রবিবাসরীয় প্রবন্ধ
ঠিক দুশো বছর আগে
বে ভোরের আলো ফুটছে, সবে শুরু নতুন দিন, ২৪ জুন ১৮১২। ইতিহাসের বিধাত্রী দেবী তাঁর যুগযুগান্ত-লম্বা খেরোর খাতাটিতে যে কয়টি দিনকে আলাদা করে লাল দাগে দাগিয়ে রেখেছেন, তেমনই একটি দিন। সসাগরা ইউরোপ মহাদেশের ভাগ্যচক্র সে দিন এক লাফে উল্টো দিকে ঘুরতে শুরু করল, কাকপাখি টের পেল না। আলো ফুটতে না ফুটতেই নিয়েমেন নদীর ধারে ধ্বনিত হয়ে উঠল উদাত্ত আহ্বান, সচকিত হয়ে উঠল আধোঘুমে আধোজাগা লক্ষকোটি সৈন্যসামন্ত, যারা ২২ জুন নদীতীরে পৌঁছে ধৈর্য ধরে অপেক্ষায় রয়েছে, কখন তাদের মহামহিম সম্রাটের ডাক আসে। সত্যিই যখন এল সেই ডাক, অতগুলি মানুষের গায়ে যেন বিদ্যুৎতরঙ্গ খেলে গেল, রক্ত প্রবাহিত হল দ্বিগুণ বেগে, কী অসামান্য কাজ নিয়ে আজ তারা মহাদেশের প্রান্তভূমির দিকে ধাবমান, সে কথা ভেবে নতুন করে রোমহর্ষণ হল। শুনল তারা: “সৈন্যগণ! যুদ্ধ তবে শুরু... রাশিয়া ডাক দিয়েছে, দুর্ভাগ্যকে আহ্বান করছে সে। তাকে সমুচিত জবাব দিতে হবে। অসম্মান নয়তো যুদ্ধ কোনও একটাকে বেছে নিতে আমাদের বাধ্য করছে তারা। আমরা কী বেছে নেব, তা নিয়ে নিশ্চয়ই কোনও প্রশ্ন উঠতে পারে না! সুতরাং চলো! চলো, আমরা নিয়েমেন পার হই!”
Let us cross the Niemen! এই শব্দবন্ধটি ভবিষ্যতে বার বার ব্যবহার হবে পরম কিংবা চরম অভিযান বোঝাতে, নিয়তির দুর্নিবার চক্রব্যূহ বোঝাতে, ট্র্যাজিক অন্তিমতার নির্দয় সূচনা বোঝাতে। কিন্তু সে তো ভবিষ্যতের কথা। সে দিন সেই ডাক শোনামাত্র অক্ষৌহিণী বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল নিয়েমেনের জলে, রাশিয়া আর পোল্যান্ডের মাঝখানে বেলারুস অঞ্চল থেকে বেরিয়ে যে নদী উত্তরপানে বয়ে মোহনা খুঁজে পেয়েছে বরফশীতল বলটিক সাগরে, জুনের গ্রীষ্মদিনেও যার জল কাঁপিয়ে দেয় সমস্ত শরীর। সেই নিয়েমেন নদী পেরিয়ে চলল রাজচক্রবর্তী সম্রাট নেপোলিয়নের ‘গ্রঁদ আর্মে’ (গ্র্যান্ড আর্মি)। আন্দাজ পাঁচ লক্ষ মানুষের কণ্ঠে মুহুর্মুহু রব উঠল ‘ভিভ্ ল্যম্পেরর্’ (লং লিভ দি এমপেরর)! কোলাহল, জয়ধ্বনি, উল্লাস নেপোলিয়ন, তাঁর বহু বিজয়সমর-খ্যাত সেনাধ্যক্ষদল, তাঁদের অধীন লক্ষ লক্ষ ভাগ্যান্বেষী সৈনিক, কেউই জানলেন না এই যে নদী পার হলেন তাঁরা, আর ফিরবেন না অধিকাংশই, আর যদি বা ফেরেন, ফিরবেন ভগ্ন ধ্বস্ত বিপর্যস্ত হয়ে। ভাবতেও পারলেন না, এই নদী পার হতেই তাঁদের ভাগ্যাকাশ সহসা ঘোর তমসায় ঢেকে গেল, যা কিছু অজেয়, অলঙ্ঘ্য বলে জানতেন তাঁরা, সে সব কিছুতে চিড় ধরল। ‘নেপোলিয়নিক এম্পায়ার’ মধ্যগগন থেকে এক লাফে সোজা সূর্যাস্তের পথে যাত্রা করল।
