সিনেমা সমালোচনা...
বাদুড় বলে ওরে ও ভাই শজারু
লো পড়ে এসেছে একটু তাড়াতাড়ি। বিকেল-সন্ধ্যা সব এলোমেলো করা মেঘ আর রাস্তা ভেজানো একঘেয়ে বৃষ্টি। গাড়ির ভেতরটা, আমার জামাটা, মনটা সব স্যাঁতসেঁতে লাগছে। আমি আর পুত্র উজান পৌঁছোলাম দক্ষিণ কলকাতার এক মাল্টিপ্লেক্সে। আমরা দু’জনেই উদগ্রীব। আমার সামনে ক্রিস্টোফার নোলান আর ওর সামনে ব্যাটম্যান। হলে একটাও চেয়ার খালি নেই। আলো কমে এলো। অন্ধকার বাইরের থেকেও গাঢ় তখন। নিজের মুখে ক্যারামেল পপকর্নের দুমড়োনোর আওয়াজটাও অবান্তর লাগছে। তারপর শুরু ‘দ্য ডার্ক নাইট রাইজেস’। দু’ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট আমার হাতঘড়ি এত দ্রুত কোনও দিন ছোটেনি। মন্ত্রমুগ্ধ ৫০০ জন কখনও হাততালি, কখনও মুখের অর্থহীন শব্দে, কখনও সবাই একসঙ্গে শ্বাস ফেলা বন্ধ করে—তৈরি করছে একটা অদ্ভুত পরিবেশ।
ইচ্ছে করছে এখনই গল্পটা গড়গড় করে বলে দিই। যে ছবির আগে- পরে নিয়ে লেখার কিছু থাকে না, সেই সব ছবির আলোচনা গল্পটা অনেকটা লিখে দু’তিন কলম ভরে দেওয়া যায়। এই ছবিতে নয়। তাই গল্পটা জাস্ট এক লাইনে বলব—“গোথাম সিটি আমেরিকা, ধ্বংস হয়ে যাবে। ব্যাটম্যান খবরটা পেয়ে পারবে বাঁচাতে আমেরিকাকে?” ব্যাস। বাকিটা এই লেখা পুরোটা পড়ার পর ঠিক করবেন জানতে চান কি না, বিস্তারিত।
৯/১১! চোখের সামনে টুইনটাওয়ার উড়িয়ে দিল আতঙ্কবাদীরা! টিভিতে খেলার মতো লাইভ টেলিকাস্ট দেখলো পৃথিবী। মার্কিন তুখড় নিরাপত্তা হাঁদার মতো চেয়ে রইল আর সাইরেন বাজাল, ছুটল।
এত বড় একটা চক্রান্ত ওই দেশের বুকে বসেই তৈরি হল, কেউ টের পেল না! এত ঢিলে তো এদের নিরাপত্তা নয়। অন্তত এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশনে ওদের আচরণ দেখে তো মনে হয় ছারপোকাও গলতে পারবে না। তবে? চিরকাল কেন তবে আমেরিকা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে উগ্রপন্থীদের নকশার জালে? আসলে মার্কিন নিরাপত্তা বাহিনীর মূল অস্ত্র কোনও দিনই বাস্তব বিপদের দিনে পাশে এসে সাহায্য করেনি। ওই একটা লোক দয়া করলে আজও অন্তত ম্যানহাটানের স্কাইলাইনটা একই রকম থাকত। লোকটা একাই একশো। অথচ সিনেমা ছাড়া, বাইরে কোথাও আমেরিকার বিপদে সে এক পাও নড়ে না। অভিযুক্তের নাম ‘ব্যাটম্যান’।
দ্য ডার্ক নাইট রাইজেস
ক্রিস্টিয়ান বেইল, অ্যান হ্যাথওয়ে, টম হার্ডি
ক্রিস্টোফার নোলান এই সংকটের সময় কেবলমাত্র গ্রাফিক্স-অ্যাকশন আর টেকনোলজির খেল দেখাবার পাত্র নন। মানুষের মস্তিষ্কের বহু স্তর পেরিয়ে তার মেধা অসম্ভব এক অনুভূতির স্তরে পৌঁছে দেয়। সেই নোলান যেন যথাযথ সময় ‘মার্কিন রূপকথা’ তৈরি করে ঝাঁকিয়ে দিলেন পেন্টাগনের সারা বাড়িটাকে। ব্যাটম্যান ছাড়া অসহায় এক আমেরিকার অন্ধকার জগতের হাড়হিম করা এই গল্পে আসল ব্যাটম্যান ক্রিস্টোফার নোলান।
অর্থনীতি বিপর্যস্ত। সারাক্ষণ মনে ভয়। দাড়ি কেটে ফেলছে মানুষ বাড়তি প্রশ্ন এড়াতে। বাড়িতে বাড়িতে ঝুলছে ‘ফর সেল’ বা ‘হাউজ অন রেন্ট’ বোর্ড। এয়ারপোটের্র্ গাড়ি পার্ক করে পালিয়েছে শয়ে শয়ে মানুষ, শুধুমাত্র দেনার চাপে।
নিউ ইয়র্কের মেয়র মাইকেল ব্লুমবার্গ তো বলেই ফেললেন, “মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে দু’জন মানুষ খুব হাততালি পাচ্ছেন। তারা কি একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন? কোন সভ্য দেশে এরকম আতঙ্ক আছে? কোন সভ্য দেশে মানুষের চেয়ে বন্দুকের সংখ্যা বেশি?”
