|
|
|
|
বেশি ব্যবহারে দাম আদায়ের প্রস্তাব
|
|
কেন্দ্রের চাপে এ বার জল-কর
নিয়েও অবস্থান বদল রাজ্যের
অত্রি মিত্র • কলকাতা |
|
দুধ, বিদ্যুতের পরে এ বার জল।
নাগরিকদের পরিস্রুত জল জোগানোর মূল্য আদায় না-করার ‘নীতি’ থেকে কিছুটা সরে আসার ইঙ্গিত দিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। সম্প্রতি যারা বেহাল আর্থিক অবস্থার চাপে পড়ে ঘুরপথে হলেও বিদ্যুৎ ও দুধের দাম কিছুটা বাড়াতে বাধ্য হয়েছে, বাড়িয়েছে ট্যাক্সির নৈশ-ভাড়াও। এখন দিল্লিতে পেশ করা জল-কর সংক্রান্ত রাজ্যের নতুন নীতিতে বলা হয়েছে, পুর-এলাকায় বাণিজ্যিক সংস্থা ও অফিস-বাড়ি ছাড়াও ‘বেশি পরিমাণ’ জল ব্যবহারকারী গৃহস্থের থেকেও তার দাম আদায় করা হবে। অর্থাৎ সরকারি জল-পরিষেবারও মূল্য চোকাতে হবে।
নীতিটা অবশ্য ‘নতুন’ কিছু নয়। প্রশাসনিক মহলের একাংশের দাবি, এ ক্ষেত্রে কার্যত পুরনো কথাই ‘নতুন ভাবে’ বলা হয়েছে। মহাকরণ-সূত্রের ব্যাখ্যা: বিগত বাম জমানায় জল-কর আদায়ের এই নীতিই বহাল ছিল। বাম আমলের পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যও বলেন, “সম্পত্তি-করের ধাঁচে জলের কর নেওয়ার নীতি তৈরি হয়েছিল। তা বিধানসভায় পেশও হয়।” কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গোড়া থেকেই জল-করের বিরোধী। সুব্রত মুখোপাধ্যায় মেয়র থাকাকালীন কলকাতায় জল-কর বসাতে উদ্যোগী হলেও তৃণমূল নেত্রীর আপত্তিতে শেষ পর্যন্ত তাঁকে পিছিয়ে আসতে হয়। রাজ্যে ক্ষমতায় এসেও মমতা জানিয়ে দেন, কারও থেকে জল-কর নেওয়া হবে না।
এখন আচমকা অবস্থান পাল্টাল কেন? সরকারি মহলের একাংশের দাবি, প্রশাসনিক বাধ্যবাধকতার পাশাপাশি কেন্দ্রের ‘চাপও’ কিছুটা কাজ করেছে। গত ১৭ জুলাই নয়াদিল্লিতে জওহরলাল নেহরু ন্যাশনাল আরবান রিনিউয়াল মিশনের (জেএনএনইউআরএম) কেন্দ্রীয় অনুমোদনকারী ও নজরদারি কমিটির বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গের ‘অবস্থান’ সম্পর্কে অসন্তোষ প্রকাশ করেন কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন-সচিব সুধীর কৃষ্ণ। তাঁর অভিযোগ ছিল, এই মিশনের বিভিন্ন প্রকল্প থেকে যে পরিষেবা দেওয়া হচ্ছে, তার খরচ ওঠানোয় রাজ্যের বিশেষ গা নেই। অন্তত জল-কর আদায়ের সুস্পষ্ট রূপরেখা না-পাওয়া পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গকে আর কোনও প্রকল্প-অর্থ মঞ্জুর করা হবে না বলে বৈঠকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন তিনি।