এই সেই মহাকাব্যিক যুদ্ধযাত্রা, রাশিয়ার জার প্রথম আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়নের অভিযান, আজ থেকে ঠিক দুশো বছর আগে। মহাকাব্যিক? হ্যাঁ... এত বিপুল ও বিশাল যুদ্ধ তখনও পৃথিবী আর দেখেনি, তাই মহাকাব্যিক। এমন মর্মান্তিক ট্র্যাজিক, তাই মহাকাব্যিক। প্রেম ও ঘৃণার জটিল দ্বন্দ্ব সে যুদ্ধের পরতে পরতে, তাই মহাকাব্যিক।

হঠাৎ একটি খরগোশ
আশ্চর্য! গতকাল যা ঘটল, তা সত্যিই আশ্চর্য। ভাবছিলেন কলেঁকুর। গতকাল, ২৩ জুন, নিয়েমেনের ধারে ঘোড়ার পিঠে টহল দিচ্ছেন সম্রাট নেপোলিয়ন, হঠাৎই একটি খরগোশ দৌড় মারল তাঁর ঘোড়ার পায়ের ফাঁক দিয়ে! ঘোড়া চমকে তার পা টেনে নিল, হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন নেপোলিয়ন। হ্যাঁ, দোর্দণ্ডপ্রতাপ সম্রাট, সদাতীক্ষ্ণ সদাসতর্ক নেপোলিয়ন, পড়ে গেলেন। কিন্তু সেটাই আসল আশ্চর্য নয়। এমন ঘটনা ঘটলে কী করার কথা সম্রাটের? ঘোড়া, খরগোশ, নদীতীর সর্বদিকে ধাবিত হবে তাঁর তীব্র ভর্ৎসনা, এই তো স্বাভাবিক? কে না জানে, নেপোলিয়নের মেজাজ? কিন্তু সে দিন, নীরবে, একটি শব্দও উচ্চারণ না করে, গা ঝেড়ে আবার লাফিয়ে ঘোড়ায় উঠে গেলেন তিনি, যেন কিছুই হয়নি, তার পর ঘোড়া ছুটিয়ে সামনে চলে গেলেন। এত নীরবতা? এত দুশ্চিন্তা? বারো বছরেরও বেশি নেপোলিয়নের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী কলেঁকুর, কত দিনরাত কেটেছে তাঁদের একত্র মন্ত্রণায়, কত আস্থাভরে নেপোলিয়ন তাঁকে রাশিয়ায় জারের সভায় দূত (কিংবা গুপ্তচর!) হিসেবে নিযুক্ত করেছেন, কত বার তিনি নেপোলিয়নকে সাবধান করেছেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করতে। ২৩ জুন অবাক ব্যথিত কলেঁকুর ভাবছিলেন, “সম্রাটকে এতখানি চিন্তান্বিত কখনও দেখেছি কি?” খেলাচ্ছলে যিনি কঠিনতম যুদ্ধ জিতে আসেন, দক্ষ খেলোয়াড়ের অভ্রান্ত চালে অনায়াসে পর্যুদস্ত করে দেন বিপক্ষকে, কেন তিনি আজ এমন উদ্বিগ্ন? সারাটা দিন যে আর তাঁকে দেখা গেল না, কোথায় কোন চিন্তায় ডুবে রইলেন তিনি?