জেমস্ হোমস্ এই ছবির প্রিমিয়ারে ডেনভার শহরে কী কাণ্ডটা ঘটালো! একটা ব্যাকপ্যাক নিয়ে দিব্যি ঢুকে গেল হলের ভেতর! অসম্ভব মেধাবী এই ছাত্রটির মস্তিষ্ক হয়তো নোলানের পরের ছবি, কিন্তু ১২ জন মৃত, অনেকেই লড়াই করছে মৃত্যুর সঙ্গে। ২৪ বছরের এই জেমস হোমস কি বাস্তব আমেরিকার বেন?
‘গোথাম সিটি’ শেষ করে দেওয়ার প্ল্যান বেন-এর। অন্ধকূপে তার জন্ম। লজ্জায় অপমানে নাক কাটা গেছে বহু দিন। বিশেষ মুখোশ পড়ে শ্বাস নেয় বেন। সে শক্তিশালী, নিষ্ঠুর, ভয়ানক। ব্যাটম্যানকেও পিষে ফেলতে পারে সে। মুখোশের আড়াল থেকে অদ্ভুত কণ্ঠস্বর কখনও কখনও বেশ অস্পষ্ট লাগে। তবে ভয় লাগে। বেন হাডসন ব্রিজের মতো একাধিক ব্রিজ ধ্বংস করে, নদীর মতো দর্শকেরও রক্ত জমে যেতে থাকে।
ব্যাটম্যানের বয়স্ক বাটলার একদম রাজি নয় যে ধনী ব্রুস ওয়েন আবার ওই বাদুড়ে পোশাকে ঢুকে বিপদের মুখে পড়ুক। ওয়েন এন্টারপ্রাইজের এই বিলিওনেয়ার মালিক জীবন বিপন্ন করে লড়বে বাটলার চান না। পিতা পুত্রের মতো একান্ত মুহূর্তগুলো অসামান্য।
তাই বাটলার মাইকেল কেন্-এর কথা প্রথমেই না বললে অন্যায় হবে। ব্যাটম্যান হিসেবে ক্রিস্টিয়ান বেইল তুখড়। কিন্তু এক জন পর্দায় এলেই আর আমার ব্যাটম্যানের দিকে মন যায়নি। হয়তো নোলানেরও যায়নি। তাই একটা পক্ষপাত নিয়েই স্কোরবোর্ডে ব্যাটম্যানের থেকে দু চার গোলে এগিয়ে যায় সে। উফ্! অ্যান হ্যাথওয়ে। ক্যাট উওম্যান সে। তবে এত সুন্দর বেড়াল বা সুন্দরী বহু দিন দেখিনি। ভাগ্যিস হ্যাথওয়ে কোনও দিন ভারতীয় ছবি করতে রাজি হবেন না। নইলে নায়ক পাওয়া মুশকিল হত। যেমন অভিনয় তেমনি পর্দায় উপস্থিতি। বাইক থেকে পা মাটিতে রাখছে অ্যান হ্যাথওয়ে! মনে হচ্ছে আইফেল টাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে উপরটা দেখার বৃথা চেষ্টা করছি। সৌধ! মরগান ফ্রিম্যান হলিউডের ইফতেকার সাহেব। মোটামুটি একই রকম দক্ষতায় একই ধরনের চরিত্রে তিনি নিখুঁত। আর আছেন ম্যারিওন কটিলার্ড। আর এক সুন্দরী। মহিলা অভিনেতাদের মধ্যে এই ছবিতে ইনি সেরা। কেন সেরা, বা কী কী ঘটনার প্রেক্ষিতে কথাটা বললাম তা উহ্য থাক। তবে এই ছবির বিরাট চমক ম্যারিওন।
মন কেড়ে নেওয়া চরিত্র রবিন। কেবলমাত্র ওকে দেখার জন্য আমি ছবিটা দু’বার দেখতে রাজি।
স্পেশাল এফেক্টস কী উচ্চতায় যেতে পারে তার নিদর্শন কেবল এই ছবিটাই নয়। ‘ইনসেপশান’ আগেই মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল। নোলান যেখানে আলাদা হয়ে যান অন্যদের থেকে, সেটা তার যন্ত্রের বাহুল্য আর একাকীত্বের যুগলবন্দিতে। ধুন্ধুমার অ্যাকশন দৃশ্যের পরই নির্জন প্রাসাদে ব্রুশ ওয়েইন-বাটলার বা ব্রুশ ওয়েইন—ক্যাট! চোখ সরানো যায় না।
