ই-লার্নিং কাকে বলে
-লার্নিং কাকে বলে, এই নিয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই অনেকেরই। ই-লার্নিং’কে এ কালের আর পাঁচটা শিক্ষা পদ্ধতির সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। দু’টি উদাহরণ দিই।
যেমন, কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের সেন্ট লরেন্স স্কুলে গত কয়েক মাস ধরে ক্লাসরুমে চক-ডাস্টারের পরিবর্তে বায়োলজির ল্যাবরেটরিতে কম্পিউটার, প্রজেক্টার, মাউথ পিস, ক্যামেরা ব্যবহার করে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রদের মুখোমুখি জীবনবিজ্ঞান পড়াচ্ছেন প্রণবকুমার প্রধান। পরীক্ষামূলক ভাবে শুরু করা এই শিক্ষাদান পদ্ধতি ছাত্রদের মধ্যে এতটাই জনপ্রিয় হয়েছে যে স্কুল কর্তৃপক্ষ গরমের ছুটির পর এ ভাবেই অঙ্ক ও বিজ্ঞানের অন্য বিষয়গুলি পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রণববাবু জানালেন, প্রতি দিন ক্লাসে যা পড়ানো হয়, সবই রেকর্ড করে রাখা হয় কম্পিউটারে। সিডি ও পেনড্রাইভে তুলে নেওয়া হয় পুনরায় ব্যবহারের জন্য। তবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হয় না।
সেন্ট লরেন্সের শিক্ষাদানের এই পদ্ধতি কিন্তু ই-লার্নিং নয়।
আবার যেমন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যাটেলাইট ও কেব্ল লিঙ্ক ব্যবহার করে ভিডিয়ো কনফারেন্সিং পদ্ধতিতে একই সময়ে বিভিন্ন স্টাডি সেন্টারে শিক্ষাদান করার ব্যবস্থা রয়েছে। এগুলিও ই-লার্নিং নয়।
ই-লার্নিং তা হলে কী?
ই-লার্নিং হল, ইন্টারনেটে কোর্স করানোর ব্যবস্থা, যাতে ছাত্ররা বাড়ি থেকেই পড়তে ও শিখতে পারে। ইন্টারনেট কানেকশন ছাড়া কম্পিউটার ব্যবহার করে ক্লাসরুম পড়ানোকে ই-লার্নিং বলা যায় না। ই-লার্নিং মানেই হল ইন্টারনেটের মাধ্যমে শিক্ষালাভ, যা যে-কোনও জায়গা থেকেই করা সম্ভব।
ব্রিটিশ কাউন্সিলের স্কুল প্রোগ্রামস-এর ম্যানেজার মৃগাঙ্ক মুখার্জি জানালেন যে, উন্নত প্রযুক্তি ও ডিজিটাল মিডিয়া ব্যবহার করে ক্লাসরুম টিচিংকে ইনফরমেশন কমিউনিকেশন টেকনলজি (আইসিটি) বেসড লার্নিং বলে।
ই-লার্নিং-এর ওয়েবসাইটগুলিতে সাধারণত ভিডিয়ো লেকচার ও কোর্সওয়্যার আপলোড করা থাকে। এর সঙ্গে রেফারেন্স বইয়ের নামের তালিকা, আলোচনার ফোরাম, প্রাসঙ্গিক অনলাইন উইকি ও নানা ধরনের প্রাসঙ্গিক কেস স্টাডিজ থাকে। পাঠ্য বিষয়বস্তু টু ও থ্রি-ডি অ্যানিমেশন, ল্যাবরেটরি ডেমনস্ট্রেশন, অডিয়ো এবং ভিডিয়ো ক্লিপিং-এর মাধ্যমে বোঝানো হয়।

স্কুল স্তরে ই-লার্নিং
ব্রিটিশ কাউন্সিলের ‘স্কুল অনলাইন’ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ভারতের স্কুলগুলি বিদেশে তাদের সহকারী স্কুলের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে নানা বিষয়ে আলোচনা, প্রজেক্ট তৈরি, তথ্য আদানপ্রদান প্রভৃতি করতে পারে। এর জন্য স্কুলগুলির কাছে দ্রুত ইন্টারনেট কানেকশন-সহ কম পক্ষে একটি কম্পিউটার থাকতেই হবে। মৃগাঙ্ক জানালেন, ‘‘এ বছর পূর্ব ভারত থেকে ৩০টি স্কুল ‘স্কুল অনলাইন’ প্রজেক্টে রেজিস্ট্রেশন করেছে। এর মধ্যে কলকাতার বেশ কিছু নামী স্কুল রয়েছে।”
সরাসরি ই-লার্নিং-এর মাধ্যমে ইংরেজি শেখার ব্যবস্থাও রয়েছে ব্রিটিশ কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে। ছোট থেকে বড় সকলেই ইংরেজি শিখতে পারে এখানে। লিসনিং অ্যাক্টিভিটি, ব্যাকরণ অনুশীলনী, ভিডিয়ো কনটেন্ট প্রভৃতি নানা ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। ওয়েব সাইট: learnenglish.britishcouncil.org.

