মাঝরাতের কোনও ব্যাকরণ নেই
মাঝবয়সের পর মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় মাঝে মাঝেই। কুকুরের চিৎকার। সুকুমার রায়ের মনে প্রশ্ন ছিল কেন সব কুকুরগুলো খামোকা চ্যাঁচায় রাতে? কেন বল দাঁতের পোকা থাকে না ফোকলা দাঁতে? সুকুমার রায় বড় অকালে চলে গেলেন। মাঝবয়সটাও পেরোলেন না তিনি। আর মাঝবয়স না এলে মানব শরীরে দাঁতের ব্যথা-বাতের ব্যথার ঠিকঠাক আত্মপ্রকাশ হয় না। দাঁতের ও বাতের ব্যথার সঙ্গে রাতের সম্পর্কটা বড় নিবিড়। যদিও নিজস্ব অভিজ্ঞতায় নয়, তবে কবির দূরদৃষ্টিতে ইঙ্গিতে বলে দিয়ে গেছেন, ফোকলারা অন্তত দন্তশূলমুক্ত। আগেই বললাম, ব্যথারা রাত্রে বাড়ে। এমনকী বিরহব্যথাও। মাঝরাতের রাগ হল মারোয়া, হংসধ্বনি...। শেয়ালের শিবাধ্বনি নিশ্চয়ই হংসধ্বনিতে গীত হয় না। তবে শেয়ালরা তো রাত্রেই গান গায়। ব্যাং-ও। কী রাগ জানা নেই।
মাঝরাতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কি শুধু দাঁত আর বাত? তা কেন? মেজো ও বড় বয়সি পুরুষরা তো মাঝে মাঝেই বাথরুম যান। যেতে হয়। বিছানায় ফিরে কী চেয়েছি আর কী যে পেলাম ভাবতে ভাবতে, কিংবা নিজেকে জলসাঘরের বেলোয়ারি ঝাড় ভাবতে ভাবতে, জীবনে ঝাড় খাওয়ার হিসেব কষতে কষতে চিন্তা করেন কে আমি? কেন আমি? কোথায় আমি? জীবনের কী কী বাকি রইল ভাবতে ভাবতে গাধার কেন শিং থাকে না, হাতির কেন পালক নেই ভাবতে ভাবতে ভগ্নীসমা পার্শ্ববর্তিনী গিন্নির কণ্ঠে হঠাৎ শোনেন ‘বড্ড নাক ডাকো তুমি’।
শেয়ালরা মাঝরাত্তিরে ডাকে। ওরা নাকি প্রহর ঘোষণা করে। লোকে তো বলে ওরা প্রহরে প্রহরে ডাকে। সারা দিনে অষ্টপ্রহর। মানে, তিন ঘণ্টায় এক প্রহর। ভোর তিনটে থেকে ছ’টা পর্যন্ত প্রথম প্রহর আর রাত বারোটা থেকে ভোর (বা রাত) তিনটে পর্যন্ত অষ্টম প্রহর। তার মানে, পঞ্চম থেকে অষ্টম প্রহর পর্যন্ত রাত্রি। তবে মাঝরাত কখন? ওটা ভূতেরাই ভাল বলতে পারত। তবে ব্যাকরণ অনুযায়ী ষষ্ঠ এবং সপ্তম প্রহর মাঝরাত, অষ্টম প্রহর শেষ রাত। তা হলে দাঁড়াচ্ছে সন্ধে ছ’টা থেকে বারোটা পর্যন্ত মাঝরাত। বারোটা থেকে তিনটে পর্যন্ত শেষরাত। কিন্তু মাঝরাত বলতে ভূত ও ডিটেকটিভ বই আমাদের যে ধারণা দিয়েছে, সেটা ব্যাকরণবহির্ভূত। রাত বারোটার আগে ভূতেরা আড়মোড়া ভাঙে না। আর ডিটেকটিভ বইতে মধ্যরাত্রিতে গুড়ুম আওয়াজ হলে বুঝতেই হবে নির্ঘাত বারোটার পর। শাস্ত্র যা বলুক, বারোটা থেকে তিনটে পর্যন্তই মাঝরাত।
অনেক বাড়িতে রাত ন’টায় চা খাওয়া হয়। শুতে শুতে একটা। তার পর যখনই ঘুম ভাঙে, তখনই মাঝরাত। গাঁ-ঘরে, যেখানে এখনও বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি, ওখানে রাত ন’টার মধ্যেই শুয়ে পড়ার রেওয়াজ। ও-সব জায়গায় রাত এগারোটা/বারোটা মানে মাঝরাত। হাতিরা চা খায় না। পুরুলিয়া-বাঁকুড়া-ডুয়ার্সে রাত আটটা থেকেই হাতিদের ডিনার শুরু হয়ে যায়। চাষের জমিতে। জমি পাহারায় থাকা হাতি-খেদারা পটকা ফাটায়, ক্যানেস্তারা বাজায় মাঝরাত্তিরেই। হয়তো রাত ন’টাতেই।
মাঝরাত্তির নিয়ে বাঙালি মধ্যবিত্তের বেশ একটা মাখো-মাখো রোমান্টিকতা। অনেক কবি মাঝরাত্তিরে কবিতার লাইন পেয়ে যান। অবনীর বাড়ির কড়া নড়ে ওঠে মাঝরাত্তিরে।