বিশ্বাস আর বিশ্বাসভঙ্গ এই দুই সুতোয় বাঁধা এই ছবি। চিত্রনাট্য এতটাই দক্ষতার সঙ্গে বাঁধা একটা ধাপও আগে থেকে কল্পনা করে স্বস্তি পাওয়া যাচ্ছে না।
এ গল্পে নির্বাসন এক অন্ধকূপে। যত দূর জানি শু্যটিং হয়েছিল রাজস্থানেই। অথচ ছবির স্বার্থে নোলান স্বভাবত এক ভিন্ন ভাষার ব্যবহার করেছেন যা আদৌ ভারতীয় নয়। বরং বলা যায় আরবি ঘেঁষা। খলনায়ক বেনের গুরুর নামটাও যেন সের’ম সের’ম লাগল।
মনে হয় ভুল শুনিনি। বা বুঝিনি। বন্দুকধারীদের তালিমের আবহ হয়তো ওই রকম ধ্বনিতে বা ভাষার আঙ্গিকে হলেই মার্কিন দর্শকদের রক্ত ভয়ে কনকনে হয়ে ওঠে। তবে জানি না কেন অন্ধকূপের চরিত্রগুলো অদ্ভুতভাবে মনের গভীরে হাতের ছাপ রেখে যায়। সেই অন্ধকারে বেন নির্বাসন দিয়েছে অনেক প্রভাবশালীকে, অনেক ভাল মানুষকে, এমনকী ব্যাটম্যানকেও! ব্যাটম্যানের আর পালাবার কোনও পথ নেই। আমি একটু এলোমেলো, সমান্তরাল ভাবনা ভালবাসি। তাই হয়তো ওই অন্ধকূপটা দেখে, ওই লোকগুলোর পোশাক, মুখ, দৃষ্টি, ভঙ্গি, আর্তি দেখে হঠাৎ নির্বাসিত চিত্রপরিচালক জফর পনাহির জন্য গলা বুজে এলো। ওঁদের দেশে ব্যাটম্যান, ক্যাটওম্যান নেই। তাই জফর গোপনে বানান, ‘দিস ইজ নট এ ফিল্ম’।
বিশ্বব্যাপী আতঙ্কের বাতাবরণের এপিসেন্টার হল আমেরিকা। তাই রূপকথার খাতিরে শহরের নাম ‘গোথাম’ সিটি। শু্যটিং হয়েছে নানা শহর ঘুরে। কখনও লস অ্যাঞ্জেলিস দেখলাম, কখনও নিউ ইয়র্কের রাস্তা, টাইম স্কোয়্যার, ওয়াশিংটন! নানা শহরের অংশ জুড়ে তৈরি হওয়া ‘গোথাম’ সিটিতে পতাকা একটাই। মার্কিন পতাকার ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন আর্তি আর সব শহরের কোলাজে তৈরি গোথাম সিটি একটা সামগ্রিক বড় আতঙ্কের কথা বলে। একদম গোদা একটা রূপকের মতো সামনে রেখে নোলান ভয়হীন, আতঙ্কমুক্ত এক আমেরিকার স্বপ্ন দেখিয়েছেন।
আর ঠিক সেখানেই তিনি ছবিটাকে সম্পূর্ণ এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যান।
স্কুলবাসে বন্ধ একদল বাচ্চা জানালার কাছে অসহায়ের মতো মৃত্যুর অপেক্ষায়। যে কোনও মুহূর্তে শেষ হয়ে যাবে গোথাম সিটি। আবহতে ভেস্ ওঠে প্রার্থনার মতো ভাষ্য। সে বলে “শহর ও শিশুদের মুখ চেয়ে ভয়মুক্ত হোক, মুক্ত হোক অযথা রক্তক্ষরণ থেকে। আসুক বিশ্বাস, বাড়ুক প্রেম। মানববন্ধনে আরও বাসযোগ্য হয়ে উঠুক এই দেশ।” এই চূড়াম্ত কামনার, প্রার্থনার অজুহাত এই সিনেমা। দুষ্কৃতীর দমনে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটাতে একটা আস্ত মহাভারত লেখা হয়ে গেল,
বিনাশায় চ দুষ্কৃতম
ধর্ম সংস্থাপনার্থায়......সম্ভবামি যুগে যুগে...

