|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
জীবন এবং শিল্পদর্শনের অপূর্ব মেলবন্ধন |
সম্প্রতি জাতীয় গ্রন্থাগারে অনুষ্ঠিত হল ‘ট্রেজার্স অব এনসেন্ট চায়না’ শীর্ষক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ। |
প্রাচীন চিনের শিল্পকলা নিয়ে সমৃদ্ধ প্রদর্শনী হয়ে গেল কলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগারে। প্রদর্শনীটি আয়োজিত হয়েছে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া এবং চিনের স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব কালচারাল হেরিটেজ-এর যৌথ উদ্যোগে। দিল্লি, মুম্বই ও হায়দরাবাদের পর প্রদর্শনীটি এসেছে কলকাতায়। ভারত ও চিনের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের প্রকল্পে আয়োজিত হয়েছে এই প্রদর্শনী। এর আগে ২০০৬-০৭ সালে ভারত থেকে চিনে গিয়েছিল ‘ট্রেজার্স অব এনসেন্ট ইন্ডিয়া’ শীর্ষক প্রদর্শনী। প্রাচীন ভারতের ১০০ শিল্পসামগ্রী দেখানো হয়েছিল সেখানে। প্রদর্শিত হয়েছিল চিনের চারটি শহরে। তারই বিনিময়ে ‘ট্রেজার্স অব এনসেন্ট চায়না’ শীর্ষক এই প্রদর্শনী। এতে দেখানো হয়েছে চিনের নব্য-প্রস্তর যুগ থেকে শুরু করে ক্যুইঙ-এর রাজত্বকাল পর্যন্ত মোট ৯৫টি নানা রকম শিল্পবস্তু।
এই প্রদর্শনী দেখতে দেখতে অনুভব করা যায় চিনের জীবনদর্শন ও শিল্পদর্শনের মধ্যে একটা মিল আছে। তেমনই নানা বিবর্তনের মধ্যেও এই দেশের নন্দনচেতনার ভিতর এক ধরনের কেন্দ্রীয় ঐক্য রয়েছে। চিনের প্রাচীন অধ্যাত্মদর্শন অনুযায়ী মানুষ এই বিশ্বপ্রবাহের প্রধান নিয়ন্ত্রক নয়। বিপুল প্রকৃতির সে একটি অংশ মাত্র। প্রকৃতির সঙ্গেই সম্পৃক্ত। এখানেই পাশ্চাত্য জীবনবোধের সঙ্গে চিনের পার্থক্য। পাশ্চাত্যে মানুষকেই মনে করা হয় বিশ্বপ্রবাহের নিয়ন্ত্রক। মানুষের বোধ ও মেধাই যেন বিশ্বকে পরিচালনা করে। ভারতীয় শিল্পদর্শনের সঙ্গেও চিনের পার্থক্য আছে। ভারতীয় শিল্প সব সময়ই প্রয়াসী হয়েছে রূপ ও অরূপের মধ্যে সংযোগ ঘটাতে। রূপের ভিতর দিয়ে অরূপকে অভিব্যক্ত করতে। চিনে সে রকম নয়। চিনের শিল্পদর্শন মনে করে পার্থিব বস্তুরূপ ও অপার্থিব ‘পরম’-এর মধ্যে রয়েছে অনতিক্রম্য ব্যবধান। শিল্পবস্তু কখনও সেই ব্যবধানের মধ্যে সেতু রচনা করতে পারে না। শিল্পের কাজ শুধু বিশ্বপ্রবাহের নিহিত ছন্দটিকে উন্মীলিত করা। মানুষের চেতনায় সেই ছন্দের বোধ সঞ্চারিত করা। সেই সৌন্দর্যের কাছে মানুষকে বিনত হতে প্রাণিত করা। এই জন্য ভারতীয় শিল্পের মধ্যে শরীরী সৌন্দর্যের যে ঝংকার আছে, দিদারগঞ্জের যক্ষীতে বা সাঁচির তোরণের নগ্নিকা মূর্তিতে পার্থিব রূপ ও অরূপের যে সেতু অনুভব করা যায়, চিনের শিল্পে তা নেই।
