খেলাধুলা...
ওয়েম্বলিতে ফুটবল, উইম্বলডনে টেনিস, লর্ডসে... তিরন্দাজি
রানির ডায়মন্ড জুবিলি পার্টি সবে শেষ হল—টেমসের নৌকাবহর, বাকিংহাম প্যালেসের কনসার্টের রেশ এখনও মেলায়নি। কিন্তু লন্ডন এর মধ্যেই নতুন নেশার খপ্পরে। ঠিক সকাল এগারোটায় কম্পিউটারের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়া।
রহস্যটা হল, শহরে অলিম্পিক একেবারে দোরগোড়ায়। লন্ডনের অলিম্পিক অর্গানাইজিং কমিটি প্রায় রোজই ওই এগারোটা নাগাদ বিভিন্ন ইভেন্টের কিছু অবিক্রীত টিকিট অন লাইনে বিক্রির জন্য ছাড়ছেন, আর সেগুলো বগলদাবা করার জন্য পুরো লন্ডন হুড়মুড় করে লগ ইন করছে। ভিড়ের চাপে সাইটটাও ক্র্যাশ করছে প্রায়ই! যেহেতু প্রথম বা দ্বিতীয় দফার লটারিতে বেশির ভাগ মানুষের কপালেই কোনও টিকিট জোটেনি, তাই অলিম্পিক যতটা এগিয়ে আসছে যে কোনও ভাবে যে কোনও একটা ইভেন্টের টিকিট পকেটস্থ করার জন্য লন্ডনের রোখটাও ততই চেপে যাচ্ছে। মেনস লাইট ওয়েল্টার বক্সিং কিংবা ক্যানোয়িংয়ে ২০০ মিটার কায়াক ডাবল যা খুশি হোক—ইভেন্টটা কী দেখার দরকার নেই, একটা টিকিট দরকার!
এদিকে কলকাতায় বসে টিকিট পেয়ে গেছেন অনেকেই। ট্র্যাভেল এজেন্সির দৌলতে। যেমন প্রদীপ সেনগুপ্ত। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রাক্তন কর্তা। বলছিলেন, “লন্ডনে যাচ্ছি। এক লাখ টাকায় অলিম্পিক দেখা, লন্ডনে থাকা সব হয়ে যাচ্ছে। আমি অবশ্য তারপর স্কটল্যান্ড, লেক ডিস্ট্রিক্ট আর আয়ারল্যান্ডও ঘুরে আসব। সবই ট্র্যাভেল এজেন্সি দেখছে। আমাদের খালি পকেট মানিটা নিয়ে যেতে হবে।”
বেঙ্গল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের কার্যকরী কমিটির সদস্য অশোক বসুও উত্তেজিত। বেজিং-য়ে উসেইন বোল্টের দৌড় দেখেছিলেন। এ বারেও সে দৃশ্য দেখার জন্য মুখিয়ে আছেন। “তা ছাড়া সিনক্রোনাইজড সুইমিং-এর মতো যে সব খেলা এ দেশে দেখা যায় না, সেগুলো দেখতেই লন্ডন যাওয়া,” বলছেন তিনি।
উসেইন বোল্ট: জামাইকার স্পিড কিং। স্প্রিন্টে পাঁচ বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন।
তিনটে সোনা জিতেছেন বেজিং অলিম্পিকে
লন্ডনের লোকেরা অবশ্য এত শান্তিতে নেই। একান্ত কিছুই না জুটলে অলিম্পিক পার্কের একটা দশ পাউন্ডের টিকিট কেটেই সান্ত্বনা। অন্তত সপরিবারে স্টেডিয়াম চত্বরে গিয়ে হাওয়া তো খেয়ে আসা যাবে! পরে বুক বাজিয়ে নাতিনাতনিকে বলা তো যাবে আমিও ছিলাম।
তুমুল ফেবারিট প্যারিসকে কিস্তিমাত করে সাত বছর আগে যখন লন্ডন এই অলিম্পিকের বাজিটা জেতে তখন থেকেই একটু একটু করে বিল্ড-আপটা শুরু—মাঝে মাঝে তাতে হোঁচট ছিল না বলা যাবে না অবশ্য। কিন্তু এখন উসেইন বোল্টের গতিতে লন্ডন ছুটছে অলিম্পিক আবেগে সওয়ার হতে।