ভারতে উচ্চশিক্ষায় ই-লার্নিং
এন পি টেল (NPTEL): কেন্দ্রীয় সরকারের মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের ‘ন্যাশনাল প্রোগ্রাম অন টেকনলজি এনহান্সড লার্নিং’ নামক প্রজেক্ট শুরু করেছিল ২০০৩ সালে। ২০০৪-এর শেষ দিকে প্রথম দফার (phase) কোর্স মেটিরিয়াল ও ভিডিয়ো লেকচার ইউটিউবে আপলোড করে এন পি টেল, প্রথম দফার ২৬০টি কোর্সের মধ্যে ১১০টি কোর্স ছিল ভিডিয়ো ফরম্যাটে। দ্বিতীয় দফায় ১০১৬টি কোর্স আপলোড করার পরিকল্পনা রয়েছে।
এন পি টেল-এর এই ই-লার্নিং পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে দেশের সাতটি আইআইটি এবং বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স-এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। প্রথম দফার ই-লার্নিং-এর সময় আইআইটি খড়্গপুরের ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বিভাগীয় প্রধান এবং সেন্টার ফর এডুকেশনাল টেকনলজি-র প্রধান ছিলেন তপনকুমার বসু। বর্তমানে ‘নেওটিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনলজি, ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড সায়েন্স’-এর অধিকর্তা তপনবাবু জানালেন, এন পি টেল দু’টি পদ্ধতিতে ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেয়
১) ওয়েব কোর্সের মাধ্যমে,
২) ভিডিয়ো লেকচারের মাধ্যমে। আইআইটি-র সাতটি শাখা খড়্গপুর, বম্বে, দিল্লি, মাদ্রাজ, কানপুর, গুয়াহাটি, রুরকি এবং বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স’কে এন পি টেল-এর কোর্স মেটিরিয়াল ও লেকচার তৈরির জন্য বিষয় ভাগ করে দেওয়া রয়েছে। এরা নিজেদের কোর্স মেটিরিয়াল আর লেকচারের হার্ডকপিগুলি পাঠিয়ে দেয় আইআইটি মাদ্রাজে। আইআইটি মাদ্রাজ এ ক্ষেত্রে কো-অর্ডিনেটরের কাজ করে। ওরা ওই হার্ডকপিগুলি থেকে কোর্স মেটিরিয়াল ও লেকচারগুলিকে ইউটিউবে আপলোড করে দেয়। এই ভিডিয়ো লেকচার বা কোর্সওয়্যার ডাউনলোড করে ই-লার্নিং-এর মাধ্যমে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে যে-কেউ ইঞ্জিনিয়ারিং, বিজ্ঞান বা হিউম্যানিটিজ-এ আন্ডার-গ্র্যাজুয়েট কোর্স করতে পারে। ওয়েবসাইট: www.youtube.com/user/nptelhrd
ইগনু: ইন্দিরা গাঁধী ন্যাশনাল ওপেন ইউনিভার্সিটি-র স্কুল অব সোশাল সায়েন্সেস, কম্পিউটার অ্যান্ড ইনফরমেশন সায়েন্সেস, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনলজি, সায়েন্সেস, জার্নালিজম অ্যান্ড নিউ মিডিয়া স্টাডিজ, ল’, পারফরমিং অ্যান্ড ভিশুয়াল আর্টস, কনটিনিউয়িং এডুকেশন, হেলথ সায়েন্সেস তাদের নিজ নিজ বিষয়ের ওপর ভিডিয়ো লেকচার ও কোর্স আপলোড করেছে ইউটিউবে। ইগনু পূর্বভারতের রিজিয়োনাল