আর্থোস্কোপি করতে সল্টলেকের এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন মৈত্রেয়ী দত্তরায়। অপারেশনের তিন দিন পরে বাড়ি ফিরলেন ঠিকই, কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টা না-কাটতেই বিপত্তি! বুকে ব্যথা, শরীরজোড়া অস্বস্তি, প্রবল ঘাম। ফের ভর্তি করা হল সল্টলেকেরই আর এক হাসপাতালে। ডাক্তারেরা জানালেন, মৈত্রেয়ীদেবী সেপ্টিসেমিয়ায় আক্রান্ত। অর্থাৎ, রক্ত বিষিয়ে গিয়েছে!
সপ্তাহ তিনেক সেখানে লড়াই করার পরে তিনি মারা যান। ডেথ সার্টিফিকেটে ‘অস্ত্রোপচার-পরবর্তী সংক্রমণ’-এর কথা লেখা হয়েছে।
মৈত্রেয়ীদেবীর ঘটনা দৃষ্টান্ত মাত্র। বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, এমনটি আকছার ঘটছে।
হার্ট অপারেশনের জন্য বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন সোমক মুখোপাধ্যায়। অস্ত্রোপচার সফল হলেও সংক্রমণ তাঁর প্রাণ কেড়েছে। সল্টলেকের এক হাসপাতালে হাঁটু বদলের দিন পাঁচেক পরে সেপ্টিসেমিয়ায় আক্রান্ত হন শোভারানি পাল। দু’সপ্তাহের মাথায় মারা যান। ভাঙা ফিমার বোনে স্টিল-প্লেট বসাতে বাইপাসের এক হাসপাতালে ভর্তি হওয়া অমল প্রামাণিকও সেপ্টিসেমিয়ার বলি। অপারেশনের পরে হাসপাতালে থাকাকালীনই ওঁদের প্রত্যেকের শরীরে সংক্রমণ ছড়িয়েছিল।
এই সংক্রমণ, চিকিৎসা-পরিভাষায় যার নাম ‘হসপিটাল অ্যাকোয়ার্ড ইনফেকশন’ আপাতত সারা বিশ্বেই মস্ত একটা সমস্যা বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকদের বড় অংশ। বিশেষত কাউকে টানা বেশ ক’দিন আইসিইউ বা আইটিইউয়ে থাকতে হলে পরিস্থিতি হামেশা নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালের বার্ন ইউনিট, নার্সারি ও লেবার রুমেও এর জেরে মৃত্যু বাড়ছে। সব মিলিয়ে এটি ‘চিকিৎসাজনিত সংক্রমণ’ (হেল্থ কেয়ার অ্যাসোসিয়েটেড ইনফেকশন)-এর তকমায় ভূষিত।
সল্টলেকের যে হাসপাতালে মৈত্রেয়ীদেবীর অস্ত্রোপচার হয়েছিল, সেখানকার জেনারেল ম্যানেজার অরিন্দম বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবশ্য দাবি, তাঁদের হাসপাতালে কোনও সংক্রমণ হয়নি। তাঁর যুক্তি, “এখানে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের যাবতীয় ব্যবস্থা মজুত। ডিসচার্জের সময়েও মৈত্রেয়ীদেবীর কালচার সেনসিটিভিটি রিপোর্টে কোনও সংক্রমণ ধরা পড়েনি।”
যদিও দ্বিতীয় হাসপাতালটির ডাক্তারেরা স্পষ্ট জানিয়েছেন, অস্ত্রোপচার পরবর্তী সংক্রমণের জেরেই মৈত্রেয়ীদেবী সেপ্টিসেমিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, যা তাঁর মৃত্যু ডেকে আনে। ওঁদের যুক্তি, সেপ্টিসেমিয়া টের পেতে দিন তিনেক লেগে যায়। মৈত্রেয়ীদেবীর ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছিল বলে ওঁদের ধারণা।
বস্তুত সমীক্ষায় প্রকাশ, দেশের বড় বড় শহরের হাসপাতালে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী (ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট) ব্যাক্টেরিয়ার প্রকোপ ক্রমশ বাড়ছে। তার মধ্যে শুধু ‘ই-কোলাই’ প্রায় ৩০%। মূত্রনালির অন্যান্য সংক্রমণ, ভেন্টিলেটর সংশ্লিষ্ট নিউমোনিয়া এবং রক্ত-স্যালাইনের চ্যানেল থেকে ছড়ানো সংক্রমণ তো রয়েইছে। এদের এত বাড়বাড়ন্ত কেন?
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কর্তাদের ব্যাখ্যা: অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগে অধিকাংশ হাসপাতাল কোনও ‘নীতি’র ধার ধারে না। সল্টলেকের এক হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ সুশ্রুত বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, “চটজলদি ফল পেতে বহু ক্ষেত্রে গোড়াতেই চড়া ডোজে অ্যান্টিবায়োটিক চালু হয়। এতে অনেক সময়ে দেহে রেজিস্ট্যান্স গড়ে ওঠে।” চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায়ের আক্ষেপ, “বেশির ভাগ হাসপাতালে তো অ্যান্টিবায়োটিক প্রোটোকল মানাই হয় না!” সেটা কী?
ফার্মাকোলজি-র বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, রোগীকে কোন পর্যায়ে কী অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হবে, তার সুনির্দিষ্ট নীতি-ই হল ‘অ্যান্টিবায়োটিক প্রোটোকল।’ দেখা গিয়েছে, এক-এক হাসপাতালে এক-এক ধরনের সংক্রমণ বেশি। সেই মতো অ্যান্টিবায়োটিক স্থির করা জরুরি।
কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজের ফার্মাকোলজি’র প্রধান চিকিৎসকের কথায়, “প্রথম দফায় কিছু অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া যায়। কিছু ‘রিজার্ভে’ রাখতে হয়, কালচার সেনসিটিভিটি-র ভিত্তিতে প্রয়োগের জন্য। হাই ডোজের কিছু অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার আগে বিশেষ কমিটির অনুমোদন নেওয়াটা নিয়ম। অথচ অধিকাংশ ডাক্তার তা জানেনই না!” সরকারের ভূমিকা কী?
পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী জানাচ্ছেন, এ রাজ্যে ‘ইনফেকশন ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড কন্ট্রোল প্রোগ্রাম’ চালু রয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক-নীতিও রয়েছে। তবে সবটাই যে কার্যত নাম কা ওয়াস্তে, তা-ও মানছেন তিনি। অধিকর্তার বক্তব্য, “ওটি বা লেবার রুম থেকে সোয়াব নিয়ে ব্যাক্টেরিয়ার চরিত্র জানার চেষ্টা সব সময়ে চলে। এখানে কোন সংক্রমণে কী অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হবে, তা ঠিক করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বলতে বাধ্য হচ্ছি, বহু ডাক্তার গাইডলাইন না-মেনে খুশিমতো অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছেন।”
এবং চিকিৎসকদের ‘নিয়ম ভাঙা’র খেসারত দিচ্ছেন রোগীরা। সরকারের কিছু করার নেই?
স্বাস্থ্য-অধিকর্তার জবাব, “প্রেসক্রিপশন অডিট শুরু হচ্ছে। তাতে সব ধরা পড়বে। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা হবে।” কিন্তু সে তো শুধু সরকারি হাসপাতালে। বেসরকারি হাসপাতালে নজর রাখবে কে?
স্বাস্থ্য-অধিকর্তা মেনে নিয়েছেন, এ ব্যাপারে বেসরকারি হাসপাতালকে নিয়ন্ত্রণের কোনও ক্ষমতা তাঁদের হাতে নেই। |