পুরো অক্সফোর্ড স্ট্রিটের শপিং পাড়াটা দেশবিদেশের পতাকায় এখনই মুড়ে গেছে। টিম গ্রেট ব্রিটেনের লাল সাদা নকশার পাশেই পতপত করে উড়ছে দক্ষিণ আফ্রিকার রেনবো। ভারতের তেরঙ্গার পাশেই ঝুলছে মঙ্গোলিয়ার লাল নীল ডোরা। স্ট্র্যাটফোর্ড সিটি, যেটা অলিম্পিকের প্রাণকেন্দ্র, সেখানে ভিউয়িং গ্যালারি থেকে লোকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে মূল স্টেডিয়াম আর অলিম্পিক ভিলেজের দিকে। ছবি উঠছে ফটাফট।
অলিম্পিকের মশাল এখন গোটা বিলেত পরিক্রমা করছে—কর্নওয়ালের সৈকত থেকে স্কটিশ হাইল্যান্ডসের পাহাড়ি ঝরণা, মশাল যেখানেই যাচ্ছে পেছনে পেছনে ছুটছে কাতারে কাতারে লোক। আর লন্ডনের নিউহ্যাম বা টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল—একেবারে গরিবগুর্বোদের মহল্লা—সেখানকার মলিন, রংচটা কাউন্সিল ফ্ল্যাটগুলোর দুয়ারেই এসে হাজির ঝলমলে ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ।’ এই দারুণ স্বপ্নটা তো হার মানাচ্ছে সিন্ডারেলার রূপকথাকেও। সাধে কি আর অলিম্পিক কমিটি পর্যন্ত এসে এই সেদিন সার্টিফিকেট দিয়ে গেছেন। লন্ডনের প্রস্তুতি শেষ একশোর ওপর দুশো ভাগ।

লর্ডসে আর্চারি, কেবল কারে টেমস পাড়ি
ঐতিহ্য আর আধুনিকতাকে অনায়াসে মেশাতে পারে বলে লন্ডনের বরবারের সুনাম। তবে এ বারের অলিম্পিককে কেন্দ্র করে সেই মুন্সিয়ানাটা যেন অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে গেছে। উদ্বোধনী আর সমাপনী অনুষ্ঠানের জন্য যেমন গড়া হয়েছে আস্ত একটা সুদৃশ্য স্টেডিয়াম আর লাগোয়া অলিম্পিক পার্ক, তেমনই শহরের আইকনিক স্পোর্টস ল্যান্ডমার্কগুলোও কাজে লাগানো হচ্ছে বাছাই করা সব ইভেন্টের জন্য। অর্থাৎ ওয়েম্বলিতে ফুটবল, উইম্বলডনে টেনিস, আর লর্ডসে— চমকাবেন না— আর্চারি বা তিরন্দাজি! আসলে ক্রিকেট অলিম্পিকের ইভেন্ট তালিকায় নেই—কিন্তু লর্ডসকে ছাড়া এত বড় ক্রীড়াযজ্ঞ ভাবা যায় না বলেই অগত্যা সেখানে বসছে তিরন্দাজির আসর! ফলে গত বছরও লর্ডসের যে সবুজ গালিচার মতো ঘাস চিরে রাহুল দ্রাবিড়ের কভার ড্রাইভ ছুটে যেতে দেখেছেন, এই মরসুমে সেই মাঠের ওপরই বসানো হচ্ছে পাঁচ হাজার দর্শকের জন্য অস্থায়ী স্ট্যান্ড। তিরন্দাজির চাঁদমারি।
অলিম্পিক শেষ হওয়ার ঠিক পরের সপ্তাহেই লর্ডসে খেলতে নামছে ইংল্যান্ড আর দক্ষিণ আফ্রিকা—বিশ্ব ক্রিকেটের এক আর দুই নম্বর টেস্ট দল। কিন্তু অলিম্পিকের জন্য লর্ডসের বিখ্যাত আউটফিল্ডের যে তার আগেই দফারফা হয়ে যাচ্ছে, সেটা স্বীকার করে নিয়েছে ওই মাঠের অভিভাবক এমসিসি-ও। এখন ক্রিকেট ভক্তরা যদি বিরক্ত হয়ে বলেনও ‘দ্যটস জাস্ট নট ক্রিকেট’—বেশ তো, তার জবাবটা হবে ‘ দ্যাটস অলিম্পিকস, মেইট!’