|
|
প্রদর্শনীর ভাস্কর্য |
প্রদর্শনীটি শুরু হয় নব্য-প্রস্তর যুগের মানুষের ব্যবহৃত পাথরের অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে। চিন যে প্রস্তর যুগ পেরিয়ে এসেছে এই কথাটা ১৯২১ সালের আগে প্রায় জানাই ছিল না। সে বছর সুইডিশ ভূতাত্ত্বিক জে গানার অ্যান্ডারসন ও তাঁর সহযোগী চৈনিক গবেষকরা এমন কিছু প্রত্নবস্তু আবিষ্কার করেন, যার সূত্র ধরে খননকার্যের ফলে আবিষ্কৃত হয় প্রাচীন চিনের মানবিক অস্তিত্বের নানা নিদর্শন। তারই পরিচয় পাওয়া যায় এই পাথরের অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে। সেই আদি মানুষের দক্ষতা ও সৌন্দর্যবোধ আজও আমাদের বিস্মিত করে।
যে অপার্থিব ছন্দের বিন্যাস চৈনিক শিল্পের প্রধান সম্পদ, তার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ পাওয়া যায় মৃৎপাত্রে। এই চিত্রিত মৃৎপাত্রের আকার ও রূপের অনবদ্য বৈচিত্র মুগ্ধ করে। চিনে ব্রোঞ্জ ব্যবহারের ইতিহাস অতি প্রাচীন। অষ্টাদশ থেকে তৃতীয় খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত শ্যাং ও ঝৌ বংশের রাজত্বকালে ব্রোঞ্জ শিল্প উন্নতির শিখরে পৌঁছায়। ব্রোঞ্জে তৈরি অস্ত্রশস্ত্রের নিদর্শন যেমন রয়েছে প্রদর্শনীতে, তেমন রয়েছে কারুকার্য খচিত ব্রোঞ্জ পাত্রের নিদর্শনও। রয়েছে ব্রোঞ্জের তৈরি আয়না ও চুলের কাঁটার নিদর্শন। চুলের কাঁটার শেষাংশের কারুকাজ দর্শনীয়। চিনের সিরামিকস ও পোর্সেলেন জগৎ-বিখ্যাত। প্রায় ৩৫০০ বছর আগে শ্যাং রাজত্বকালে পোর্সেলেনের ব্যবহার শুরু হয়। সেটা বিকশিত হয় হান (২০২ খ্রিঃ পূঃ২২০ খ্রিঃ), তাঙ, সুঙ থেকে কুইঙ রাজত্বকাল পর্যন্ত।
ভারতের সঙ্গে চিনের সম্পর্ক সুদীর্ঘ, প্রায় দুই সহস্র বছর ব্যাপ্ত। বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ চিনের শিল্পকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করে। বৌদ্ধদর্শন চিনের জীবনদর্শনেও কিছু রূপান্তর আনে। কিন্তু সবটাই ঘটেছে ওই দেশের মূলগত তাত্ত্বিক কাঠামোর উপর। চিনের নিজস্ব যে সৌন্দর্যবোধ, যা আরও বহু আগে থেকে প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে, সেই ভিত্তিগত বোধের খুব একটা পরিবর্তন ঘটেনি। তাই ওয়েই যুগের (৩৮৬৫৫৬ খ্রিঃ) ‘বোধিসত্ত্ব’, মিঙ যুগের ‘অবলোকিতেশ্বর’ বা ক্যুইঙ যুগের (১৬৪৪১৯১১ খ্রিঃ) ‘শাক্যমুনি’ শীর্ষক ভাস্কর্যে চৈনিক প্রজ্ঞার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ থাকলেও, তা ভারতীয় বোধের থেকে একেবারেই আলাদা। যে অভাবের জন্য প্রদর্শনীটি সীমাবদ্ধ থেকে গেছে, তা হল চৈনিক চিত্রকলার নিদর্শন এখানে বিশেষ কিছু দেখা যায়নি। |
|
|
|
|
|