ব্যাগ গুছিয়ে... মেঘ নামে পাহাড় গড়িয়ে
বেলা প্রায় দুটো। আমার জিপ বেশ কিছুটা সময় আগে করোনেশন ব্রিজ ছাড়িয়েছে। তিস্তার দুষ্টুমির সঙ্গে তাল রেখে মন চলেছে। কালিম্পং পার হয়ে এন এইচ ৩১-বি ধরে পেডং-এর রাস্তাকে ডান হাতে ফেলে রেখে আমার গাড়ি যে-রাস্তা ধরল তাকে গাড়ি-চলা রাস্তা না বলাই ভাল। দু’পাশে পাইনের সবুজ বিন্যাসের মাঝে পাথর-রঙা সীমান্ত আকাশি নীল পাড়ের বর্ষার মেঘরঙা শাড়ির ঘোমটার আড়ালে কোথায় যেন হারিয়েছে। একটা বুনো গন্ধ আর ভেজা হাওয়ার চুমু এক নিমেষে মনটাকে ভাল করে দিল। আমি এসে নামলাম সিরেলিগাঁওতে।
কতই বা বয়স হবে তার, বড়জোর দুই কি তিন বছর! কিন্তু এর মধ্যেই যাঁরা বেড়াতে গিয়ে একটু অন্য রকম জায়গার কথা ভাবেন, তাঁদের নয়নের মণি। সাকুল্যে তিরিশটি ঘর। নিস্তব্ধতায় ভরপুর। সিরেলিগাঁওয়ের মানুষগুলো কেমন পাহাড়ি আকাশের মতো সরল। আর ছোটদের হাসিগুলো? যেন নিডল পাইনের পাতার ডগায় আটকে থাকা বৃষ্টিজলের কুচির মতো, সব সময় ঝিকমিক করছে। সারা দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করা মানুষগুলোর ভালবাসায় কোনও খামতি নেই। আপনাকে বুঝতেই দেবে না যে, আপনি নতুন মানুষ সেখানে।
ইতিহাস বলে, দূর অতীতের কোনও এক সময়ে ভুটানের পরিচিতি নিয়েই ছিল এই গ্রাম। এখন অবশ্য আমাদের রাজ্যের বন দফতরের জমিতে তার অবস্থান। আপনি যদি ভাল হোটেল খোঁজেন, ভুল করবেন। এখানে ‘হোম স্টে’ প্রথাতেই থাকতে হয় গ্রামে।
সিরেলিগাঁওয়ের প্রথম গোধূলিতে বছর আটেকের উমকুমারের সঙ্গে পায়ে পায়ে স্কুলবাড়িটা ছাড়িয়ে নিচু জঙ্গলের পথ ধরি। পাহাড়ি হলুদ-রঙা স্ট্রবেরি ছিঁড়ে খাওয়া থেকে নিচু রডোডেনড্রনের ডালের ফাঁকে জড়িয়ে থাকা পুরনো মসের ভিতরে পাখির বাসা খুঁজে বের করা শুরু হয়। উঁকি দিতেই অবাক! ছোট্ট একটা ছানা যে চোখটা একটুকু ফাঁক করে হলুদ দুটো ঠোঁটে সদ্য রোঁয়া-ওঠা ডানা নাড়াচ্ছে। কখনও বা ছত্রাক পরিবার...অজস্র বুলবুল...নেমে আসতে থাকা সন্ধ্যা। এ বার ফিরতে থাকা। আমার ঠাঁই হয়েছে বীরু তামাং-এর বাড়িতে। সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত এখানে আলো জ্বলে। বীরুর পরিবারের প্রতিটি সদস্য আন্তরিক। রাতের খাওয়া-শেষে বীরুর কাছে গল্প শুনি এ গ্রামের।
পরদিন সকালে ক্যামেরা আর ন্যাপস্যাক নিয়ে তৈরি। জলখাবার সেরে প্রথমে দেড় কিলোমিটার দূরে রামিতেদাড়া ভিউ পয়েন্ট। জঙ্গলের মাঝে পায়ে চলা পথ। সঙ্গী আজ ছোট্ট হৃত্বিক। জোঁক ছাড়ানোর জন্য একটা ছোট পুঁটলিতে নুন নিয়ে বীরদর্পে পথ দেখায়। নাম না-জানা কত ফুল, স্নেক লিলি, বড় বড় পাইন, ‘ব্রেইন ফিভার’-এর ডাকসব মিলিয়ে কেমন আচ্ছন্ন করে রাখে। কখন যে পৌঁছে যাই ভিউ পয়েন্টে, বুঝতেও