বিল্টুর দোয়েল
বিল্টু মধ্যমগ্রামে ওর পিসির বাড়ি পৌঁছেই ছুটোছুটি শুরু করে দিয়েছে। ওর পিসতুতো দাদার সঙ্গে এক বার এ দিক তো পরক্ষণেই অন্য দিকে। অনেকটা জায়গা নিয়ে বাড়ি তো, তাই ছুটোছুটি করতে কারও অসুবিধে নেই। বাড়িতে আমগাছ, লেবুগাছ, সুপুরিগাছ এবং নানা রকমের পাতাবাহারি গাছও আছে। এক বার লেবুপাতা একটা ছিঁড়ে হাতের পাতায় সামান্য ঘসে নিয়ে সেই হাত বহুক্ষণ ধরে বার বার করে শুঁকেছিল, মনে আছে বিল্টুর। সেই প্রায় দু’বছর আগে শেষ পিসির বাড়ি এসেছিল বিল্টু। কেন যে বাবা-মা বছরে তিন-চার বার পিসির বাড়িতে আসে না, বুঝতে পারে না সে। বাবার এত কীসের কাজ, সব সময় ‘কাজ আছে’ বলে ওকে সরিয়ে রাখা, মোটেও পছন্দ করে না বিল্টু।
বিল্টু তো মধ্যমগ্রামে এসেই কত পাখি চিনেছে। কলকাতার ফ্ল্যাট বাড়িতে তো আর ও-সব পাখি-টাখি দেখা যায় না!
বিল্টু ওর পিসতুতো দাদা, অজয়কে বলল, একটাও টুনটুনি পাখি দেখলাম না। কেন?
সব সময় কি সব পাখি এ দিকে আসে? এখনও যখন এল না, পরে ঠিকই আসবে। আমি তো রোজই দেখি। লেবুগাছে, পাতাবাহারি গাছে বসে বসে দিব্যি খেলা করে আর ফুড়ুৎ করে উড়ে চলে যায়।
বিল্টু দাদার হাতটা ধরে বলল, আমার না একটা টুনটুনি পাখি পোষার খুব ইচ্ছে!
ধ্যাৎ, টুনটুনি পাখিকে কি কেউ পুষতে পারে? কী যে বলিস!
কেন, ধরতে পারলেই পোষ মানবে।
কে ধরবে টুনটুনিকে? তবে হ্যাঁ, আমার সঙ্গে আজকে রাত্তিরে শুবি, তখন তোকে একটা মজার জিনিস দেখাব।
বিল্টু দাদার মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে থেকে বলল, কী জিনিস?
যখন দেখবি, তখনই জানতে পারবি।
তবু বলো না, আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে।
তবে শোন, ঠিক রাত্তির আটটা-সাড়ে আটটার সময় একটা দোয়েল পাখি বারান্দায় একটা কোণে গিয়ে বসে। বারান্দায় গ্রিলের উপরে যে বাড়তি ঢালাইটা আছে না, সেখানে এসে বসে। সারা রাত চুপচাপ বসে থেকে ভোর চারটের সময় ডাকা শুরু করে। কী মজার, তাই না?
দাদার মুখ থেকে শোনামাত্রই বিল্টু লাফাতে লাগল। ইস্, এক্ষুনি যে কেন সন্ধে হয়ে যাচ্ছে না! প্রচণ্ড আনন্দ হচ্ছে বিল্টুর, সঙ্গে সঙ্গে এক অজানা বিস্ময়। অবশেষে এক সময় সূর্যটা অস্ত গেল।
অজয়দাদার কথা মতো বিল্টু চুপচাপ দাদার ঘরে বসে বসে দেখল, ঠিক একটা পাখি কোত্থেকে ওই কোণটায় এসে বসল। দাদা তো বলল, দোয়েলই হবে বোধ হয় ওই পাখিটা।
বিল্টু অজয়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে প্রশ্ন করল, আমাকে দোয়েলটা ধরে দেবে?
চুপ, এমন কথা বলতে নেই। এখানে এসেছে বিশ্রাম নিতে, তাকে আমি ধরব কেন? একদম না। ওদের ধরলে বুঝি কষ্ট হয় না। বিল্টু, তোকে যদি একটা খুব বড় জায়গায় প্রচুর খেলনা আর খাবার-টাবার দিয়ে বাইরে থেকে তালা দিয়ে আটকে রাখে কেউ, তখন তোর কেমন লাগবে?
বিল্টু চুপ। একটাও শব্দ করল না আর। শুধু অপলক চোখে আবছায়ায় বসা ওই ছোট পাখিটির দিকে অসহায় হয়ে চাইল বার বার।

