কঠোর হচ্ছে রাজ্য
ডাক্তার, হাসপাতালের দায় বাড়াতে আসছে নয়া ফরমান
চিকিৎসকদের ‘দায়বদ্ধতা’ নিশ্চিত করতে এ বার নতুন নির্দেশিকা জারি করতে চলেছে রাজ্য সরকার।
অকারণে যথেচ্ছ দামি পরীক্ষা, কথায় কথায় অস্ত্রোপচার, প্রচুর অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ এ রাজ্যে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগের অভাব নেই। প্রমাণের অভাবে যেগুলির নিষ্পত্তি হয় না বহু ক্ষেত্রেই। তাই নিয়ম আরও আঁটোসাঁটো করে চিকিৎসকদের দায়বদ্ধ করতে এ বার রাজ্যে চালু হচ্ছে স্ট্যান্ডার্ড ট্রিটমেন্ট গাইডলাইন। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের দায়বদ্ধতা নির্দিষ্ট করে দিতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিল। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের বক্তব্য, বেসরকারি হাসপাতালের উপরে নিয়ন্ত্রণ তৈরি করতে এটিই রাজ্যের প্রথম পদক্ষেপ। এর পর ধাপে ধাপে অন্যান্য ক্ষেত্রেও নিয়ন্ত্রণ শুরু হবে।
ক্ষমতায় এসে অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার স্বাস্থ্য উদ্ধারে উদ্যোগী হয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আচমকা হাজির হতেন কোনও সরকারি হাসপাতালে। তবে বেসরকারি হাসপাতালের উপরে নজরদারির কোনও ব্যবস্থা তখনও ছিল না। এক বছর পরে সেই তৎপরতা ফিকে হয়ে এসেছে। তা নিয়ে প্রশ্নের মধ্যেই এই প্রোটোকল চালুর চিন্তাভাবনা সরকারের। যা কিনা এ দেশে প্রথম বলে তাদের দাবি। এবং শুধু সরকারি নয়, যে প্রোটোকল দায়বদ্ধ করবে বেসরকারি হাসপাতালকেও।
মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে এই গাইডলাইন প্রকাশিত হবে মেডিক্যাল কাউন্সিলের ওয়েবসাইটেও। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে বলা হচ্ছে, শুধু চিকিৎসকদের ওয়াকিবহাল করাই নয়, ওই ওয়েবসাইট থেকে রোগীর পরিবারের লোক এবং আত্মীয়রাও যাতে সচেতন হতে পারেন এবং নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে পারেন, সে জন্যই এই ব্যবস্থা।
কোনও চিকিৎসক যদি নির্দেশিকা না মানেন? তা হলে তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে মেডিক্যাল কাউন্সিল। তাঁর রেজিস্ট্রেশন পর্যন্ত বাতিল করা হতে পারে। শুধু চিকিৎসকরাই নন, সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল বা নার্সিংহোমও যাতে নিজেদের দায় এড়াতে না পারে, সে জন্য ‘গাফিলতি’র ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবা হয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালের ক্ষেত্রে একাধিক বার এমন ঘটনা ঘটলে তাদের লাইসেন্স নবীকরণ না-ও হতে পারে বলে স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা জানিয়েছেন।
আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে এই নীতি চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। প্রাথমিক ভাবে স্থির হয়েছে, জেলা বা গ্রামীণ হাসপাতাল এবং শহরের হাসপাতালের জন্য পৃথক নির্দেশিকা তৈরি হবে। স্বাস্থ্যকর্তাদের বক্তব্য, রাতবিরেতে জেলা বা গ্রামীণ হাসপাতালে কোনও রোগী গেলে তাঁকে যে পরিকাঠামোর মধ্যে পরিষেবা দিতে হয়, তা কোনও ভাবেই শহরের মানের সঙ্গে এক হওয়া সম্ভব নয়। বিশেষত, গ্রামাঞ্চলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সব রকম সুযোগ তৎক্ষণাৎ পাওয়া সম্ভব হয় না। ওই পরিস্থিতিতে এক জন চিকিৎসক কী ভাবে তাঁর দায়িত্ব সামলাবেন, কী ভাবে পরীক্ষা ছাড়া ‘ক্লিনিক্যালি’ রোগীকে দেখে চিকিৎসা শুরু করবেন, বলা থাকছে সে কথাও।
আর কী থাকছে নির্দেশিকায়? বলা থাকছে, কোন ধরনের রোগীর ল্যাপারোস্কোপি হবে, আর কাদের হবে ‘ওপেন’ অস্ত্রোপচার। স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা জানান, ইদানীং বহু ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, চিকিৎসকেরা প্রয়োজন ছাড়াই ভূরি ভূরি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাচ্ছেন। সিটি স্ক্যান, এমআরআই-এর মতো খরচসাপেক্ষ পরীক্ষাও অত্যন্ত কম সময়ের ব্যবধানে একাধিক বার করানো হচ্ছে। শুধু খরচ নয়, বারবার ওই পরীক্ষার জন্য তেজস্ক্রিয় রশ্মির ব্যবহারে শারীরিক ক্ষতির প্রশ্নও জড়িত। কেন বারবার পরীক্ষা, এই প্রশ্ন তোলা হলে তাঁরা বইয়ে কী লেখা আছে, তা দেখিয়ে দিচ্ছেন। ওই স্বাস্থ্যকর্তার বক্তব্য, “বেশির ভাগই তো বিদেশি বই। এ দেশের পরিপ্রেক্ষিতে তা কি সব সময়ে যথাযথ হওয়া সম্ভব?” তাঁর বক্তব্য, ভাবতে হবে এখানকার পরিকাঠামো অনুযায়ী। “নতুন নির্দেশিকায় স্পষ্ট লেখা থাকবে, কোন পরিস্থিতিতে কোন পরীক্ষা কত বার করানো দরকার। এতে রোগীরা অকারণ খরচের হাত থেকে অনেকটাই নিস্তার পাবেন,” জানালেন তিনি।
কী থাকছে নির্দেশিকায়
জরুরি চিকিৎসায় কী করতে হবে
সঙ্কটাপন্নের জন্য কী ব্যবস্থা
কোন কোন ওষুধ প্রয়োগ বাধ্যতামূলক
ল্যাপারোস্কোপি, না ওপেন অস্ত্রোপচার
অস্ত্রোপচারের আগে-পরের সতর্কতা
কোন উপসর্গে কী প্রাথমিক চিকিৎসা
কোন রোগ নির্ণয়ে কী পরীক্ষা
কোন ধাপে কী অ্যান্টিবায়োটিক
কোন রোগে কত দিন হাসপাতালে
মেডিক্যাল কাউন্সিলের কর্তারা জানিয়েছেন, তাঁদের কাছে ইদানীং যে অভিযোগগুলি আসে, তা মূলত অতিরিক্ত খরচের। কাউন্সিলের এক কর্তার কথায়, “আট লাখ টাকা খরচ করে এক ব্যক্তি তাঁর একমাত্র সন্তানের হৃদযন্ত্রের অস্ত্রোপচার করিয়েছিলেন। কারণ, কলকাতার এক নামী হাসপাতাল বলেছিল, অস্ত্রোপচার না করালে তাঁদের ছেলে বাঁচবে না। কিন্তু অপারেশনের পরেও দেখা গেল সমস্যা কমছে না। তাঁরা কার্যত ঘটিবাটি বেচে ভেলোরে গেলেন। সেখানে আর এক দফা পরীক্ষার পরে বলা হল, কলকাতায় ভুল চিকিৎসা হয়েছে!” এই পরিস্থিতিতে কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল সেটা কে বিচার করবে? ওই কর্তার বক্তব্য, নতুন নির্দেশিকা থাকলে সহজেই এর জবাব মিলবে। তখন শুধু রোগীই নন, স্ট্যান্ডার্ড ট্রিটমেন্ট গাইডলাইন থাকলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবেন।
বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা নীতি তৈরির জন্য পৃথক কমিটি গড়েছে কাউন্সিল। তারা আলাদা ভাবে রিপোর্ট জমা দিচ্ছে। সেগুলির ভিত্তিতেই পূর্ণাঙ্গ নির্দেশিকা তৈরি হবে। ভারতীয় শল্য চিকিৎসকদের সংগঠন এএসআই-এর রাজ্য শাখার তরফে শল্য চিকিৎসক দীপ্তেন্দ্র সরকার বলেন, “সমস্ত উন্নত দেশেই এমন নির্দেশিকা রয়েছে। এ দেশে প্রথম সেই দিশা দেখাবে পশ্চিমবঙ্গ।”
কিন্তু পাঠ্য বইয়ের সঙ্গে প্রোটোকল না মিললে সদ্য পাশ করা চিকিৎসকরা বিভ্রান্তিতে পড়বেন না কি? দীপ্তেন্দ্রবাবু বলেন, “সেই আশঙ্কা থাকার কথা নয়। কারণ, নির্দেশিকা তৈরি হচ্ছে ‘ইন্টারন্যাশনাল কোড অফ ডিজিজ’ মেনে। সেখানে কিন্তু ‘আবশ্যিক’ এবং ‘করা যেতে পারে’, এমন দু’ধরনের নির্দেশ দেওয়া থাকে। কোন ক্ষেত্রে শুধু আলট্রাসোনোগ্রাফি করলেই চলবে, আর কোথায় সিটি স্ক্যানও জরুরি, সেটা স্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যই এই নীতি।”
শল্য চিকিৎসক কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায় এই নির্দেশিকাকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, “এই গাইডলাইনের ফলে চিকিৎসার মান ১০০ শতাংশ যথাযথ করা হয়তো যাবে না, কিন্তু অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে।” তিনি মনে করেন, রোগীর ন্যূনতম যা প্রাপ্য, তা দেওয়া হচ্ছে কি না, সেটা নিশ্চিত করার জন্য এমন গাইডলাইন দরকার।
এর আগেও স্বাস্থ্য দফতর নানা পদক্ষেপ করেছে। কিন্তু তার অস্তিত্ব এখন শুধুই কাগজে-কলমে। প্রশ্ন হল, এ ক্ষেত্রেও যে তা হবে না, তার নিশ্চয়তা কী? মেডিক্যাল কাউন্সিলের সভাপতি ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, এ জন্য বিশেষ নজরদারি কমিটি তৈরি হবে। তারা আচমকা বিভিন্ন হাসপাতালে হানা দিয়ে চিকিৎসা সংক্রান্ত নথি দেখবে। তা ছাড়া বিষয়টি ওয়েবসাইটে তো থাকছেই। সমস্ত হাসপাতালেও বোর্ড টাঙানো থাকবে, যাতে রোগীরা এই ব্যাপারে ওয়াকিবহাল থাকতে পারেন। তিনি বলেন, “রোগীদের সচেতন করতে পারলে নিয়ম প্রয়োগের কাজটা সহজ হয়ে যাবে। তখন রোগীরাই এসে জানাতে পারবেন, কোন চিকিৎসক গাইডলাইন অনুসরণ করছেন না।”
