মুখোমুখি ২...
স্রেফ বন্ধুদের কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়ার জন্য ছবি বানাচ্ছি আমরা
পত্রিকা: প্রথম প্রশ্নটা কিন্তু ভীষণ প্রেডিকটেবল. ‘কাকাবাবু’ করলেন না কেন?
প্রসেনজিৎ: দেখুন, সময় একটা বিরাট ফ্যাক্টর। ‘কাকাবাবু’ করার জন্য যতটা সময় দরকার ততটা সময় আমি কিছুতেই পাচ্ছিলাম না। আমার পরের ছবি ‘হনুমান ডট কম’। পরিচালনা করছে গৌরব (পাণ্ডে), প্রযোজনা করছে সিনে নাইন-এর নমিত (বাজোরিয়া)। সেটার শ্যুটিং করতে আইসল্যান্ড যাচ্ছি। এটাই প্রথম বাংলা ছবি যেটার শ্যুটিং হবে আইসল্যান্ডে। এই ছবিটার শ্যুটিং আমাকে অগস্টের মধ্যেই সারতে হবে। না হলে এক বছর পিছিয়ে যাবে ছবিটা। সেটা করে ফিরেই ‘কাকাবাবু’র শিডিউলটা ছিল। কিন্তু আমি রেডি নই। একটু নিজের আর একটু ‘কাকাবাবু’র স্ক্রিপ্টের— দুটোরই সময়ের প্রয়োজন আছে।

পত্রিকা: ইন্ডাস্ট্রি কিন্তু অন্য কথা বলছে।
প্রসেনজিৎ: কী বলছে ইন্ডাস্ট্রি?

পত্রিকা: বলছে আপনার সঙ্গে সৃজিতের সম্পর্কে চিড় ধরেছে। তার কারণ, সৃজিত নাকি অনেককে বলছেন উনি ‘কাকাবাবু’ করতে চাননি। আপনি নাকি জোর করে সৃজিতকে দিয়ে কাকাবাবু করাচ্ছিলেন।
প্রসেনজিৎ: (দীর্ঘ নীরবতা, ভীষণ গম্ভীর) সৃজিত তো এটা শুধু বলেনি। লিখেওছে। খোঁজ নিয়ে দেখুন।

পত্রিকা: কোথাও একটা মনে হচ্ছে আপনি খুব রেগে আছেন?
প্রসেনজিৎ: আমি? না, না। আমি রেগে নেই।

পত্রিকা: তা হলে?
প্রসেনজিৎ: দেখুন আমি রেগেও নেই, অ্যাজিটেটেডও না। ইন্ডাস্ট্রি তো ভাল সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, সবাই ভাল কাজ করছে। কিন্তু কয়েকটা জিনিস দেখে আমার সত্যি বিরক্ত লাগছে।

পত্রিকা: কী দেখে এত বিরক্তি আপনার?
প্রসেনজিৎ: আমার মনে হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রিতে কোথায় একটা সত্যের অভাব হচ্ছে। এত গ্রোথ-এর গল্প শুনি, এত কোটি, কোটি টাকার গল্প শুনি, এত লেখা-টেখা দেখি কিন্তু কোথাও কি আমরা ভাবার চেষ্টা করছি যে কাজটা হচ্ছে, সেটা বাংলা সিনেমার পক্ষে কতটা উপকারী? পুরো ইন্ডাস্ট্রি কাজ করছে পুরোদমে কিন্তু কারও কোনও টার্গেট আছে বলে তো মনে হচ্ছে না আমার। আরে ভাই আমরা সবাই স্বপ্ন দেখছি যেন একটা। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেঙে গেলে আমাদের আর ধরার কিছু থাকবে না। এটা আমার খুব স্ট্রংলি মনে হয়...