অলিম্পিকসের জন্য এরকম ছোট বড় আপস আসলে করেছে পুরো শহরটাই! স্ট্র্যাটফোর্ডে রেল স্টেশনের কাছে যে বিরাট এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে অলিম্পিক পার্ক আর অ্যাথলিটদের জন্য অলিম্পিক ভিলেজ, সেটা ছিল পরিত্যক্ত একটা শিল্পাঞ্চল। তিল তিল করে চোখের সামনে ভোল বদলেছে গোটা এলাকাটা— আর যথারীতি অলিম্পিক পার্ক এখন শহরের নতুনতম আকর্ষণ!
এলেনা ইসিনভায়েভা: রাশিয়ার সুন্দরী। মেয়েদের পোল ভল্টে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন।
অলিম্পিকে দু’বার সোনা জিতেছেন।
এর জন্য মানুষের ভোগান্তিও কম হয়নি। রাস্তা, রেল বন্ধ থেকেছে দিনের পর দিন। মার খেয়েছে ছোটখাটো ব্যবসাও। কিন্তু আজ যখন অলিম্পিক পার্কে অভিনব স্থাপত্যের সাইক্লিং ভেলোড্রোমটার দিকে চোখ পড়ছে, মানুষ সব মাফ করতে রাজি! কিংবা ঠিক পাশেই সাঁতার আর ওয়াটার পোলোর জন্য নজরকাড়া একটা অ্যাকোয়াটিকস্ সেন্টার, পাশ দিয়ে তির তির করে বইছে লী নদীর ক্যানাল। আর এক কোণে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ভারতীয় শিল্পী আনিস কপূরের ডিজাইনে তৈরি ‘অরবিট’। প্রায় সওয়াশো মিটার উঁচু এই ইস্পাতের টাওয়ারে কাঁচা মাল আর টাকাকড়ি দিয়েছেন লক্ষ্মী মিত্তল। এই পার্কের ঘা ঘেঁষেই আবার ইউরোপের সবচেয়ে বড় ইন—সিটি শপিং মল ‘ওয়েস্টফিল্ড’। সব মিলিয়ে খেলাধুলোর হইচই, ভরপুর বিনোদন আর ইচ্ছেমতো কেনাকাটার জমজমাট প্যাকেজ—কে-ই বা দিতে পারে লন্ডন ছাড়া?
এরই মধ্যে আবার হুড়মুড়িয়ে চালু হয়ে যাচ্ছে লন্ডনের প্রথম কেবল কার—টেমসের ওপর দিয়ে অসাধারণ পাখির-চোখে দেখা ‘ভিউ’ সমেত আকাশ পথে নদী পারাপার করবে তারে বাঁধা এই গন্ডোলাগুলো। নদীর দক্ষিণ পারে গ্রীনিচ পেনিনসুলার যে ওটু এরিনাতে জাস্টিন টিম্বারলেক বা রিহানা নিয়মিত পপ কনসার্ট করে থাকেন, অলিম্পিকে এবার সেইখানেই বসছে বাস্কেটবল আর জিমন্যাস্টিকসের আসর। তো আপনি যদি সেখানে নতুন নাদিয়া কোমানেচিকে আবিষ্কার করে নদীর অন্য পারে এক্সসেল এগজিবিশন সেন্টারে বক্সিং বা তাইকোন্ডোর ম্যাচ দেখতে ছোটেন, টেমস পেরোতে এমিরেটস এয়ারলাইনের কেব্ল কারই সেরা বাজি!
বাকি রইল খাওয়াদাওয়া। ভিয়েতনামিজ থেকে টার্কিশ, কিংবা চিনে থেকে ইতালিয়ান— ‘মাল্টিকালচারাল’ লন্ডন যে ভূরিভোজের স্বর্গ তা কে না জানে? আর যদি আপনার পছন্দ হয় রগরগে ঝাল চিকেন ভিন্দালু আর সরু লম্বা ধবধবে বাসমতীহাতের কাছেই আছে পূর্ব লন্ডনের বাঙালি পাড়া ব্রিক লেন।
অলিম্পিকের সময় যে তল্লাটের নামকরণ হচ্ছে ব্রিটেনের ‘কারি ক্যাপিটাল’। হাতে একেবারে সময় কম থাকলে যে কোনও মোড়ের দোকান থেকে ব্রিটেনের একান্ত নিজস্ব ফিশ অ্যান্ড চিপস—কুড়মুড়ে হ্যাডক আর ভিনিগার সুবাসিত মোটামোটা আলুভাজা যাকে বলে অলিম্পিকের ষোলো আনা পয়লা উশুল!