নিয়েমেন পার হয়ে বাহিনী এগিয়ে চলল বীরদর্পে, মাঝেমধ্যেই রুশ সেনা বা পুলিশ চোখে পড়লে নিজেরাই হাঁক দিল ‘কে যায়’, নিজেরাই বজ্রমন্দ্রে উত্তর দিল ‘ফ্রঁস’! কোনও রুশ জনপ্রাণী সামনে এল না অবশ্য, যুদ্ধের প্রশ্নই উঠল না, মাটির ধুলো আকাশে উঠিয়ে এগিয়ে চলা কেবল। ভিলনা শহরের দিকে এগিয়ে চলল নেপোলিয়নের তেজী যুদ্ধাশ্ব, সম্রাট নিজেই যার নাম দিয়েছেন ‘মস্কো’!
২৬ জুন ভিলনা থেকেই প্রচারিত হল প্রতিদ্বন্দ্বী জার আলেকজান্ডারের যুদ্ধবার্তা। আলেকজান্ডার তখনও যেন প্রস্তুত নন এই মহাদুর্বিপাকের জন্য, তখনও যেন জানেন না কোন পথে এগোবেন। তাই হয়তো তাঁর যুদ্ধবার্তায় ঈশ্বরের আশ্রয়ের কথা উঠে এল: “সৈন্যগণ! লড়াই শুরু করো তোমাদের বিশ্বাস, তোমাদের পিতৃভূমি, তোমাদের স্বাধীনতা রক্ষার লড়াই! আমি সঙ্গে আছি। মনে রেখো সবাই, ঈশ্বর কিন্তু আগ্রাসনকারীর বিরুদ্ধে থাকেন!”
কিছু দিন আগেও নেপোলিয়নে ভারী মুগ্ধ ছিলেন আলেকজান্ডার। বয়সে প্রায় নেপোলিয়নেরই সমান। মাত্র পাঁচ বছর আগে, ১৮০৭ সালে নিয়েমেন নদীরই ধারে টিলসিটে যখন তাঁদের দেখা হয়েছিল, আবেগে ভেসে গিয়ে দিদি ক্যাথরিনকে লিখেছিলেন, “শুধু এক বার কল্পনা করো বোনাপার্টের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছি আমি! ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁর সঙ্গে একা কথা বলতে পারছি! এ যেন স্বপ্ন!” স্বভাব-কুটিল নেপোলিয়নেরও ভাল লেগেছিল বালকের মতো সরল এই রাজপুরুষটিকে। দু’জনে নদীর ধারে বসে আগুন পোহালেন, সঙ্গীসাথিদের দূরে ভাগিয়ে দিয়ে দর্শন ইতিহাস কবিতা আলোচনা করলেন, দু’জনেই দু’জনের মনের পরিচয় জেনে ভাবলেন, এত দিনে মনের মতো বন্ধু পেলাম! আজ সেই আলেকজান্ডারই যুদ্ধ ঘোষণা করছেন, ‘ইউরোপের ধ্বংসদূত, বিশ্বশান্তির পরমশত্রু’ নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে!