পত্রিকা: মানে অধিকাংশই স্রোতে গা ভাসাচ্ছে...
প্রসেনজিৎ: দেখুন, আজকাল শুনি একসঙ্গে দেড়শোটা ছবির নাকি শ্যুটিং চলছে। কিন্তু কেউ কি জানে এত ছবির সঠিক হল-কালেকশন কত? রোজ শুনি বাম্পার উইক, এক সপ্তাহে এত কালেকশন। আর যত দ্রুত পারা যায় সেটাকে পেজ থ্রি-র পাতায় ছাপিয়ে দিতে পারা। কিন্তু কেউ কি আমায় বলতে পারবে ডিভিডি রাইট্স, স্যাটেলাইট রাইট্স বাদ দিলে শুধু টিকিট বিক্রি করে কত টাকা কামানো হচ্ছে? কেউ বলতে পারবে না। আমরা আর সিনেমা বানাচ্ছি না, আমরা শুধু কয়েকটা ধারণা বিক্রি করে যাচ্ছি। সিনেমা বানানোর মধ্যে একটা ভালবাসা আছে, সেটা আর দেখছি না। পুরো ব্যাপারটা ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আগামী ছবি ‘হনুমান ডট কম’-এর এক্সক্লুসিভ ফার্স্ট লুক
পত্রিকা: সেই ইন্ডাস্ট্রির আপনিই তো সবচেয়ে বড় স্টার...
প্রসেনজিৎ: তাই তো সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগে আমার। শুধু ব্যবসা আর কত কামাচ্ছি ভাবলে তো ‘পথের পাঁচালী’ বানানো যায় না। সেই ছবিটার তখন কী ব্যবসা ছিল? কিছুই তেমন না। কিন্তু আজকে দেখুন, ‘পথের পাঁচালী’র আজও বিক্রি আছে। তা হলে শুধু হিট-ফ্লপ, ব্যবসা-কালেকশনের কী মানে যদি না আমরা উন্নত মানের সিনেমা-ই না বানাতে পারি? আর সত্যি বলছি, আমরা ছাড়াও অন্য জায়গাতেও কিন্তু দারুণ কাজ চলছে। মরাঠিতে, দক্ষিণ ভারতে। একমাত্র আমরাই উন্নত মানের সিনেমা বানাচ্ছি না কিন্তু। আমরা আজকে শুধু নিজেদের বন্ধুদের কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়া যায়, এমন ছবি বানাচ্ছি।

পত্রিকা: আপনি তো মারাত্মক কথাবার্তা বলছেন...
প্রসেনজিৎ: কিন্তু সেটাই তো সত্যি। উন্নত ছবি কই? শুধুই ঝকঝকে মেক-আপ আর কস্টিউম মানেই যেন আজকাল ভাল সিনেমা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার একটা থিয়োরি আছে। বাংলা সিনেমার সেই রকম কোনও উন্নতি হয়নি। উন্নতি হয়েছে শুধু বাঙালি দর্শকের। তাঁরা নতুন, নতুন আইডিয়াকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। এই তো গত কয়েক বছর আমি ‘মনের মানুষ’, ‘অটোগ্রাফ’ নিয়ে অনেক জায়গায় ঘুরেছি। এই দুটো ছবি অসাধারণ। কিন্তু অন্য ইন্ডাস্ট্রিতেও এই রকম কাজ চলছে। আমাদের তুলনাটা সেই সব ইন্ডাস্ট্রির সেরা ছবিরগুলোর সঙ্গে হওয়া উচিত। সত্যি বলছি, অন্য ইন্ডাস্ট্রিতে যে পরিমাণ ভাল কাজ হচ্ছে, সেই তুলনায় আমরা কয়েক ধাপ নীচে। আমি বলতে চাইছি আমাদের মধ্যে ভাল কিছু করার তাগিদটাই যেন চলে যাচ্ছে।

পত্রিকা: যখন ‘আমাদের’ শব্দটা ব্যবহার করছেন, তখন কি প্রথমেই আপনি বাংলা ছবির প্রযোজকদের কথা বলছেন? এই ধরুন ভেঙ্কটেশ ফিল্মস?
প্রসেনজিৎ: দেখুন, আমি সবার কথা বলছি। আর্টিস্ট, পরিচালক, প্রযোজক। ভেঙ্কটেশ ফিল্মস নিঃসন্দেহে আজকের ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে বড় প্রযোজক। ওদের দায়িত্ব তো বেশি হবেই। ওদেরও যেন সময় নেই। একটা সময় ছিল যখন শ্রীকান্ত বছরে দশটা গল্প শুনত আর তার থেকে বেছে তিনটে ছবি করত। কিন্তু ওই তিনটে ছবিই মনকে ছুঁয়ে যেত। আজকে শ্রীকান্ত বছরে অনেক ছবি করে কিন্তু মনকে ছুঁয়ে যাওয়ার মতো ছবি করে বছরে একটা কি দু’টো। আমি বলতে চাইছি, যে সময়টা ও আগে দিতে পারত সেটা তো আর পারছে না। সবাই যেন কী রকম তাড়াহুড়ো করছে।

