বস্তা বস্তা মশারি। বাক্স ভর্তি মশা তাড়ানোর তেল, ধূপ ও ক্রিম। মশা তাড়ানোর ধোঁয়া তৈরির মেশিনের সঙ্গে ম্যালেরিয়ার জন্য রক্ত পরীক্ষার উপকরণ। আর অবশ্যই ম্যালেরিয়ার ওষুধ, মেফলোকুইন ট্যাবলেট।
এত সব আয়োজন কিন্তু শুধু মশা ও আর ম্যালেরিয়া ঠেকানোর জন্য ভাবলে ভুল হবে। আসল উদ্দেশ্য হল মাওবাদী দমন! কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, অন্যান্য বছরের মতো এ বারের বর্ষায় মাওবাদী দমন অভিযান বন্ধ করা হবে না। আর সেটা করতে গেলে আরও অনেক কিছুর সঙ্গে একটা গুরুতর সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে জওয়ানদের। তা হল মশা! সিআরপিএফ কর্তাদের মতে, যারা মাওবাদীদের থেকেও ঢের বেশি ভয়ঙ্কর! আর সে কারণেই গুলি-গ্রেনেডের পাশাপাশি জওয়ানদের মশারি-তেলেরও আয়োজন করতে হচ্ছে।
সাধারণত প্রতি বছর বর্ষার সময় রাজ্যে রাজ্যে যৌথ বাহিনীর অভিযান এক রকম বন্ধ থাকে। কারণ বর্ষায় জঙ্গল ঘন হয়ে ওঠায় চলাফেরা তো দূর, ভাল করে নজর করাও কঠিন হয়। ফলে জঙ্গলে মাওবাদীদের পেতে রাখা ফাঁদে পড়ায় ভয় থাকে সব সময়েই। সঙ্গে আছে বিছে, সাপের কামড়ের ভয়। এবং অবশ্যই মশককূল ও তাদের হাত ধরে ম্যালেরিয়া। ফলে এই সময়টা মাওবাদী দমন অভিযানের রাশ কিছুটা আলগা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। মাওবাদীরাও এই সময়টা অঘোষিত সংঘর্ষবিরতির নীতি নেয়। কারণ তাদের সংগঠনের অন্যতম স্তম্ভ হচ্ছে গ্রামের মানুষদের নিয়ে তৈরি ‘গণ মিলিশিয়া’। বর্ষায় চাষের কাজকর্মের জন্য গণ মিলিশিয়ার সদস্যদের সংগঠনের কাজ থেকে ‘ছুটি’ দিতে হয়।
কিন্তু এ বার পরিস্থিতি অন্য। গোয়েন্দা রিপোর্ট বলছে, ছত্তীসগঢ়, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহল সর্বত্রই মাওবাদীরা যথেষ্ট চাপে। শুক্রবারই ছত্তীসগঢ়ে কেন্দ্রীয় বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে ১৯ জন মাওবাদীর মৃত্যু হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলেও কিষেণজির মৃত্যু, বেশ কিছু নেতানেত্রীর আত্মসমর্পণের ফলে সংগঠনে ধাক্কা লেগেছে। এই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে এ বার তাই বর্ষার সময়টাকে মাওবাদীরা নিজেদের সংগঠন মজবুত করার কাজে লাগাতে চাইছে। বর্ষাকালে যৌথ বাহিনীর অভিযান বন্ধ থাকবে ধরে নিয়ে তারা এই সময় গ্রামে গ্রামে গিয়ে রাতবিরেতে সভা বা মিছিল সংগঠিত করার চেষ্টা করবে। যার প্রধান উদ্দেশ্য হল, সংগঠনের ক্যাডার ও গণ মিলিশিয়ার সদস্যদের উজ্জীবিত করা। পাশাপাশি সংগঠনে নতুন ক্যাডার নিয়োগের প্রক্রিয়াও চলবে। আর সুযোগ পেলেই যৌথ বাহিনীর উপরে হামলার চেষ্টা। যেখানে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ে যাওয়ার মতো শক্তির অভাব, সেখানে মোবাইল টাওয়ার, রেল লাইন ওড়ানোর দিকে নজর দেবে তারা।
মাওবাদী পরিকল্পনা নিয়ে গোয়েন্দাদের এই রিপোর্টের পরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এ বারের বর্ষাতেও মাওবাদী অভিযান বন্ধ করা হবে না। তা ছাড়া লাগাতার অভিযান চালিয়ে মাওবাদীদের উপরে যে চাপ তৈরি করা গিয়েছে, তা কোনও ভাবেই আলগা করতে চাইছেন না কেন্দ্রীয় বাহিনীর কর্তারা। মাওবাদীদের দুর্গ হিসেবে পরিচিত দুর্ভেদ্য অবুঝমাঢ় জঙ্গলেও এখন যৌথ বাহিনী ঢুকে পড়েছে। এই অবস্থায় অভিযান বন্ধ করে দিলে মাওবাদীরা ফের ওই সব এলাকায় ঘাঁটি গেড়ে বসতে পারে।
কিন্তু সমস্যা মশা। সিআরপিএফ কর্তাদের মতে, যারা মাওবাদীদের থেকেও ঢের বেশি ভয়ঙ্কর! মাওবাদীদের তুলনায় ‘ম্যালেরিয়াবাদী’-রা কত বিপজ্জনক হতে পারে, তার প্রমাণ গত বর্ষাতেই মিলেছিল। গত বৃষ্টির মরশুমে ঝাড়খণ্ড-ওড়িশার সারান্ডার জঙ্গলে এক মাস ধরে ‘অপারেশন মনসুন’ চালায় সিআরপিএফ ও রাজ্য পুলিশ। মাওবাদীদের বিরুদ্ধে সাফল্য মিললেও অন্যত্র বিপত্তি দেখা দেয়। মশার কামড় খেয়ে বাহিনীর শ’খানেক জওয়ান ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। যে প্রত্যন্ত এলাকায় কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়োগ করা হয়েছে, সেখানে ঠিক মতো হাসপাতাল না থাকায় সমস্যা দেখা দেয়। বীরেন্দ্র কুমার সাইনি নামে কোবরা বাহিনীর এক জওয়ানের মৃত্যুও হয়।
এ বার কী ভাবে যৌথ অভিযান হবে? সিআরপিএফ কর্তারা বলছেন, গত বর্ষায় সারান্ডার জঙ্গলে অভিযান চালানো গিয়েছে, এ বারে অন্যত্র অভিযান চালানো কঠিন কোথায়? বিশেষত অবুঝমাঢ় জঙ্গলেও এখন যৌথ বাহিনী ঢুকে পড়েছে। এই বর্ষায় ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলিতে অভিযান হবে। বেশি জোর দেওয়া হবে ছত্তীসগঢ়ের দক্ষিণে বস্তার জেলা ও ঝাড়খণ্ডের কোয়েল নদী সংলগ্ন এলাকায়। এই মুহূর্তে দু’টি অঞ্চলই মাওবাদীদের দুর্গ বলে গোয়েন্দাদের রিপোর্ট। ফলে অভিযানের পরিকল্পনায় মশারি-ম্যালেরিয়ার ওষুধের পাশাপাশি অতিরিক্ত চিকিৎসকও নিয়োগ করা হবে। গুরুতর অসুস্থ হলে জওয়ানদের শহরে আনতে হেলিকপ্টারের ব্যবস্থাও থাকবে। এক সিআরপি-কর্তার ভাষায়, “মশা আর মাওবাদী, দুইয়ের বিরুদ্ধেই লড়াই চলবে!” |