বেজিংয়ের টক্কর
আগেই বলেছিলাম, অলিম্পিককে ঘিরে এমন ধুন্ধুমার কিন্তু আগাগোড়া মোটেও ছিল না, বরং প্রথমে তো প্রতি পদে হোঁচট খেয়েছে লন্ডন অলিম্পিকের আয়োজন। ২০১২-র ‘হোস্ট সিটি’ হিসেবে যেদিন লন্ডনের নাম ঘোষণা হল, ঠিক তার পরদিন সকালেই শহরের টিউব আর বাস নেটওয়ার্কে আঘাত হানল জঙ্গিরা। সেদিনের সেই চারটে বোমা হামলায় ঝরে গেল ৬০-টা প্রাণ, আর এই একুশ শতকের দুনিয়ায় পশ্চিমী একটা আধুনিক শহরও যে আর মোটেই নিরাপদ নয়লন্ডনকে সেই বাস্তবটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ‘সেভেন-সেভেন’।
ফলে যেটা হয়েছে, নিরাপত্তার খাতে লন্ডন অলিম্পিকসের বাজেট বেড়ে গেছে হু হু করে। লক্ষ লক্ষ লোকের ভিড়ে যে কোনও সময় জঙ্গিরা আঘাত হানতে পারে, এই আশঙ্কাটা রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে সরকারের। পঞ্চাশ কোটি স্টার্লিংয়েরও বেশি খরচ হচ্ছে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার আয়োজনে, মিলিটারি-মেট্রোপলিটান পুলিশ আর বেসরকারি রক্ষী মিলে অন্তত ৩৫ হাজার জোড়া চোখের নজরদারি থাকছে গেমসের আনাচে-কানাচে। এমনকী, স্টেডিয়ামের কাছাকাছি কয়েকটা বহুতলের ছাদে বসানো হয়েছে অ্যান্টি-এয়ারক্র্যাফ্ট মিসাইল লঞ্চার। ভাবা যায়!
কিন্তু লন্ডনের জন্য সেভেন-সেভেন নয়, আরও বড় অশনি-সংকেতটা এল তারও দু-আড়াই বছর পর, যখন গোটা দুনিয়ার অর্থনীতি হঠাৎ করে রিসেশনের ধাক্কায় মুখ থুবড়ে পড়ল। বিশ্বের ব্যাঙ্কিং ব্যবসার পীঠস্থান লন্ডনে সেই আঘাতটা একটু বেশি জোরেই লাগে, যার জন্য বেশ খানিকটা টলমল হয়ে যায় অলিম্পিকসের দৌড়টা! ব্রিটেন সহ সারা ইউরোপে যখন সব সরকার নির্মমভাবে খরচে কাটছাঁট করছে, কোপ পড়ছে মানুষের বেতন-ভাতা-পেনশনেতখন অলিম্পিকের মতো রাজসূয় আয়োজনে বিপুল খরচ করাটা কতটা যুক্তিযুক্ত, সে প্রশ্ন ওঠাটা খুবই সঙ্গত, আর উঠছেও!
আসলে লন্ডনের অলিম্পিক ভাগ্য আর এই আর্থিক টানাটানির বোধহয় অদ্ভুত একটা সম্পর্ক আছে। শেষবার যখন লন্ডনে গেমস হয়েছিল, ৬৪ বছর আগের সেই অলিম্পিকের ঠিক আগেই থেমেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বাতাসে তখনও বারুদের গন্ধ, খাবারের রেশনিং চলছেসে সময় লন্ডনের অলিম্পিককে বলা হয়েছিল ‘অস্টারিটি গেমস’ বা কৃচ্ছ্রসাধনের গেমস। একটা অ্যাথলিট ভিলেজ পর্যন্ত বানানো যায়নিআর্মি ব্যারাক আর কলেজ ডর্মিটরিগুলোতেই মাথা গুঁজতে হয়েছিল প্রতিযোগীদের, বলা হয়েছিল নিজেদের তোয়ালে পর্যন্ত দেশ থেকে নিয়ে আসতে!