পত্রিকা: একই সমস্যা কি পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়েরও? ইন্ডাস্ট্রির একটা মত সৃজিত বড্ড তাড়াহুড়ো করে ছবি বানাচ্ছেন...
প্রসেনজিৎ: দেখুন, সৃজিত সম্বন্ধে আমি কোনও ভবিষ্যদ্বাণী করব না। সৃজিতকে নিয়ে নিশ্চয়ই কথা বলব আমি, কিন্তু সেটা পাঁচ বছর পরে, তার আগে নয়। সৃজিত আগে দশটা ছবি পরিচালনা করুক, তার মধ্যে অন্তত সাতটা হিট ছবি বলছি না, অন্তত ভাল ছবি বানাক, তারপর তো ওকে নিয়ে কথা হবে।

পত্রিকা: তাই?
প্রসেনজিৎ: দেখুন, এই জগৎটা একেবারে দয়ামায়াহীন। আমার কানেও অনেক কিছু আসে। কিন্তু তার সত্যতা যাচাই করতে আমি কোনও দিন যাইনি। আমি এইটুকুই জানি, বেশি উড়লে, ভগবান একদিন তোমায় ফেলবেনই। এটা আমি আমার ক্ষেত্রেও দেখেছি। উনি সব দেখেন ওপর থেকে। আপনি যেই উড়বেন, উনি হাল্কা করে আপনাকে মাটিতে এনে ফেলবেন। বলবেন একটু মাটিতে ফেরো সোনা। এটা নিয়ে আমি টেনশন করি না। আসলে আমার এই মুহুর্তে কী মনে জানেন তো?

পত্রিকা: কী?
প্রসেনজিৎ: মনে হয় সব ঝেড়ে ফেলে আবার ঋতুদা’র (ঋতুপর্ণ ঘোষ) ইন্ডাস্ট্রিতে ফিরে আসার সময় হয়েছে। ঋতুদা’র সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত ঝামেলা, অশান্তি যা-ই হয়ে থাকুক না কেন, ইন্ডাস্ট্রির ওকে দরকার। সমস্যাটা কী হয় জানেন, ঋতুদা’-দের মতো পরিচালকরা একটা খোলসের মধ্যে চলে যায়। ওদের নিজেদের ঝামেলায় এমন জড়িয়ে পড়ে যে ফোকাসটা চলে যায়, কিন্তু তা-ও, ঋতুদা’কে খুব দরকার এখন।

পত্রিকা: ঋতুপর্ণ ঘোষ কী ভুল করেছিলেন বলে আপনার মনে হয়?
প্রসেনজিৎ: ডি-ফোকাস হয়ে গিয়েছিল ঋতুদা’, কিন্তু ঋতুদা’র যে একটা ধারা আছে সেটা তো কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। হি ইজ অ্যান অনারেবল ট্রেনার। ও নন-অ্যাক্টরকেও অ্যাক্টর বানাতে পারে। ও তো মেকার হিসেবে কোনও ভুল করেনি, শুধু কিছু জায়গায় ডি-ফোকাসড হয়ে গিয়েছিল। ঋতুদা তো ‘ আরেকটি প্রেমের গল্প’ তে ভাল অভিনয় করল। কিন্তু তারপর আবার করে পর পর ছবিতে অভিনয় করতে গেল কেন? হি ইজ এ মাস্টার ডিরেক্টর। হি শু্যড হ্যাভ কনসেনট্রেটেড অন ডিরেকশন। আমি বলছি, ঋতুদা’ যদি মনে করে কাল থেকে আমি সব ঝেড়েঝুড়ে ‘১৯শে এপ্রিল’-এর মতো সিনেমা বানাব, তা হলে একমাত্র ও-ই সেটা বানিয়ে ইন্ডাস্ট্রির মোড়টা ঘুড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু তার জন্য ওকে ব্যাগেজটা ঝেড়ে ফেলতে হবে। নিজের কথা বলে বলছি না, আমি কিন্তু এত দিন কাজ করেও ‘অটোগ্রাফ’-এর মতো ছবিতে নিজেকে সম্পূর্ণ ভেঙেচুরে নতুন করে নিয়েছিলাম। না করলে আপনি সার্ভাইভ করতে পারবেন না। কী জানেন তো, মাঝে মাঝে অনেক সাফল্যের পর না একটু ল্যাংটো হয়ে শুরু করতে হয়। রোজই তো আপনি ব্র্যান্ডেড ঘড়ি, ব্র্যান্ডেড জামা, ব্র্যান্ডেড জিন্স, ব্র্যান্ডেড জুতো পরে বেরোন বাড়ি থেকে। কিন্তু যদি টিঁকে থাকতে হয় তাহলে মাঝে মাঝে দামি জিনিস ফেলে, বাড়ির হাফ-প্যান্ট আর টি-শার্ট পরে বেরিয়ে পড়ুন। নিজেকে আবার করে খুঁজে পাবেন।