পারি না। দূরে চোখ মেলি। পাহাড়, নদী মিলে প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্য। দূরে তিস্তা যেন পাহাড়ের কোলে জলছবি, অন্য পাশে রংপো। একটু পরেই মেঘেরা পাহাড় গড়িয়ে নেমে এসে ভাসতে শুরু করে। ঢাকা পড়ল তিস্তা, আমিও। ফিরতি পথে বাড়ি না গিয়ে গ্রাম থেকে আরও দু’কিলোমিটার হাঁটাপথে ডামসিঙ দুর্গ, এখন একেবারে ভাঙাচোরা। এ দুর্গ ছিল ভুটানের রাজার। এখানে পাহাড়ি মানুষদের মেলা বসত, চলত বিকিকিনি। পায়ের নীচে ভেজা পাতা মাড়িয়ে এই খণ্ডহরে যখন পৌঁছবেন তখন মন বলবেআহা, যদি ওই রাজ সিংহাসনে একটু বসা যেত! যত দেখবেন, ততই ভালবেসে ফেলবেন ওই জঙ্গলকে। তবে, একটু পা চালিয়ে ভাই! না হলে জোঁকেরা ছেড়ে কথা কইবে না।
দ্বিতীয় দিনে সকাল সকাল বেরিয়ে প্রায় চার কিলোমিটার পথ উজিয়ে পাইনের বন ভেঙে গাঢ় সবুজে ডুব দিতে দিতে পৌঁছলাম ‘সাইলেন্ট ভ্যালি’। ছোট্ট একটা জলাশয়, প্রচণ্ড গরমে সে আবার শুকিয়ে যায়। তার চার পাশে শান্ত সবুজ এক টুকরো উপত্যকা। তার সীমানা জুড়ে পাইনেরা। এখানে কথা বলতে ইচ্ছে করে না, সার্থক নামকরণ। কয়েকটা বাঁদর চুপিচুপি দেখে যায় আমাদের। এ উপত্যকায় ঝিঁঝিঁদেরও কোনও সাড়া নেই। এর পরে ‘তিনচুলে’। হঠাৎ চড়াইয়ে বেদম। বীরুর বড় মেয়ে দুর্গা আজ আমার সঙ্গী। তারই উৎসাহে এগিয়ে চলি। অবশেষে অসংখ্য প্রজাপতির ডানার রং মাখতে মাখতে ‘অপু’কে নিয়ে দুর্গা হাজির তিনচুলের মাথায়। দূরে সিলেরিগাঁও, অন্য দিকে পেডং। মনে হচ্ছে, কোনও এক ‘রেইন ফরেস্টে’র মাথায় বসে আছি। চার দিকে শুধু সবুজ আর সবুজ।
রাতে খাওয়ার শেষে ঘরে ঢুকতেই বৃষ্টি নামল। বৃষ্টির পরে একফালি চাঁদ উঠল পশ্চিম আকাশে। সাদা মেঘেরা ঘিরে তাকে। আমি চুপটি করে দাঁড়িয়ে ঘরের দরজায়। চাঁদ নেমে আসে পশ্চিমের নীচে। এক ফোঁটা জল আমার চোখ থেকে নেমে পায়ের কাছের মাটি ভেজায়। অনেকগুলো চেনা-অচেনা পাখি ডাকতে থাকে। ভোরের লাল আলো আকাশ ছিঁড়ে হামা দিচ্ছে সিরেলিগাঁওয়ের মাটিতে। কাঞ্চনজঙ্ঘা একটু মুচকি হেসে আবার মেঘের চাদরে নিজেকে ঢেকে রেখে স্বপ্ন দেখে।
বীরু তামাং-এর পোষা মোরগটা প্রহর ঘোষণা করে। এ বার ফেরার পালা।

কী ভাবে যাবেন
শিলিগুড়ি থেকে শেয়ার জিপে পেডং বা কালিম্পং হয়ে সিরেলিগাঁও। এই শেষটুকুর জন্য গাড়ি ভাড়া
করতে হতে পারে। অথবা শিলিগুড়ি-এন জে পি থেকে সরাসরি গাড়ি ভাড়া করে সিরেলিগাঁও।
কোথায় থাকবেন
এখানে ‘হোম স্টে’ প্রথায় থাকা-খাওয়ার নানা ব্যবস্থা রয়েছে।
কখন যাবেন
বর্ষার সময়টুকু বাদ দিয়ে যাওয়া যায়। শীতে জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়ে।
কী করবেন না
প্লাস্টিক ফেলে আসবেন না।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.