ডিরেক্টর সুজিত কুমার বসু জানালেন, ইগনুতে অনলাইন প্রক্রিয়ায় অ্যাডমিশন, স্টাডি মেটিরিয়াল জোগাড় করা এবং পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। ই- জ্ঞানকোষ-এ কোর্স মেটিরিয়াল পাওয়া যায়। সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা ও ডিগ্রি কোর্সও করা যায় এই পদ্ধতিতে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত ফি দিতে হয় সংশ্লিষ্ট কোর্সের জন্য। ওয়েবসাইট: www.youtube.com/user/egyankoshIGNOU এবং www.youtube.com/user/ignousojnms

বিশ্ব জুড়ে ই-লার্নিং
২০০২ সালে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনলজি প্রথম ৫০টি কোর্স অনলাইনে রাখে, পরের বছর আরও ৪৫০টি কোর্স যোগ হয়। ২০০৯ সালে এই কোর্সের সংখ্যা ছিল ১৮০০, যা বর্তমানে বেড়ে ২০০০ ছাড়িয়েছে। জনপ্রিয়তা আর চাহিদা এতই বেশি যে অনেক কোর্সই চিনা, পর্তুগিজ ও স্প্যানিশ ভাষায় অনুবাদ করতে হয়েছে। এম আই টি-র উদাহরণ ছড়িয়ে পড়তেই অন্যান্য জায়গাতেও ‘ওপেন কোর্সওয়্যার কনসরটিয়াম’ তৈরি হয়। এর ব্যবহারকারীরা পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছেন। আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি, তার পর চিন আর ভারত।
অনলাইনে ওপেন কোর্সওয়্যার চালু হওয়ার ফলে এম আই টি-র অধিকাংশ আন্ডার-গ্র্যাজুয়েট কোর্সই এখন অনলাইন প্রক্রিয়ায় বিনামূল্যে করে ফেলা যায়। শুধু একটা কম্পিউটার আর দ্রুত ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেই ভারতের প্রত্যন্ত গ্রামের গরিব ছেলেটিও এম আই টি-র শিক্ষকদের সাহায্য পেয়ে পড়াশোনা করতে পারবে।
তাদের অনলাইন কোর্সে দক্ষতা প্রমাণ করতে পারলে শিক্ষার্থীকে ক্রেডেনশিয়ালস দেওয়া হবে। সম্প্রতি এম আই টি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর জন্য শিক্ষার্থীকে অবশ্য সামান্য ফি দিতে হবে, যার পরিমাণ এম আই টি কর্তৃপক্ষ এখনও ধার্য করে উঠতে পারেননি। তবে অনলাইন কোর্সের সার্টিফিকেট দেওয়ার জন্য এম আই টি নিজের ক্যাম্পাসেই নতুন একটি পরিচালন সমিতি তৈরি করেছে, যার নাম ‘এম আই টি এক্স’। অনলাইন কোর্সের শেষে এম আই টি এক্স ‘ইলেকট্রনিক সার্টিফিকেট অব অ্যাকমপ্লিশমেন্ট’ প্রদান করবে।
এম আই টি এক্স গঠিত হওয়ার পর পরীক্ষামূলক ভাবে সম্প্রতি প্রথম সার্টিফিকেট কোর্স শুরু হয়েছিল, যার নাম ‘সার্কিটস অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ৬.০০২এক্স’। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পড়া যায়। আর সার্টিফিকেট-এর ফি এখনও পর্যন্ত না হওয়ায় এই ব্যাচের শিক্ষার্থীরা বিনামূল্যে ক্রেডেনশিয়ালস পেতে পারবেন। ওয়েবসাইট: http://6002x.mitx.mit.edu