পত্রিকা: বাংলা সিনেমা তার মানে এখন সেই ব্র্যান্ডেড জুতো, জামা, ঘড়ি?
প্রসেনজিৎ: হা, হা, হা, হা, হা! ব্র্যান্ডেড মানে কিন্তু খারাপ না। আমি কোনও দিন বলব না, শিল্প করো বলে প্লিজ তুমি মার্সিডিজ কিনো না। নিশ্চয়ই কিনবে। কিন্তু উন্নত কাজ তো করো। আর এখন তো কত সুবিধে। মিডিয়া বাংলা ছবিকে কী অসম্ভব সাপোর্ট করছে। এক সময়ে গোল্ডেন জুবিলি, সিলভার জুবিলি রেগুলার করেছি আমরা, কিন্তু কিস্যু লেখা হয়নি আমাদের নিয়ে। অনেক বড় হিট দেওয়ার পরও আমায় শুনতে হয়েছে ‘ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো’। কিন্তু তাতে দমে যাইনি। সেটা ভুল প্রমাণ করার নেশায় আবার শুরু করেছি। আজকে তো আর সেই সহিষ্ণুতা দেখি না। এখন সবাই রিঅ্যাক্টিভ। এখন সবাই বলছে, সে কালজয়ী কাজ করছে। এটাই সমস্যা।

পত্রিকা: তার মানে কি বাংলা ছবির এই ‘গ্রোথ’টা পুরোটাই একটা বেলুন ছিল?
প্রসেনজিৎ: বেলুন বলব না। নিঃসন্দেহে গ্রোথ হয়েছে। ১০০ টাকার জায়গায় ৩০০ টাকার বাজার তৈরি হয়েছে। কিন্তু ১০০ টাকার সময়ে আমরা ৭৫ টাকা খরচ করতাম, ২৫ টাকা লাভ করতাম। এখন ৩০০ টাকার বাজার হয়েছে, কিন্তু খরচ হচ্ছে ৩৫০ টাকা। বলুন না, শেষ পাঁচ বছরে ক’টা নতুন হল তৈরি হয়েছে? হাতে গোনা, বরং অনেক হল বন্ধ হয়ে গেছে। ‘বেডরুম’, ‘রঞ্জনা’, ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’সব কটা ছবি চলেছে, কিন্তু প্রযোজকের ঘরে ক’টা টাকা ঢুকেছে। প্রযোজক কতটা লাভ করেছে সেটা জানতে হবেই আমাদের, না হলে ইন্ডাস্ট্রি বেঁচে থাকবে না।
আমি নিজে ‘তিন ইয়ারি’র প্রযোজক। আমাদের ৫৫ লাখ টাকার ব্যবসা হয়েছে, কিন্তু প্রযোজকের ঘরে এসেছে মাত্র বারো লাখ টাকা। এসব বললে, লিখলে খারাপ হয়ে যাবেন আপনি।

