননি বলেই পুলিশের দাবি।
ঘটনার এমন নাটকীয় ‘পালাবদল’ যদি পুলিশ-প্রশাসনের কাছে ‘স্বস্তিদায়ক’ হয়ে থাকে, ‘অস্বস্তি’ বেড়ে গিয়েছে প্রধান শাসক দল তৃণমূলের। ধর্ষণের অভিযোগে ধৃত অজয় ভট্টাচার্য ওরফে ছেনো দক্ষিণ কলকাতার তৃণমূল কর্মী। ঘটনাক্রমে তৃণমূলেরই একটি অংশ থেকে অভিযোগ উঠছে, দলেরই একাংশ অজয়কে ‘ফাঁসানো’র জন্য ওই মহিলাকে ‘কাজে’ লাগিয়েছিল। যার মূলে রয়েছে দক্ষিণ কলকাতারই দুই তৃণমূল নেতার লড়াই! তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে প্রোমোটারি, সিন্ডিকেট-রাজ এবং এলাকার ‘খবরদারি’ নিয়ে দলের এক গোষ্ঠীর সঙ্গে অন্য গোষ্ঠীর বিবাদ কোন স্তরে পৌঁছতে পারে, তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হয়ে থাকল চেতলা-কাণ্ড এমন ব্যাখ্যা করছে শাসক শিবিরেরই একাংশ।
অভিযোগকারিণীর বয়ান বদলের পরে মুখ্য সরকারি সচেতক তথা তৃণমূল বিধায়ক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় দাবি করেছেন, দলের কেউ এমন ঘটনায় জড়িত থাকলে তাঁদের তৃণমূল থেকে বহিষ্কার করা উচিত।
অভিযোগকারিণী মহিলা কলকাতা পুরসভার তৃণমূল কাউন্সিলর জুঁই বিশ্বাসের ‘ঘনিষ্ঠ’ বলেই এলাকার তৃণমূল মহলে পরিচিত। জুঁইয়ের স্বামী স্বরূপ বিশ্বাস যুব তৃণমূল নেতা এবং স্বরূপবাবুর দাদা অধুনা মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। স্বরূপের হাতেই এখন এলাকার ‘রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ’। তৃণমূল সূত্রের খবর, ৮১ নম্বর ওয়ার্ডে স্বরূপদের সঙ্গে ইদানীং বিরোধ বেধেছিল রাসবিহারীর বিধায়ক শোভনদেববাবু এবং তাঁর অনুগামীদের। তার জেরেই শোভনদেববাবুর ‘ঘনিষ্ঠ’ অজয়কে ‘ফাঁসানো’র চেষ্টা হয়েছিল বলে তৃণমূলেরই একাংশের বক্তব্য। অভিযোগকারিণী বয়ান বদলে ‘চাপ’ দিয়ে অভিযোগের কথা বলায় তৃণমূলের এই গোষ্ঠী-লড়াই আরও প্রকট হয়ে গিয়েছে! শোভনদেববাবু কারও নাম না-করেই বলেছেন, “ওই মহিলার নারীত্বকে ব্যবহার করে, টাকাপয়সা এবং নানা প্রভাব খাটিয়ে যাঁরা এমন জঘন্য অভিযোগ করালেন, তাঁরা আখেরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবমূর্তিরই ক্ষতি করলেন। মুখ্যমন্ত্রীর বিধানসভা এলাকায় (মহিলার প্রথম অভিযোগ অনুযায়ী, অকুস্থল ভবানীপুর কেন্দ্রেই পড়ছিল) ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলে প্রচার হয়ে গেল। এক জন তৃণমূল কর্মীর চরিত্র হনন করা হল। যাঁরা এমন কাজ করলেন, তাঁরা তৃণমূলের কেউ হয়ে থাকলে তাঁদের দল থেকে বহিষ্কার করা উচিত।” মন্ত্রী অরূপ এই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
তথ্যে-নেপথ্যে

এ বার কী
মহিলার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা?
• তদন্ত শেষে পুলিশ আদালতে যেতে পারে।
• কোর্ট ভারতীয় দণ্ডবিধির ২১১ ধারায় মামলা করতে পারে।
• দোষী সাব্যস্ত হলে সর্বোচ্চ দু’বছর জেল।
তাঁর জবানবন্দি?
• ম্যাজিস্ট্রেট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবেন।
• জবানবন্দি আর আদালতে গ্রাহ্য হবে না।
• ম্যাজিস্ট্রেটও ২১১ ধারায় মামলা করতে পারেন।
ধৃত অভিযুক্তের ভবিষ্যৎ?