সরকারের এই পদক্ষেপকে কী ভাবে নিচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালগুলি? শহরের এক বেসরকারি হাসপাতালের চিফ অপারেটিং অফিসার বা সিওও রূপালি বসুর কথায়, “আমেরিকায় সমস্ত চিকিৎসাই গাইডলাইন মেনে হয়। এখানেও যদি তা হয়, তা হলে তাকে অবশ্যই স্বাগত জানাব।” তিনি জানান, “আমরা অবশ্য রোগী মৃত্যুর পরে তার কারণ পর্যালোচনা করি, চিকিৎসার আনুপূর্বিক বৃত্তান্ত খতিয়ে দেখি। সরকারি তরফে পূর্ণাঙ্গ গাইডলাইন তৈরি হলে কাজটা আরও সহজ হবে।” অন্য এক বেসরকারি হাসপাতালের সিইও রূপক বড়ুয়া বলেন, “সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের ভাবনাচিন্তা এবং প্রয়োগ পদ্ধতি ভিন্ন। সেই দিকটা খেয়াল রাখতে হবে।” তাঁর আরও বক্তব্য, এই নির্দেশিকা চালু হওয়ার আগে দেখার সুযোগ পেলে তা পরিমার্জনের সুযোগও পাবেন তাঁরা।
চিকিৎসকদের ‘দায়বদ্ধ’ করতে সরকারের এই প্রয়াসকে কী ভাবে দেখছে চিকিৎসক মহল? শিশু চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষ বলেন, “যে নির্দেশিকা আন্তর্জাতিক স্তরে রয়েছে, সেটাই বাধ্যতামূলক করতে পারে মেডিক্যাল কাউন্সিল।” একই সঙ্গে চিকিৎসকদের ‘কন্টিনিউয়াস মেডিক্যাল এডুকেশন’ (সিএমই)-এর উপরে জোর দিয়েছেন তিনি। তাঁর বক্তব্য, “চিকিৎসা কত আধুনিক হচ্ছে, তা জানতে না পারলে রোগীকে সেরা পরিষেবাটা তাঁরা দেবেন কী ভাবে?”
এই উদ্যোগ কতটা বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে অবশ্য সংশয় প্রকাশ করেছেন এন্ডোক্রিনোলজিস্ট শুভঙ্কর চৌধুরী। বলেছেন, “বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ অনাবশ্যক বাড়ার যে অভিযোগ ওঠে, বেশ কিছু ক্ষেত্রে তা সত্য। কিন্তু পাশাপাশি এটাও মানতে হবে যে, এক এক জন রোগীর প্রয়োজন এক এক রকম। সেটা সব সময়ে ওই ভাবে নিয়মে বাঁধা যায় না।” তবে ন্যূনতম প্রয়োজনটা যে স্থির করে দেওয়া ভাল, সেটা তিনিও মেনে নিয়েছেন।

• নয়া নীতিতে কি ফাঁক ভরবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার?
ভুক্তভোগীরা বলছেন, এর আগেও সরকারি পদক্ষেপ হয়েছে। গাফিলতির অভিযোগ দেখতে কমিটি হয়েছে, ফল মেলেনি। প্রেসক্রিপশন অডিট, অ্যান্টিবায়োটিক নীতি থেকেছে কাগজে-কলমে।
• কী বলছে কাউন্সিল?
এ বার শুধু কমিটিই গড়া হবে না, রোগীদের দায়িত্ব থাকবে অধিকার বুঝে নেওয়ার। অ্যান্টিবায়োটিক নীতি বা প্রেসক্রিপশন অডিটও অচিরেই বাধ্যতামূলক হবে।
• প্রেসক্রিপশন অডিট কী?
চিকিৎসক যে ওষুধ দিচ্ছেন, তা কতটা প্রয়োজন, সরকারি হাসপাতালে মজুত ওষুধ না দিয়ে বাইরে থেকে কেনার ওষুধ দিচ্ছেন কি না, এ সব দেখতে নির্দিষ্ট সময়ে প্রেসক্রিপশন পরীক্ষাই প্রেসক্রিপশন অডিট।
• অ্যান্টিবায়োটিক নীতি কী?
কোন হাসপাতালে কী মাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হবে, মাত্রা কখন বাড়ানো হবে এ সব নির্দেশিকা নিয়েই অ্যান্টিবায়োটিক নীতি।

—নিজস্ব চিত্র।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.