পত্রিকা: ‘হেমলক’-ও প্রথমে আপনাকে অফার করা হয়েছিল। আপনি অফারটা নেননি কেন?
প্রসেনজিৎ: হ্যাঁ, অফার করা হয়েছিল। দেখুন, ‘অটোগ্রাফ’ আর ‘বাইশে শ্রাবণ’-য়ে এতটাই অথর-ব্যাকড রোল ছিল যে করার সময় আমি জানতাম আমি ছাড়া আর কারও পক্ষে করাটা সমস্যা হবে। ‘হেমলক’-এর চিত্রনাট্য শুনে আমার মনে হয়েছিল এটা পরম, আবিরএরাও করতে পারে। সেই বু-ম্বা-দা ব্যাপারটা স্ত্রিপ্টে ছিল না। পরে সৃজিতও একমত হয়েছিল আমার সঙ্গে। পরম তো দুর্দান্ত কাজ করেছে। আমার তো মনে হয়েছে পরম এই ছবিটায় ব্রিলিয়ান্ট। তবে হ্যাঁ, ‘অটোগ্রাফ’, ‘বাইশে শ্রাবণ’ রিলিজের পর চারদিকে যে বাজনাটা বেজেছিল, সেই বাজনাটা বাজেনি।
আমার কাছ থেকে মানুষ বেশি কিছু চায়। আসলে আমি খুব লোভী হয়ে গেছি। ‘রঞ্জনা আমি আর আসব না’ দেখে আমি রাতে ঘুমোতে পারিনি। মনে হয়েছিল অঞ্জনদার টুঁটি চেপে ধরি। মনে হয়েছিল, লোকটা এই রোলটা আমায় না দিয়ে নিজে করে নিল। আমি করলে ওর মতো করতে পারতাম না, কিন্তু লোভ হয়েছিল সাংঘাতিক।

পত্রিকা: বুঝলাম। আজকে ইন্ডাস্ট্রিতে একটা অদ্ভুত বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে। সবাই সবার ফিল্মের প্রশংসা করছে, বিকেলে অনেক পরিচালক বারিস্তায় বসে আইডিয়া এক্সচেঞ্জ করছে। রাত পর্যন্ত সিনেমার আড্ডা হচ্ছে। এই সব একত্রিত হয়ে, একটা ফোর্স হয়ে বাংলা ছবির কাজ করতে চাওয়াটা আপনি কি ভাবে দেখেন?
প্রসেনজিৎ: কী ভাবে এরা সবাই একত্রিত হবে বলুন তো? কী ফোর্সের কথা বলছেন ? ব্ল্যাকবেরি মেসেঞ্জারের বন্ধুত্ব? আপনি কি আপনার বিবিএম বন্ধুদের কাছ থেকে বাহবা পাওয়ার জন্য ছবি বানাচ্ছেন নাকি? আমি ওই নীতিতে বিশ্বাস করি না। আপনার ছবির প্রিমিয়ারে গিয়ে ছবি তুললে আপনার ছবি বেশি চলবে এটা ভুল ধারণা। কী করে যে আপনারা একত্রিত হয়েছি ভাবেন? ইউনিটি অন্য জিনিস। ইউনিটি সবাই মিলে টেকনিশিয়ান স্টুডিয়ো বাঁচানোর জন্য মহাকরণে পৌঁছে যাওয়া। বিবিএম কি ফেসবুকে ইউনিটি হয় না। বিবিএম-ফেসবুকে কে কী বলল, তা দিয়ে ছবি হিট করানো যায় না। যারা ভাবে এটা করা যায়, তারা বোকা।

পত্রিকা: আপনার আগের ছবি ‘বিক্রম সিংহ’ ফ্লপ হওয়ার পর অনেকে আপনাকে নিয়েও ফেসবুক কি বিবিএম-য়ে নেতিবাচক আলোচনা করেছিলেন। বলেছিল বুম্বাদা’র উচিত শুধু ‘মনের মানুষ’, ‘অটোগ্রাফ’-এর মতো ছবি করা...
প্রসেনজিৎ: জানি করেছিল। আর তার মানে আপনি স্বীকার করছেন তো যে বিবিএম-য়ে নেতিবাচক আলোচনা হয়। তা হলে আর কীসের ইউনিটি? আসলে একটা জিনিস বড্ড বেশি চোখে পড়ছে, আজকাল ইন্ডাস্ট্রিতে বড্ড বেশি ব্যক্তিগত সম্পর্কের জেরে কাজ হচ্ছে। আরে কাজের জায়গায় কি বন্ধুত্ব হয় নাকি? তুমি আমার ভাল বন্ধু তা হলে তোমাকে আমি প্রডিউসার ধরিয়ে দেব, তুমি আমার বন্ধু তা হলে তুমি আমার হিরোইন।
ধূর, এ ভাবে চলে নাকি? আর কী বলুন তো, কারও কাউকে খারাপ বলার অধিকার নেই। খারাপ বললেই যেন আপনি শত্রু হয়ে গেলেন।

