ইউরোপ জয়ের বন্যায় ভাসছে স্পেন। দেশের তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কটের দুঃস্বপ্নের মধ্যে কাসিয়াসদের হাত ধরে এসেছে এক টুকরো আলো। জাতীয় নায়কদের অভ্যর্থনা জানাতে মাদ্রিদ জুড়ে যেন শুধুই লাল গালিচা। এক ঝলক দেখলে মনে হবে লাল-হলুদের সমুদ্র!
আর সমুদ্রের বুক চিরে নৌকোর মতো এগোচ্ছে একটা ডাবল-ডেকার বাস। বাসের খোলা ছাদে ইউরো-জয়ী স্প্যানিশ আর্মাদা। কাসিয়াস-জাভি-ইনিয়েস্তা...।
ছবিটা নতুন নয়। বড় ট্রফি জিতে ঘরে ফিরে এ রকম অভ্যর্থনা পেতেই অভ্যস্ত ফুটবলাররা। তবে এ বার যেন ব্যাপারটা একটু অন্য রকম। অর্থনৈতিক সঙ্কটের কালো মেঘ কাটিয়ে দেওয়া তো ছোটখাটো ব্যাপার নয়। কয়েক দিনের জন্য হলেও, দুঃস্বপ্ন থেকে এমন মধুর মুক্তি তো রোজ আসে না! উৎসব তাই বাঁধভাঙা হবেই। হল-ও।
|
মাদ্রিদের আকাশ জুড়ে এ দিন শুধুই লাল-হলুদ পতাকা। শহরের প্রতিটা কোনা এ দিন মুখরিত কাপজয়ী নায়কদের অভিবাদন জানাতে আসা দর্শকদের উচ্ছ্বাসে। ঐতিহাসিক এ সব মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি করতে আকাশে উড়ছিল বেশ কিছু হেলিকপ্টার। বিজয়রথের গন্তব্য ছিল শহরকেন্দ্রের প্লাজা দে সিবেলেস স্কোয়্যার। সারি-সারি জায়ান্ট স্ক্রিনের সামনে বিশাল মঞ্চ। সেখানে রক ব্যান্ডের তালে তালে নাচ। আর নাচছেন কারা? তোরেস, আলবা, সিলভারা। কখনও কোমর দুলছে। কখনও গলা মেলাচ্ছেন গানে। গানের কথাগুলোও মনে রাখার মতো‘নো হে দোস সিন ত্রেস’। দুই হলে তিনও হবে।
তিন মানে তিনটে ট্রফি। ইউরো। বিশ্বকাপ। আবার ইউরো। উন্মত্ত উৎসবের মহিমা এমনই যে, মঞ্চ থেকেই সমর্থকদের সঙ্গে ফুটবলারদের টুকরো আড্ডা শুরু। “এই টিমটার ক্যাপ্টেন হতে পেরে আমার অসম্ভব গর্ব হচ্ছে। এরা প্লেয়ার হিসেবে যেমন দুর্দান্ত, মানুষ হিসেবেও তেমন,” বলে ফেলেছেন স্পেনের স্বর্ণযুগের অন্যতম নায়ক ইকের কাসিয়াস। ভক্তদের বারেবারে ধন্যবাদ দিয়েছেন। “আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ আজ এখানে আসার জন্য।” আবেগের বহিঃপ্রকাশ খুব বেশি যাঁর মধ্যে দেখা যায় না, সেই আন্দ্রে ইনিয়েস্তাও উৎসবের সমুদ্রে যেন খেই হারাচ্ছেন। বলছেন, “সবচেয়ে বেশি গর্ব হচ্ছে আপনাদের আজ এখানে আসতে দেখে। সবাই জানে, আমাদের দেশের অবস্থা এখন খুব একটা ভাল না। কিন্তু তার মধ্যেও যে আমরা আপনাদের মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছি, সেটাই অনেক। এর চেয়ে বড় গর্বের ব্যাপার আর কিছু হয় না।” স্পেনের রাজা হুয়ান কার্লোস পর্যন্ত ইনিয়েস্তাদের বলে দিয়েছেন, “তোমরা ভাল ফুটবলার বলে শুধু গর্ব হচ্ছে না। তোমরা মারাত্মক টিমও।” |
মাদ্রিদের রাজপথে থিকথিকে ভিড়। সারি-সারি কালো মাথায় ঠাসা গলিঘুঁজিও। ভিড় সামলাতে প্রায় নাভিশ্বাস উঠেছে পুলিশের। স্বপ্নের নায়কদের এক মুহূর্তের জন্য ছুঁয়ে দেখার আকুতি এতটাই ছিল যে, বাড়ির ছাদ থেকেও কেউ কেউ ঝুঁকে চেষ্টা করেছেন বাসের ছাদে বসে থাকা ফুটবলারদের সঙ্গে হাত মেলাতে। সবার সামনে দশ নম্বর জার্সিতে সেস ফাব্রেগাস। স্পেনের এই বিরল ইতিহাস তৈরির যিনি একজন কারিগর। আলবার মতো কারও কারও কাছে এই ইউরোই ছিল দেশের হয়ে প্রথম কোনও বড় ট্রফি জয়। ফাব্রেগাসের কাছে অবশ্য ট্রফি জেতা নতুন কিছু নয়। চার বছর আগের ইউরো চ্যাম্পিয়ন টিমে ছিলেন। বিশ্বজয়ী টিমে ছিলেন। এই ইউরোয় দেল বস্কির ‘ফল্স নাইন’-ও তিনিই। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ মুহুর্মুহু তাঁর জন্য জ্বলবে না তো কার জন্য জ্বলবে? ফাব্রেগাসদের অবশ্য বালতি বালতি জলে ভিজতেও হল! কিছুই না, সমর্থকদের আদরের অত্যাচার। ইতিহাস সৃষ্টি করে ফুটবলাররা দেশে ফিরেছেন, বারান্দা থেকে জল ঢেলে তাঁদের মাথা ঠান্ডা করতে হবে তো! আর চোদ্দো জন বাচ্চার হাত ধরে রাজপথে দাঁড়িয়ে ছিলেন বছর বিয়াল্লিশের জেমি বারেয়া। চোখের সামনে জাতীয় নায়কদের দেখতে দেখতে অস্ফুট মন্তব্য, “এদের এনেছি একটাই কারণে। এখন ওরা যা দেখছে, সেটা কোনও দিন ফিরবে না। আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন কোনও দিন এ রকম কিছু দেখিনি।” বাসের উপর তখন পা ছড়িয়ে বসে তোরেস। রামোস সিটে বসে বসেই নাচছেন। দেল বস্কি পর্যন্ত হালকা কোমর দোলাচ্ছেন! |