বনমন্ত্রী হিতেন বর্মন জানাইয়াছেন, আলিপুর চিড়িয়াখানা স্থানান্তরিত হইবে না। সোনারপুরের নিকটে ভগবানপুরে জমি অধিগ্রহণে জটিলতার জন্য সেই পরিকল্পনা বাতিল হইয়াছে। কষ্ট করিয়া পর্যটকদের কলিকাতা হইতে দূরে যাইতে হইবে, ইহাতেও মন্ত্রী মহাশয়ের আপত্তি। দুইটি যুক্তিই সারহীন, পশ্চাতের মনোভাবটি অতিশয় বিপজ্জনক। কোনও উন্নত দেশ আজ চিড়িয়াখানাকে মূলত পর্যটনের আকর্ষণ বলিয়া দেখে না। তাহার প্রধান কাজ সংরক্ষণ। যে সকল প্রজাতি প্রকৃতিতে বিলুপ্ত হইয়া যাইতেছে, চিড়িয়াখানায় তাহাদের অনুকূল অবস্থায় রাখিয়া, প্রজননে সহায়তার দ্বারা বংশবৃদ্ধি ঘটাইয়া আবার পরিবেশে পুনঃস্থাপনই চিড়িয়াখানার কাজ। জীবজগতের বৈচিত্র রক্ষার কাজে প্রতিটি চিড়িয়াখানা দায়বদ্ধ। কোনও জনবহুল শহরের মধ্যস্থলে, বড় বড় অট্টালিকায় পরিবৃত সংকীর্ণ পরিসরে সেই দায়িত্ব যথাযথ পালন করা সম্ভব নহে। আলিপুর প্রাণীদের অনুকূল স্থান নহে। তাহার উদাহরণ পরিযায়ী পাখিদের আলিপুর বর্জন। আকাশপথের যে মানচিত্র প্রজন্ম হইতে প্রজন্ম স্মৃতিতে সঞ্চারিত হইয়াছে, আজ বহুতল বিলাসভবন তাহা রোধ করিয়া দাঁড়াইয়াছে। বহু রাষ্ট্র কিন্তু নির্মাণ বিষয়ক আইনে পরিযায়ী পাখিদের জন্য প্রয়োজনীয় বিধি রাখিয়াছে, জলাজমি সংরক্ষণ করিয়াছে। রাজ্য সরকার আলিপুরে প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরি করিতে পারে নাই, অন্যত্র চিড়িয়াখানা সরাইতেও অপারগ। সোনারপুরের জমি সরকারের নিকট দুর্মূল্য মনে হইতেছে। কিন্তু বিরল, বিচিত্র প্রাণীদের জীবনের মূল্য কী উপায়ে সরকার নির্ধারণ করিতেছে? একশৃঙ্গ গণ্ডার, সিংহপুচ্ছ ম্যাকাক কিংবা মুকুটধারী সারসের প্রাণের মূল্যের সহিত দো-ফসলি জমির বাজার দর ঠিক কোন অনুপাতে কষিতে হইবে?
জমি অধিগ্রহণের রাজনৈতিক ঝুঁকি যে পশু উদ্যানে সংরক্ষিত প্রাণীদের মৃত্যু-আশঙ্কাকে ছাপাইয়া উঠিয়াছে, তাহাতেই ইঙ্গিত মিলিতেছে যে এই মন্দভাগ্য রাজ্যে কেবল অর্থভাণ্ডারেই টান পড়ে নাই। বিজ্ঞান, পরিবেশ এবং মানবিকতার বোধও তলানিতে নামিয়াছে। শূন্যে পৌঁছাইয়াছে ইতিহাসচেতনা। বাংলা ভুলিয়াছে রামব্রহ্ম সান্যাল ও তাঁহার ঐতিহ্যপূর্ণ কর্মধারাকে। আলিপুর চিড়িয়াখানার প্রথম ভারতীয় সুপারিন্টেডেন্ট রামব্রহ্ম জীবজন্তুদের পর্যবেক্ষণে, এবং বন্দিদশায় বন্য প্রাণীর প্রজননে যে অসামান্য সাফল্য পাইয়াছিলেন, তাহা বিশ্বের বিজ্ঞানজগতে সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি পাইয়াছে। বিশ্বের বিজ্ঞান জগতে রামব্রহ্ম এবং তাঁহার কর্মস্থল কলকাতা প্রাণী সংরক্ষণ ও প্রজননের ক্ষেত্রে পথিকৃৎ। যখন চিড়িয়াখানায় প্রজাতি সংরক্ষণের কথা ভাবা হয় নাই, তখন রামব্রহ্ম তাহা করিয়া দেখাইয়াছিলেন।
সেই কলিকাতা চিড়িয়াখানা এখন বিশ্বের দরবারে নিয়ত নিন্দিত হইতেছে। ছোট ছোট অস্বাস্থ্যকর খাঁচায় বন্দি, বায়দূষণ-শব্দদূষণে জর্জরিত, অব্যবস্থার শিকার প্রাণীগুলি ক্রমান্বয়ে প্রাণ হারাইতেছে। ২০১১ সালের অগস্ট মাস হইতে এ বৎসর মার্চ মাসের মধ্যে আট মাসে ৬৭টি প্রাণী মারা গিয়াছে। তাহার মধ্যে রহিয়াছে বাঘ, সিংহ, শিম্পাঞ্জি, মার্মোসেট, ক্যাঙারু, পাখি এবং সাপ। প্রতি চার-পাঁচ দিন অন্তর একটি মৃত্যুকে কোনও অর্থেই ‘স্বাভাবিক’ বলিয়া গণ্য করা চলে না। বরং এই আশঙ্কাই দেখা দেয় যে, যে প্রতিষ্ঠানটি ছিল সংরক্ষণের পথিকৃৎ, আজ তাহাই বধ্যভূমি হইয়া উঠিয়াছে। প্রাণিবিজ্ঞানী, পরিবেশবিজ্ঞানীরা বহু পূর্বেই এক মত হইয়াছেন যে, আলিপুর হইতে চিড়িয়াখানা না সরাইলে প্রাণীদের ঝুঁকি কমিবে না। মন্ত্রীরা কর্ণপাত করেন নাই। বরং গত এক বৎসরে অন্তত নয় বার অধিকর্তা বদল করিয়াছেন। অর্থাৎ পশুপাখিই কেবল নহে, কলিকাতা চিড়িয়াখানায় ‘বিপন্ন’ স্বয়ং অধিকর্তাও! কর্মসংস্কৃতি কেমন, সহজেই অনুমেয়। কে কাহাকে বাঁচাইবে? |