পত্রিকা: আপনিও কি তা হলে অনেকের শত্রু হয়ে গেছেন স্পষ্ট কথা বলে?
প্রসেনজিৎ: শত্রু হয়েছি কিনা জানি না, কিন্তু কাউকে তো সত্যি কথাটা বলতে হবে। আমি পার্টি করব, আনন্দ করব, সব ঠিক আছে, কিন্তু সেটা স্টুডিয়োর বাইরে। সন্ধেবেলায়। স্টুডিয়োর ভেতরে তুমি আমার বন্ধু বলে কোনও কাজ পাবে না। ওখন শুধু উল্টোটাই হচ্ছে। আর যেটা দরকার তা হল কাজে আরেকটু মন দেওয়া। বিবিএমএ চ্যাট করব, কিন্তু সেটা কাজের পরে। এখন তো দেখি কাজের মধ্যেই সব বিবিএম, ফেসবুক করছে। ভাই এটা তো কাজের জায়গা। শুনেছি এসব প্রশ্ন করি বলে অনেকে আমার সম্পর্কেও নানা কথা বলছে নানা জায়গায়।

পত্রিকা: আপনার কানে আসে আপনার সম্বন্ধে কে কী বলল?
প্রসেনজিৎ: হ্যাঁ, সব কানে আসে। যারা করে তারা বোঝে না আমি তিরিশ বছর এই লাইনে আছি।

পত্রিকা: ‘বিক্রম সিংহ’ ফ্লপ করেছিল কেন?
প্রসেনজিৎ: দু’টো কারণ। দর্শক বোধহয় এখনও আমায় সেই রকম ভাবে মেনে নিচ্ছে না। আমি বাস্তববাদী, তাই আগামী বছর সে রকম ছবি করতেও চাই না। দ্বিতীয় কারণ এ বছর জুন মাসে যে পরিমাণ গরম পড়েছিল বাংলায়, সেই গরমে ফ্যানের নীচে বসে বদ্ধ জায়গায় সিনেমা দেখা সম্ভব নয়। এই দু’টো কারণেই চলেনি।

পত্রিকা: আচ্ছা, কোনও দিন এটা আপনাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি। আনিরুদ্ধ রায় চৌধুরীর ‘অপরাজিতা তুমি’ চলল না কেন? কী সমস্যা ছিল ছবিতে?
প্রসেনজিৎ: দেখুন, টোনি স্ক্রিপ্ট নিয়ে কাজ করে না। টোনির বোঝা উচিত ওকে এবার একটা স্ক্রিপ্ট নিয়ে কাজ করতে হবে।

পত্রিকা: মানে? ‘অপরাজিতা তুমি’র কোনও চিত্রনাট্য ছিল না?
প্রসেনজিৎ: না। বড় বেশি ইমপ্রোভাইজেশন হয় ওর সেটে। আর তা ছাড়া, টোনি টার্গেট অডিয়েন্সটাও ঠিক করতে পারেনি। তুমি ‘বাইশে শ্রাবণ’-এর পর আমার ছবিতে আমাকে যদি ডায়ালগ না দাও দর্শক নেবে কেন ছবি? ‘অপরাজিতা তুমি’ কিন্তু ‘সিলসিলা’ হতে পারত। আর যদি বাজেট ঠিকঠাক হত তা হলে হয়তো ব্রেক-ইভ্ন-ও করত। কিন্তু টোনিকে শেষ করে দিল ‘বাইশে শ্রাবণ’। সত্যি বলতে, আমাদের সবারই বোঝার ভুল ছিল। টোনি বানালো ‘অটোগ্রাফ’-এর দর্শকদের ছবি, আর ভাবল ব্যবসা হবে ‘পাগলু’র মতো। সেটা তো হতে পারে না। ‘অপরাজিতা তুমি’ সাধারণ দর্শকের ছবি ছিলই না। কিন্তু তা-ও বলছি, আজও এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে বসে থাকলে লোকে এসে বলে ‘অপরাজিতা তুমি’ আমার জীবনের সবচেয়ে কাব্যিক ছবি। আর আমি নিজেও বিশ্বাস করি রীনাদি, ঋতুদা’দের স্টাইলটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা একমাত্র টোনির আছে। টোনিকে শুধু ওর চিত্রনাট্য আর বাজেটে আরও মনোযোগ দিতে হবে। সেদিক থেকে আমার সুমন মুখোপাধ্যায়কে খুব ভাল লাগে। ওর চিন্তাভাবনা পরিষ্কার। ওর সিনেমা কত টাকা বানালো, সেটাকে ও পাত্তাই দেয় না। বাপ্পাদিত্য, অতনু ঘোষদের একটা বিশ্বাস আছে। বিরসার ‘০৩৩’-কেও আমি সাপোর্ট করেছিলাম। অনেকে বলেছিল ছবিটা তেমন কিছু নয়, কিন্তু আমার মনে হয়েছিল আমার পরের প্রজন্মের পরিচালকদের যদি আমি সাপোর্ট করি তা হলে আমিও ততোধিক ভাল কাজ করতে পারব। কিন্তু জানি না বীরসার কী হল? আমার মনে হয়েছে সিনেমা নিয়ে বীরসা, অতনু এত পড়াশুনো করে ফেলেছে যেটা ওদের ছবি বানানোটাকে ডিকটেট করছে। সেটাই সমস্যা। সেদিক থেকে সৃজিত কিন্তু উল্টো। ও শুধু বক্স অফিসে জিততে চায়।