আর তার পরেই রাজ্য নড়েচড়ে বসে। সরকারি এক কর্তার কথায়, “জুলাইয়ের শেষাশেষি জল-কর নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের ‘পরিবর্তিত অবস্থান’ মন্ত্রককে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।” আগের মতো নতুন নীতিতেও সাধারণ মানুষের থেকে জল-কর না-নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ‘বেশি পরিমাণ জলের’ মাত্রা নির্ধারণের ভার ছাড়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট পুরসভার উপরে।
জল ব্যবহারকারী এক শ্রেণির নাগরিককে করের আওতা থেকে বাদ দেওয়ার লক্ষ্যে এই ‘রূপরেখা’ কেন্দ্র কতটা মানবে তা নিয়ে অবশ্য ধোঁয়াশা রয়েছে। সুধীর কৃষ্ণ বলেছেন, “করের হার কম-বেশি হলেও আমরা সাধারণত সকলের থেকেই কর নেওয়ার পক্ষপাতী। পশ্চিমবঙ্গের প্রস্তাব খতিয়ে দেখে ঠিকঠাক বলতে পারব।” কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেতা সৌগত রায়ের অবশ্য দাবি, “রাজ্যের প্রস্তাব মানতে কেন্দ্রের অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। কারণ, রক্ষণাবেক্ষণের খরচ ওঠাটাই আসল।” উল্লেখ্য, প্রকল্প রক্ষণাবেক্ষণের খরচ তুলতে রাজ্য একটা নতুন প্রস্তাবও দিয়েছে। জলশোধন প্রকল্পের বাড়তি জমিতে জল-নির্ভর বিভিন্ন সংস্থাকে কারখানা গড়তে বলা হবে। তাদের ব্যবহৃত জলের দাম মিললে প্রকল্প-ব্যয়ের অনেকটাই উঠবে বলে রাজ্য আশাবাদী। কিন্তু সংস্থাগুলি এই প্রস্তাবে আগ্রহী হবে কেন, তার ব্যাখ্যা মেলেনি।
বস্তুত প্রকল্প রক্ষণাবেক্ষণের অর্থের সংস্থান নিশ্চিত করতেই জল-কর আদায়ে কেন্দ্র এতটা জোর দিচ্ছে। মহাকরণের এক কর্তার কথায়, “জেএনএনইউআরএম নিয়ে রাজ্যগুলোর সঙ্গে কেন্দ্রের করা চুক্তির প্রাথমিক শর্তাবলির অন্যতম ছিল, জলের দাম নিতে হবে।” কেন্দ্রের যুক্তি, কোটি কোটি টাকা দিয়ে প্রকল্প গড়লেই শুধু হল না, তার উপযুক্ত দেখভালও জরুরি। সে জন্য জল-কর বসানো ছাড়া উপায় নেই। তা ছাড়া দাম দিয়ে জল নিলে অপচয়ের প্রবণতাও অনেকটাই কমবে।
তবে রাজকোষের সঙ্কটকালে ‘জনপ্রিয়’ রাজনীতি আঁকড়ে থাকলে পরিষেবাই যে ধাক্কা খাবে, তা বিরোধী, এমনকী সরকার পক্ষেরও অনেক নেতা একান্তে স্বীকার করছেন। এক বাম নেতার কথায়, “রেলের ভাড়া একেবারে না-নিলে তো জনগণের মন আরও জেতা যায়! তা কি বাস্তবে সম্ভব?” পাশাপাশি তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতার মন্তব্য, “অতীতে এ রাজ্যে ট্রামভাড়া এক পয়সা বাড়ায় আগুন জ্বলেছে। এখন বিরোধীরাই ভাড়াবৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করছে! অথচ সরকার ভাড়া বাড়াতে চাইছে না! আবার ভাড়া না-বাড়ালেও চলা কঠিন।”
খয়রাতির বেহাল জলসত্র, নাকি ন্যায্য মূল্যের উন্নত জল-পরিষেবা? নাগরিকদের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার কোনটা বরাদ্দ করে, সেটাই এখন দেখার। |
|
|
|
|
|