ই-লার্নিং-এর সুবিধা
১) ইন্টারনেটের মাধ্যমে পৃথিবীর যে-কোনও প্রান্ত থেকে যে কেউ বিনামূল্যে বা ফি দিয়ে পড়াশোনা করতে পারে।
২) ওপেন কোর্সওয়্যারের ভিডিয়ো, অডিয়ো, ইমেজ, অ্যানিমেশন ও ইন্টারঅ্যাক্টিভ পদ্ধতির সাহায্যে শিক্ষার্থীর নিজেই নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। নিজের কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো কোনও বিষয় বুঝতে না পারলে বা আরও বেশি শিখতে হলে ই-লার্নিং-এর সাহায্য নেওয়া যায়।
৩) ই-লার্নিং পদ্ধতিতে ভার্চুয়াল গবেষণাগারে কম্পিউটার অ্যানিমেশনের মাধ্যমে সহজেই বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায়। পরীক্ষা সংক্রান্ত নিয়মাবলি অর্থাৎ কী কী করবে আর কী করবে না, তা শুরুতেই দেওয়া থাকে। পরীক্ষা পরিচালনাকালীন ভুল পদক্ষেপ নিলে লাল ক্রস আসতে পারে, হুটার/সাইরেন বাজতে পারে, অ্যানিমেশনের মাধ্যমে বিস্ফোরণও হতে পারে। ছাত্রটি তখন বুঝে যাবে যে তার পরীক্ষার পদ্ধতিটি ভুল হয়েছে। সে আবার নতুন করে পরীক্ষাটি শুরু করতে পারে। বার বার অভ্যাস করার সুবিধার ফলে ছাত্রের আত্মপ্রত্যয় বাড়ে। আসল পরীক্ষাগারে নির্ভুল ভাবে পরীক্ষা করতে কোনও অসুবিধে হয় না।

শিক্ষার্থীরা কী বলছে
এম আই টি এক্স-এর প্রথম কোর্সে ১ লক্ষ ২০ হাজার জন রেজিস্ট্রেশন করেছেন। কেউ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, কেউ স্বাধীন শিক্ষার্থী, কেউ পেশাদার, কেউ পুরনো পড়া ঝালিয়ে নিতে বা আত্মপ্রত্যয় বাড়ানোর জন্য কোর্স করেছেন। সৌম্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য একটি সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানিতে কর্মরত। তাঁর ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ডিগ্রিও রয়েছে। বহু দিন ধরে রোবোটিক্সে আগ্রহ ছিল। এম আই টি এক্স-এর এই কোর্সের মাধ্যমে তিনি তাঁর জ্ঞান ঝালিয়ে নিচ্ছেন।
ই-লার্নিং পদ্ধতিতে পড়ার সময় শিক্ষকের সঙ্গে মুখোমুখি আলোচনার সুযোগ না থাকলেও শিক্ষককে ই-মেল করে নিজের প্রশ্ন পাঠানো যায়। চ্যাটিং-এর মাধ্যমে নিজের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূর করে নেওয়া যায়। এ ছাড়া, আলোচনার ফোরামে সহপাঠীদের সঙ্গে আলোচনার সুযোগ তো রয়েইছে।

যে বিপুল সম্ভাবনা এই ই-লার্নিং পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে, তার যথাযথ রূপায়ণ হলে লেখাপড়ার জগৎ আরও অনেক সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে। ছাত্রছাত্রীদের ইচ্ছানুসারে নানা ধরনের কোর্স করা সম্ভব হবে, যে কোনও জায়গা থেকে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.