পত্রিকা: ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-এর সাফল্য নিয়ে কী বলবেন?
প্রসেনজিৎ: খুব ইন্টারেস্টিং লেখা। একটা অদ্ভুত বাঙালিয়ানা আছে। আমাদের বুঝতে হবে, অনেক বছর ধরে আমরা বাঙালিদের সরাতে শুরু করেছিলাম আমাদের ছবি থেকে। তাই একটু বাঙালিয়ানা দেখলেই বাঙালিরা ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এটা কী রকম বলুন তো? একমাস পর বিদেশ থেকে ফিরলে আপনি যে ভাবে ডাল-ভাত খান, এটাও সেই মানসিকতা। ‘অটোগ্রাফ’, ‘বাইশে শ্রাবণ’, ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-য়ে বাঙালিরা সেই বাঙালিয়ানাটা ফিরে পেয়েছে। তাই কব্জি ডুবিয়ে খেয়েছে।

পত্রিকা: শুনেছিলাম ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-এর আইডিয়ার পেছনে আপনার হাত ছিল। অনীক দত্তের একটা বড় গল্প থেকে এই অংশটুকু শুনে আপনি নাকি বলেছিলেন এই আইডিয়াটাকেই বাড়িয়ে নিয়ে একটা সিনেমা বানাতে?
প্রসেনজিৎ: অবশ্যই বলেছিলাম। অনীক একটা চিত্রনাট্য নিয়ে এসেছিল। নামটা মনে নেই। ‘অপদার্থ’ না কী একটা। সেই ছবিটায় একটা সাবপ্লট ছিল এই ভূতের বাড়িতে ভূতেদের নিয়ে গল্পটা। আমি ওকে সেটাকেই ডেভেলপ করতে বলেছিলাম। অনীকের হয়তো মনে থাকবে, ওর ছবি মুক্তির দিন প্রিন্ট পৌঁছচ্ছিল না সিনেমা হলে। আমি তখন মুম্বইতে। রাত ১১টা পর্যন্ত ওকে ফোন করে জানছিলাম সব ঠিক আছে কি না। আর কেউ ওকে ফোন করেছিল কি না কে জানে?

পত্রিকা: শোনা যাচ্ছে, আপনি মুম্বই শিফ্ট করছেন?
প্রসেনজিৎ: না, না। শিফ্ট আমি করব না। ওখানে একটা বেস বানাচ্ছি। কারণ ‘সাংহাই’-এর পর অনেক অফার আসছে।