সেই ’৪৮-এর লন্ডন গেমসেই সদ্য-স্বাধীন ভারতের হয়ে খালি পায়ে ফুটবল খেলতে নামেন শৈলেন মান্নারা। বুটপরা ফ্রান্সকে প্রায় হারিয়েও দিয়েছিলেন তাঁরা। আজ এত বছর বাদে শিলিগুড়ির কিশোর সৌম্যজিৎ তার টেবিল টেনিস র্যাকেট নিয়ে কিংবা নাগেরবাজারের জয়দীপ কর্মকার যখন শু্যটিংয়ের সরঞ্জাম নিয়ে গেমসে যোগ দিতে আসবেনশৈলেন মান্নাদের মতো অতখানি কষ্ট অবশ্য তাঁদের না করলেও চলবে, ভরসা দিয়েছে আয়োজক কমিটি। কমিটির প্রধান সেবাস্টিয়ান কো নিজে দু’বারের অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন দৌড়বীর, জানেন অ্যাথলিটদের কতটুকু স্বাচ্ছন্দ্য প্রয়োজনকাজেই অলিম্পিক ভিলেজে বিলাস না থাকুক, খুব বেশি কষ্টও করতে হবে না।
এই খচখচানিটাও হয়তো থাকত নাযদি না চার বছর আগের বেজিং অলিম্পিকস জাঁকজমকে আর চোখধাঁধানো কারিকুরিতে সারা দুনিয়াকে চমকে দিত! ২০০৮-য়ে বেজিংয়ে বার্ডস নেস্ট স্টেডিয়ামে প্রযুক্তি, বৈভব আর কলাকুশলতার যে নজির দেখিয়েছিল চিন, অলিম্পিকের ইতিহাসে সত্যিই তার কোনও তুলনা নেইআর তাতে অবধারিত ভাবে একটা পরোক্ষ চাপও তৈরি হয়ে গেছে লন্ডনের ওপর। লন্ডনের ভালই জানা আছে, যেমনই অলিম্পিক করুক তারা, বেজিংয়ের তুলনাটা আসবেইআর খরচের বহরে অন্তত বেজিংকে টেক্কা দেওয়ার কথা ভাবাই যাবে না।
তো এই সঙ্কটের একটা নিজের মতো সমাধানও বাতলে নিয়েছে লন্ডনপ্রযুক্তির চমক নয়, নিজেদের সাবেকি ট্র্যাডিশনে ভর করেই তারা বাজিমাত করতে চাইছে অলিম্পিকসে। ‘স্লামডগ মিলিওনেয়ার’-এর পরিচালক ড্যানি বয়েল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের যে নকশা করেছেন, তাতে তাই প্রাধান্য পাচ্ছে ইংলিশ কান্ট্রিসাইডের থিম, বিখ্যাত গ্রামীণ সৌন্দর্যের টুকরো টুকরো ছবি। অতএব নিশ্চিন্ত থাকুন, অলিম্পিকের ব্রিটেন তার বনেদিয়ানা বিসর্জন দেবে নাজলসাঘরের ছবি বিশ্বাসের মতোই লন্ডন গেমস করে দেখাবে নিজের মেজাজে, নিজের আভিজাত্যে।

ঠিকানা একটাই লন্ডন
এ বারের গেমসে অন্যতম স্পনসর ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ। প্লেন চালানোর ব্যবসা তাদের, অথচ তারাই কিনা পেল্লায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ব্রিটেনকে বলছে, প্লিজ, এ বারের জুলাই-অগস্টে কোত্থাও যাবেন না; অলিম্পিকস উপভোগ করুন আর নিজের টিমকে চুটিয়ে সাপোর্ট করুন! অলিম্পিকের আপনাকে খুব দরকার।
ভারতীয় চ্যালেঞ্জ
বিজেন্দ্র সিংহ অভিনব বিন্দ্রা
এর পরও হয়তো ছোটখাটো ভুলচুক রয়েই যাবে, রোজ প্রায় সওয়া তিন লাখ বাড়তি লোকের ভিড় সামলাতে লন্ডনের মান্ধাতার আমলের টিউবও হঠাৎ ছুটি নিলে অবাক হবেন না। এমনকীপাতাল রেল বা বাসের ড্রাইভাররা দুম করে স্ট্রাইকও করে বসতে পারেন, কারণ লন্ডনের সেটাই দস্তুর। গেমসের প্রতিযোগী বা কর্মকর্তাদের জন্য রাস্তায় থাকছে অবশ্য আলাদা ভিআইপি লেন, কাজেই তাঁদের অন্তত ট্র্যাফিকে আটকে হাঁসফাঁস করার ভয় নেই। দু’সপ্তাহের পুরো গেমসটাও সেই ভিআইপি লেনের মতোই তরতরিয়ে এগোক, লন্ডনের এখন প্রার্থনা সেটুকুই।
অলিম্পিককে ঘিরে লন্ডনে এখন যে তুলকালামটা চলছে, আগামী চার সপ্তাহে সেটা ক্রমশ ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছবে সন্দেহ নেই। তারপর যখন উসেইন বোল্ট ১০০ মিটারের স্টার্টিং লাইনে দাঁড়াবেন বা হেপ্টাথলিট জেসিকা অ্যানিস জ্যাভেলিন নিয়ে দৌড়তে শুরু করবেন, লন্ডনের মনে হবে গত কয়েক বছরের কষ্টটা সার্থক।
আবার ব্রিটিশ এয়ারওয়েজকে ধার করেই বলি, ‘দেয়ারস নোহোয়্যার এল্স ইন দ্য ওয়ার্ল্ড টু বি দিস সামার’এ বারের গরমে গন্তব্য একটাই, আর সেটা লন্ডন!