• ধৃতের বিরুদ্ধে হুমকি ও ষড়যন্ত্রের মামলা রুজু করেছে পুলিশ।
• সেই অভিযোগ কিন্তু মহিলা প্রত্যাহার করেননি
• দু’টি অভিযোগ নিয়েই এখন তদন্ত চলবে।

রহস্যভেদ কোন পথে
সোমবার
• মহিলাকে দফায় দফায় জেরা।
• গোপালনগরের এক বাড়ির কথা প্রকাশ।
• ঘুরে-ফিরে তা জানতে চায় পুলিশ।
• মহিলা প্রসঙ্গটি আর মাড়ানইনি।
• পুলিশ ইতিমধ্যে বাড়ির খোঁজ পায়।
• তারই এক ফ্ল্যাটে মহিলা আয়ার কাজ করেন।
• জানা যায়, মহিলা শনিবার রাতভর ওখানে ছিলেন।
• তিনি এক নার্সের থেকে কাজ বুঝে নিয়েছিলেন।
• ওই নার্সের সঙ্গেও পুলিশ কথা বলে।
• এ সবের কিছুই মহিলাকে জানায়নি পুলিশ।
মঙ্গলবার
• দুপুরে লালবাজারে মহিলাকে তলব।
• এ বারও তিনি বাড়ি-প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান।
• পুলিশ জানায়, বাড়িটির খোঁজ মিলেছে।
• গৃহকর্ত্রীর সঙ্গে কথাবার্তার ভিডিও দেখায়।
• মহিলা কবুল করেন, শনিবার রাতে ফ্ল্যাটেই ছিলেন।
• তাঁর দাবি, চাপ দিয়ে মিথ্যে নালিশ লেখানো হয়েছে।
প্রশ্ন
• কে বা কারা ‘চাপ’ দিয়েছিল?
• কেন দিয়েছিল?
অভিযোগের আঙুল তৃণমূলের যে শিবিরের দিকে, তারা অবশ্য অন্য কথা বলছে। জুঁই যেমন বলেছেন, “এর মধ্যে কোনও গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব নেই। এক জন মহিলাকে দিয়ে মিথ্যা ধর্ষণের অভিযোগ করানো হবে, এমন বিকৃত মানসিকতা নিয়ে রাজনীতি হয় না!” স্বরূপও গোষ্ঠী-লড়াইয়ের কথা অস্বীকার করে বলেছেন, মহিলার অভিযোগ জানার পরে তাঁরা পুলিশের কাছে পাঠিয়েছিলেন। পুলিশ-প্রশাসন তদন্ত করে যা জেনেছে, তা-ই বলেছে। পুলিশ-প্রশাসনের উপরে তাঁদের ‘পূর্ণ আস্থা’ রয়েছে।
সীমানা পুনর্বিন্যাসের ফলে কলকাতা পুরসভার ৮১ নম্বর ওয়ার্ডটি এখন রাসবিহারী কেন্দ্রে এসেছে। ওই এলাকার রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নিয়েই গোলমালের সূত্রপাত। তৃণমূলের এক প্রবীণ নেতার কথায়, “৮১ নম্বর ওয়ার্ডে শোভনদেববাবুকে ঢুকতে দিতে চায় না স্বরূপ-গোষ্ঠী। হাসপাতালে ভর্তি বা আনুষঙ্গিক বিষয়ে শোভনদেববাবু ইদানীং তাঁর লেটারহেডে শংসাপত্র দিচ্ছিলেন। তাতেও সমস্যা বাড়ছিল। আবাসন দফতরে শোভনদেববাবুর অনুগামী কিছু ইউনিয়নের সঙ্গেও ওই দফতরের মন্ত্রী অরূপবাবুর সমস্যা বাড়ছিল। কিন্তু সে সবের জেরে যে এমন ঘটনা ঘটতে পারে, তা অকল্পনীয়!” তৃণমূল সূত্রের বক্তব্য, প্রোমোটারি, সিন্ডিকেট, রেলের সাইডিং থেকে আয় এ সব নিয়ে দলের মধ্যে গোষ্ঠী-কাজিয়া বাড়ছিল। স্বরূপদের সঙ্গে যাদের বনিবনা হচ্ছিল না, তারা চলে যাচ্ছিল শোভনদেববাবুর দিকে। এই ঘটনায় অভিযুক্ত অজয় আগে কাউন্সিলর স্বরূপ-গোষ্ঠীরই অনুগামী ছিলেন। পরে তিনি শোভনদেববাবুর শিবিরে চলে যাওয়ায় তাঁকে কিছু দিন ধরে ‘হুমকি’ দেওয়া হচ্ছিল বলে অভিযোগ।
অভিযোগকারিণী মহিলা পুরসভায় ১০০ দিনের কাজের সূত্রে তৃণমূলের সংস্রবে এসেছিলেন। তাঁকে সামনে রেখে যে ভাবে অজয়ের নামে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়েছে, গোড়াতেই তার প্রতিবাদ করেছিলেন শোভনদেববাবু। মেডিক্যাল টেস্টের রিপোর্ট ছাড়া এমন অভিযোগ জোর দিয়ে করা হচ্ছে কী ভাবে, সেই প্রশ্নও তুলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত অভিযোগকারিণীই বয়ান বদলে ফেলায় তাঁর প্রতিক্রিয়া, “সত্যের জয় হবেই!”
সেই ‘সত্য’ শাসক দলের কাছে ‘অপ্রিয়’ হল ঘটনার মোচড় এখানেই!
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.