একই মন্ত্র ইংরেজিতে তর্জমা করলেই হয়ে যাবে ব্যাটম্যানের অভয়বাণী! তখনই ক্রিস্টোফার নোলানের এই মহাভারত বানানোর মূল উদ্দেশ্যটা আর আড়াল থাকে না। যুদ্ধ ব্যবসায়ীর মুলুকে আজ ‘বিন’ বা ‘বেন’ হঠাৎ যে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন হয়ে উঠবে এ আর এমন কথা কি। শেষ পাতে পাণ্ডব কৌরবদের বা রাম রাবণকে ধ্বংস না করলে রাতের নিশ্চিন্ত ঘুম আসবে কেন? তাই নোলান যা যা বিপদ ছিল সব ধ্বংস করলেন শেষ পর্বে। সারা গোথাম সিটি মুক্তির আনন্দে ফেটে পড়ল আনন্দ চিৎকারে। ধ্বংস হয়ে গেল সমুদ্রের বুকে পারমাণবিক বোমা। বিশাল ধোঁয়ার ছত্রাক সারা আকাশ জুড়ে বাড়তে থাকল দৈত্যের মতো। ছেলে ভুলোনো গল্পে রেডিয়েশন বা অ্যাসিড বৃষ্টির রসভঙ্গের কোনও দাম নেই। তাই হল জুড়ে হাততালি। পর্দার মার্কিন আনন্দ উৎসবের আবহের সঙ্গে মিশে সেই সন্ধ্যার মতো নটেগাছটি মুড়িয়ে রাখল। বিশ্বময় বিপন্মুক্ত শান্তি। বিন তো আগেই মরেছে এবার বেন-ও গেল।
বাইরে বেরিয়ে দেখি পরের শোটাও ফুল। উজান ছুটল উল্টো দিকের দোকানে ব্যাটম্যানের কী একটা খেলনা দেখেছে, ওটা কিনতে। কী উন্মাদনা! আমি স্পষ্ট দেখলাম কলকাতার মানুষরাও ধরা দিয়েছে নোলান সাহেবের ইন্দ্রজালে। নোলান জানেন ভয়, আতঙ্ক আজ বিশ্বব্যাপী। এটাও উনি জানেন সবার কাছে ব্যাটম্যান থাকলে অন্তত মনে, আর চিন্তা কী? ঈশ্বরও তাই। আছেন জেনে, না দেখেও কত শান্তিতে পুজো দিই আমরা। পারমাণবিক যুদ্ধ যুগের ঈশ্বর তাই ব্যাটম্যান।
উজানের ব্যাটম্যানের পুতুলটা পছন্দ হল না। বিরক্ত। হাত ভাঁজ হয় না। মাথাটা ঘোরে না।
কোমরের পর থেকে পা-টা ভাঁজও হয় না! ধ্যুৎ! বড় হয়ে যাচ্ছে ও।
হিপ পকেট থেকে পার্সটা বের করে একবার টাকাটা দেখে নিয়ে বললাম, “ডিনারে চাইনিজ খাবি?” মুখ বদলে গেল ওর। পাশাপাশি বসে গাড়িতে, বাড়ি ফিরছি। তখনও বৃষ্টি চলছে। রাস্তায় ভেজা আলো। আমার গা ঘেঁষে ঠেস দিয়ে বসে আমার মোবাইলটা নিয়ে কী সব করছে। কী নিশ্চিন্ত, কী তৃপ্ত ও। বাবা জানে ওর মনের কথা, সব ইচ্ছে। বাবার হাত ভাঁজ হয়, মাথাটা ঘোরে, কোমরের পর থেকে পাও ভাঁজ হয়। যেমনটা সে চায়। সব বাচ্চার আসল ব্যাটম্যান তার বাবা!
থ্যাঙ্ক ইউ মিস্টার নোলান।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.