শহরে টিউব চলুক না-চলুক, আজ অলিম্পিক!


এক লাখে অলিম্পিক
উসেইন বোল্ট এবং মাদাম তুসো, টাওয়ার অফ লন্ডন আর উইম্বলডন কোর্টে ফেডেরার = ১ লাখ টাকা (প্রায়) মাথাপিছু। এখান থেকে অলিম্পিক দেখতে যাওয়ার ব্যবস্থা করছে অনেক সংস্থাই। টমাস কুক আছে। ট্র্যাভেল প্ল্যানার্স নামে কলকাতার একটি সংস্থাও আছে। কী রকম প্যাকেজ? “১০ দিনের,” বলছেন ট্র্যাভেল প্ল্যানার্সের সৌমেন সিংহরায়। প্লেনে ওঠা ৩ অগস্ট। তারপর লন্ডন। এক লাখের মধ্যে আসা-যাওয়ার বিমানভাড়া, লন্ডনে হোটেলে বা গেস্ট হাউসে থাকা, ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা, আর অলিম্পিকে ফুটবল, সাঁতার, বক্সিং, হকি, কুস্তি, অ্যাথলেটিকস্ দেখার টিকিট, পুরোটাই ধরা আছে। দশ দিনের ট্যুর। এর বাইরে স্কটল্যান্ড, লেক ডিস্ট্রিক্ট ঘুরতে হলে খরচ আরও প্রায় ৭০,০০০ টাকা মাথাপিছু।
ট্র্যাভেল প্ল্যানার্সের যোগাযোগ: ০৩৩-২২৪৮৮৩০৪/৫/৬।
টমাস কুকের যোগাযোগ: ০৩৩-৬৬৩৪৬৮৫৯/৬৪৫০০৬৯৯

নিজে যেতে চাইলে
বিমানভাড়া: কলকাতা থেকে এমিরেটস, জেট এয়ারওয়েজ, কাতার বা এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট রোজ লন্ডন যাচ্ছে, একপিঠের ভাড়া মোটামুটি ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা মাথাপিছু। একটু সস্তা হতে পারে বাংলাদেশ বিমান। এর সঙ্গে যোগ করুন ভিসা ও আনুষঙ্গিক খরচ, আরও প্রায় হাজার দশেক টাকা।

আস্তানা: স্বস্তির কথা হল, অলিম্পিকের সময় লন্ডনে যে ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই রব উঠবে ভাবা হয়েছিল অবস্থাটা তত বেগতিক নয়। বরং Expedia, Lastminute ডটকমের মতো ওয়েবসাইটে অনেক হোটেলই অলিম্পিক মরসুমে ভাড়া কমাচ্ছেদিনে একশো বা সওয়াশো পাউন্ডে (প্রায় হাজার দশেক টাকা) লন্ডনে ব্রেকফাস্ট সমেত একটা ডবল রুম জোটানো খুব শক্ত নয়।

এর পাশাপাশি রয়েছে ‘হোমস্টে’ বা ‘সেল্ফ কেটারিং অ্যাপার্টমেন্ট’ ভাড়া নেওয়ার সুযোগ। হোটেলের চেয়ে অনেক ঘরোয়া, তুলনায় সস্তাও পড়ে অনেকে মিলে থাকলে আর দিনের শেষে বাঙালি চাইলে চাট্টি ডালভাত ফুটিয়ে নিয়ে পেটটাও ঠান্ডা রাখতে পারে। Homeaway, Holidaylettings বা Rentduringthegames-এর মতো ওয়েরসাইটে সার্চ করলে পছন্দসই একটা বাড়ি ভাড়া পাওয়া খুব শক্ত হবে না।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.