পত্রিকা: শোনা যাচ্ছে সুজিত সরকারের পরের ছবিতে আপনি রাজীব গাধীঁর চরিত্রে অভিনয় করছেন?
প্রসেনজিৎ: না। ছবিটার নাম যেহেতু ‘জাফনা’, তাই হয়ত এই খবরটা চাউর হয়েছে। সেটা ঠিক নয়। তবে এটা দারুণ একটা ইন্টারেস্টিং ছবি। আমার চরিত্রটা একজন মালয়ালির, আর ছবিটা এলটিটিই-র ওপর। ছবিতে স্রেফ দু’টোই প্রধান চরিত্র। একজন জন আব্রাহাম। অন্যজন আমি। জন তো দেখলাম মুম্বইয়ের ফিল্ম ম্যাগাজিনগুলোতে বলেওছে, আমার সঙ্গে কাজ করতে পেরে ও খুব খুশি। বেশ বুঝতে পারছি ‘সাংহাই’ এর পর মুম্বই আবার অভিনেতা প্রসেনজিৎকে খুঁজছে। আর সুজিতও ব্রিলিয়ান্ট প্রযোজক ও পরিচালক।

পত্রিকা: এ ছাড়া আর কী কী অফার পাচ্ছেন?
প্রসেনজিৎ: অনুরাগ কাশ্যপ সে দিন ফোন করেছিল। ও আমাকে নিয়ে একটা ছবি প্ল্যান করছে। আনুরাগ বসুর সঙ্গে কথা চলছে। ‘রা ওয়ান’-এর পরিচালক অনুভর সিংহ-ও একটা দারুণ চিত্রনাট্য শোনাল সেদিন। এক্ষুনি পরিচালকের নাম বলতে পারছি না কিন্তু আমাকে আর মাধুরী দীক্ষিতকে নিয়েও একটা ছবির প্ল্যান হচ্ছে।

পত্রিকা: আপনি তো সহারার বাংলা ছবি প্রযোজনার সংস্থা, সহারা স্ক্রিনেরও প্রধান হয়েছেন।
প্রসেনজিৎ: হ্যাঁ, ওদের বড় চিন্তাভাবনা আছে বাংলা ছবি নিয়ে। দেখুন সহারা স্ক্রিন, সহারা গ্রুপের একটা নতুন কোম্পানি। সেটার বোর্ড অফ ডিরেকটরসে আমি আছি। আমার ইচ্ছে কলকাতায় বসে ভাল হিন্দি ছবি বানানো। যেমন সুজয় করেছিল ‘কহানি’তে। আর তা ছাড়া বাংলা ছবি করাটা তো আছেই। সুজয় (ঘোষ)-এর সঙ্গে কথা হচ্ছে। অঞ্জনদা’র সঙ্গেও এর মধ্যে মিটিং করব।

পত্রিকা: আর আপনার স্ত্রী, অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়ও তো সহারার সর্বভারতীয় ফিল্ম প্রযোজনা সংস্থাটির প্রধান এখন। তার মানে সেটাতেও আপনার মতামত আর অভিজ্ঞতা কাজে আসবে।
প্রসেনজিৎ: হা, হা, হা... না, না, সে রকম কিছু নয়। সুব্রত রায়ের পরিবারের কাছে অর্পিতা মেয়ের মতো। সহারা একটা নতুন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম বানাচ্ছে, সেটারই একটা দায়িত্বসম্পন্ন পদে অর্পিতা জয়েন করছে। আর যেহেতু অর্পিতা ওঁদের পরিবারের অংশ, ওঁদেরও এটাই ইচ্ছে ছিল যে প্রযোজনার কাজটা পরিবারের কোনও সদস্য দেখুক। তাই জন্যই দায়িত্বটা অর্পিতাকে দিয়েছেন। অর্পিতা সিনসিয়ার, ও সিওরলি দারুণ কাজ করবে। ওর এলাকায় আমার প্রবেশ নেই। আমি কিছু না, আমি ছোট মানুষ। (হাসি)

পত্রিকা: আবার সেই বিনয়?
প্রসেনজিৎ: দূর, দূর! ছোট মানুষ হয়ে থাকাই ভাল। উড়ে লাভ নেই...

পত্রিকা: কাদের মতো উড়ে লাভ নেই?
প্রসেনজিৎ: আমাদের মতো। বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির মতো। আগে বলছিলাম না, স্বপ্ন যেদিন ভেঙে যাবে আর কিছু ধরার থাকবে না। ইন্ডাস্ট্রি শুধু উড়ছেই না, দেখে ভয় লাগছে যে ওরা বিচ্ছিরি ভাবে উড়ছে। যে দিন মুখ থুবড়ে পড়বে, দেখবে কোনও নির্জন দ্বীপে গিয়ে পড়েছে। এটাই আমার সবচেয়ে বড় আতঙ্ক।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.