অজয় অবাক হয়ে বিল্টুকে প্রশ্ন করল, তুই ঘুমোসনি? কেন?
বিল্টু ফিসফিস করে বলল, ক’টা বাজে? আর কতক্ষণ বাকি?
অজয় বিল্টুর কথা বুঝতে পেরে ছোট্ট করে হেসে বলল, দোয়েলটা কখন ডাকে তার জন্য কি তুই সারা রাত ঘুমোসনি? আরে, যখন ডাকবে, তুই ঠিকই টের পাবি।
বিল্টু বলল, ও ডাকার আগে থেকেই আমি ওকে দেখব। দরজাটা খুলে দাও না।
অজয় উঠে দরজা খুলে দিলে বিল্টু বড় বড় চোখ মেলে পাখিটার দিকে তাকিয়ে থাকল। বলল, ওরা খুব জোরে ডাকে তাই না, দাদা?
অজয় উত্তর দেওয়ারও সুযোগ পেল না, তার আগেই তীক্ষ্ণ চিৎকারে অন্ধকার চৌচির হয়ে গেল। দোয়েলটা এত ছোট, তবু কী রকম ওর গলার জোর! বিল্টু আনন্দে হাততালি দিয়ে বসল।
আরও কিছুটা সময় পর, যখন আকাশ ফর্সার কাছাকাছি, সেই সময় দোয়েলটা ওর দুটো ডানা ঝটপট করে উড়ে এসে বসল বারান্দার গ্রিলে।
বিল্টু এখন খুব কাছ থেকে পাখিটার সাদা-কালো সুন্দর চেহারাটা দেখতে পেল। কিন্তু সেটাও কয়েক মুহূর্তমাত্র। তার পরেই বিল্টুকে মনে কষ্ট দিয়ে কোথায় যে উড়ে গেল, ও তা জানে না।
বিল্টু খুব আস্তে বলল, যা!
অজয় বলল, আর আসবে না সারা দিন। তবু কী জানি, আজকে ও তোর জন্যই কি না, অনেকক্ষণ এখানে ছিল। অন্য দিন তো কত আগেই উড়ে যায়।

আজ বিল্টু আবার কলকাতায় ফিরে যাবে। চার দিন পর এখান থেকে যেতে ওর মন চাইছে না। কত সুন্দর-সুন্দর পাখি ওর মন ভরিয়ে দিয়েছে এই চারটে দিন। আজ, তাই কাকভোরে, বিল্টু ওর মনের কষ্টের কথা মনে মনে বলেছে দোয়েলটাকে। আরও আশ্চর্য, দোয়েলটা আজকে অন্য দিনের তুলনায়, কেন জানি না, অনেকটা সময় নিজের জায়গায় বসেছিল। বসে বসে ওর ছোট ছোট চোখ দুটো দিয়ে পিটপিট করে তাকিয়ে দেখছিল বিল্টুকে। কে জানে, হয়তো দোয়েলটা কিছু আঁচ করতে পেরেছে।
না, বিল্টু আর চায় না দোয়েল বা টুনটুনি অথবা অন্য যে কোনও পাখিকে খাঁচায় ধরে রাখতে। দোয়েলের দুটো চোখে ও যে রকম খুশি দেখেছিল, তা কি খাঁচায় ধরে ভালমন্দ খাওয়ালে আদৌ থাকবে?
আর কি ওই পাখিটার দেখা পাবে বিল্টু? প্রচণ্ড দেখতে ইচ্ছে করছে দোয়েলটাকে, এক বার চোখের দেখা দেখতে। চলে তো যেতে হবেই, আর আগে কি...
মনমরা বিল্টুকে অবাক করে অজয় চিৎকার করে উঠল, দেখে যা বিল্টু, তোর দোয়েলটা আবার এসেছে। কোনও দিনও এই সময়ে আসে না, আজ তুই চলে যাবি জেনেই হয়তো না এসে পারেনি।
বেরোনর জামাটা ঠিক মতো পরাও হয়নি, সেই অবস্থাতেই এক ছুটে বিল্টু বারান্দায় গিয়ে টি-ই করে ডাক দিল। কী আশ্চর্য, দোয়েলটাও তেমনি বিল্টুর দেখাদেখি শিস দিল তৎক্ষণাৎ। বড়রা তো সেই সময় রীতিমতো অবাক।

ট্রেনের জানলার পাশে মনমরা বিল্টু চুপ করে দাঁড়িয়ে।
বাঁ দিকে গাছপালা, ঘরবাড়ি সব ছুটে ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে। বিল্টুর এখন দুটো চোখই ঝাপসা। দোয়েলটার শেষ শিসের শব্দ ওর কানে গেঁথে আছে যে।
ওর কোনও কিছু ভাল লাগছে না। ওর দোয়েলটার জন্য মন ভীষণ খারাপ। কে জানে আবার কবে বাবা-মা ওকে মধ্যমগ্রামে নিয়ে আসবেন। আচ্ছা, তখন গেলে নিশ্চয়ই পাখিটা বিল্টুকে চিনতে পারবে। ওকে দেখামাত্র তীব্র শব্দে শিস দিয়ে উঠবে তো পাখিটা?
কে জানে, দোয়েলটাই জানে।

ছবি: দেবাশীষ দেব


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.