মাঝরাত্তিরের বৃষ্টির শব্দে বাঙালির মনে একটা আহামরি ভাব হয়। মাঝরাতের কুয়াশা জড়ানো চাঁদ নিয়ে কত যে কবিতা হয়েছে...। মাঝরাতের বকুল গন্ধ, মাঝরাতের পেঁচা...। জীবনানন্দের কবিতায় থুরথুরে অন্ধ পেঁচা যে বলেছিল, ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জল ভেসে?’ সেটা মাঝরাতেই তো। সেই থেকে বাংলা কবিতার মাঝরাতে পেঁচার আসন পাকা হয়ে গেল। কবিরা লিখছেন ‘পেঁচার পালকের মতো তুমি মাঝরাত হয়ে আছো সুবর্ণরেখা’। কিংবা ‘বিছানায় হিম ঘুমে তুমি, আমি পেঁচা, কোটরে রয়েছি’। জীবনানন্দের ওই একই কবিতার সেই লোকটির বধূ শুয়ে ছিল পাশে, শিশুটিও ছিল, প্রেম ছিল, আশা ছিল, জ্যোৎস্নায় তবু সে দেখিল কোন ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার? ঘুম ভাঙার পর একগাছা দড়ি-হাতে প্রধান আঁধারে সে মাঝরাতে গিয়েছিল অশ্বত্থের কাছে। নদীর কিনারের মধ্যরাতের ছবি দেখেছি কবির চোখে। নীল কস্তুরী আভার চাঁদ, আবার চাঁদ ডুবে গেলে অদ্ভুত আঁধার কিংবা অন্ধকারের জোনাকির ঝিলমিল। শরৎচন্দ্র দেখিয়েছিলেন মধ্যরাত্রের অন্ধকারের রূপ। মাঝরাত কবিতায় মাখামাখি নানা ভাবে। সম্প্রতি একটা বাংলাদেশি ব্লগে পড়লাম ‘এখনও কি মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়? এখনও কি ভাব আমি ভাসছি! তোমার সেলুলার ফোনটাকে তুলে নিয়ে এখনও কি মাঝরাতে ছুটে যাও ছাদে, এখনও কি মাঝরাতে হাওয়া এসে খুলে দেয় চুল?
না কি ভুল, সবই ভুল?’
ঠিক কি ভুল, এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। তবে জানি, মাঝরাতটা বড় সুখের সময় নয়, ফুটপাথ বদল হয় মধ্যরাতে। আর ওই মধ্যরাতের ফুটপাথ বদল-ঘটিত গল্প নিয়ে একটা বোকা রোমান্টিকতা আজও চালু সেটা মধ্যরাতে কলকাতা শাসন করা যুবক সম্পর্কিত।
এক বার এক জন মহিলা কবির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সেলফোন নম্বর আদানপ্রদানও হয়। তার পরের মধ্যরাতে সেলফোন বেজে উঠল। ঘুম চোখে ফোন ধরি। কবি বলেন ‘আমি’ বলছি ‘আমি’। বুঝে যাই। ফোন হাতে ফ্ল্যাটবাড়িতে ছাদে যাওয়া সম্ভব নয়। ব্যালকনিতে যাই। কবি ফোনের ও-প্রান্ত থেকে বলতে থাকেন আহা রাত! আহা রাত! তারা উপচে পড়ছে আকাশে। চাঁদের কাস্তে ধারালো হচ্ছে আস্তে আস্তে। একটু পরে চাঁদ ডুবে গেলে অদ্ভুত আঁধারে আমি একা দাঁড়িয়ে থাকব ছাদে। একটু একটু করে আলো ফুটবে। তখন জুঁইকে মনে হবে জুঁই, মাচার পুঁইকে মনে পুঁই...
গিন্নি আসেন, বলেন, কী হল? পিসিমা বেঁচে আছেন তো? কী বলি তখন? বলি, রং নাম্বার।
গিন্নি বলেন, রং নাম্বারে এত কথা হয়? বুঝি না কিছু? আমি বলি, মাঝরাত্তিরে ঝগড়া ভাল শোনায় না। গিন্নি বলেন, কোথায় মাঝরাত! পৌনে চারটে তো। এক্ষুনি তিন তলার হরিনাম শুরু হবে।
তিন তলায় কর্তামশাই ভোর চারটে থেকে হরিনাম করেন। তাঁর গিন্নি বলেন মাঝরাত্তিরে হরিনাম করো কেন? আমাকেও ঘুমোতে দাও না, তোমার হরিকেও নয়। আবার এক তলায় রাত বারোটা নাগাদ কর্তা-গিন্নির ঝগড়াঝাটি শুরু হয়। ঘুমোতে পারি না। এক বার গিয়ে বললাম, বড্ড চেঁচামেচি করছেন এই মাঝরাত্তিরে, ঘুমোতে পারছি না... ভদ্রলোক বললেন মাঝরাত? অবাক করলেন। এখন তো সন্ধে! সবে তো এক পেগ হল। আর এক বার এক নামী বুদ্ধিজীবীকে ফোন করেছিলাম সকাল সাড়ে আটটায়। উনি ফোনটা ধরলেন, ঘুম জড়ানো গলায় বললেন ফোনটার সুইচ অফ করা হয়নি বলে কি মাঝরাতে ফোন করবেন? কাণ্ডজ্ঞান নেই? বলি, মাঝরাত কোথায়? সাড়ে আটটা তো... উনি বললেন, সাড়ে চারটের সময় শুতে আসি। এগারোটা অব্দি ঘুমোব। এখন মাঝরাত নয়?
বুঝলাম, মাঝরাতের কোনও ব্যাকরণ নেই। নাইট ক্লাবে না গিয়েও বলছি।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.