আর নেপোলিয়ন? কী বলছেন তিনি রাশিয়া পৌঁছে? উদ্বিগ্ন, অন্যমনস্ক সম্রাট কখনও বলছেন, “ভিলনা অবধি চলে এলাম, কিন্তু এখনও জানি না কেন এই যুদ্ধ, কেন এত দূর এসেছি।” কখনও বলছেন, “কী ভেবেছে আলেকজান্ডার, আমার সঙ্গে মজা করবে?... এই রুশগুলোকে ছুড়ে ফেলা উচিত ওদেরই দেশের বরফঢাকা ধু-ধু প্রান্তরে, সভ্যতার ব্যাপারে নাক গলানোর সাহস যেন ওরা আর না পায়।” যেমন বিস্ময়কর দৃঢ় দৃপ্ত মানুষটির মনের এবারকার অস্থিরতা, তেমনই বিস্ময়কর এই অভিযানে একটার পর একটা অস্বাভাবিক ঘটনা। রাশিয়ার অনেকখানি অভ্যন্তর অবধি ঢুকেও গ্রঁদ আর্মে লড়াই করার সুযোগই পেল না বহু দিন, কেননা একের পর এক শহর ধ্বংস করে পিছিয়ে গিয়েছে রুশ বাহিনী, চেষ্টা করেও মুখোমুখি হওয়া যায়নি। মাটি পুড়িয়ে পিছিয়ে যাওয়ার এই রণনীতি নতুন নয়। কিন্তু এমন নতুন দেশে যেখানে জনবসতি এমনিতেই কম, খাদ্য-আশ্রয় জোটানো আকাশের চাঁদ পাওয়ার শামিল, সেখানে যে শত্রুপক্ষের এই কায়দার ফল কী হবে, আগে বোঝেনি ফরাসিরা। সুতরাং বিনা লড়াইয়েই হুহু করে কমতে শুরু করল সৈন্যসংখ্যা, ঘোড়ার সংখ্যা। খাবার নেই, আশ্রয় নেই। তার উপর প্রবল গরম, প্রবল ঠান্ডা, প্রবল বৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস, রাশিয়ার প্রকৃতির অদ্ভুত সৃষ্টিছাড়া রোষ। মস্কো পৌঁছনোর আগেই বিশ্ববিজয়ী সেনাবাহিনীর বিপর্যয় স্পষ্ট হয়ে উঠল।
মস্কো! মস্কোয় ঢোকার আগেই বোরোদিনো’র মহাযুদ্ধ। এই যুদ্ধেই নেপোলিয়ন টের পেলেন, রাশিয়ার শক্তিকে তিনি খাটো করে দেখেছিলেন। হ্যাঁ, সারা জীবনে এত বিশাল, এত রক্তাক্ত যুদ্ধ তিনি আর লড়েননি। আড়াই লক্ষ সৈন্যের যুদ্ধে এক দিনে নিহত হল সত্তর হাজারেরও বেশি। রণক্লান্ত বাহিনীর সামনে যখন ১৪ সেপ্টেম্বর দূর থেকে দেখা দিল ঝকঝকে মস্কোর মায়াবী রূপ, ক্লান্ত বিধ্বস্ত মানুষগুলি যেন পাগল হয়ে গেল আনন্দে। নেপোলিয়ন কিন্তু আনন্দ করলেন না, সৌন্দর্যে ভুললেন না, বরং আশঙ্কায় বিস্ময়ে অস্থির হয়ে গেলেন, কেন এ মহানগরী এমন পরিত্যক্ত? এমন প্রাণহীন? আশঙ্কা করলেন, দুর্দৈব সামনেই। কী সে দুর্দৈব কে জানে!
জানতে সময় লাগল না বেশি। ১৬ সেপ্টেম্বর ভোর চারটেয় সঙ্গীদের ধাক্কায় ঘুম ভেঙে গেল, ক্রেমলিনের গবাক্ষপথে দেখলেন নেপোলিয়ন, মস্কো জুড়ে আগুনের লেলিহান শিখা, রুশরাই জ্বালিয়ে দিচ্ছে তাদের এত কালের জাতীয় গৌরব মহত্তম শহরটিকে, ক্রেমলিনের প্রাসাদের গা বেয়ে প্রবল গতিতে উঠে আসছে সেই আগুন, যেখানে নেপোলিয়ন শুয়েছিলেন সে দিকেই। ঊর্ধ্বশ্বাস পলায়নের পথে ওই অদ্ভুত ভয়াল প্রজ্বলিত গগনরেখা দেখতে থাকলেন নেপোলিয়ন পরে সেন্ট হেলেনা দ্বীপের একাকী নির্বাসনে বসে যা তিনি স্মরণ করবেন, “the most grand, the most sublime, the most terrfific sight the world ever beheld!”
ইতিহাসের ‘শ্রেষ্ঠ’ সেনাপতি নেপোলিয়ন এ বার ভারী অস্থিতচিত্ত। ভুলের পর ভুল। মস্কো ছাড়ার পর সেনাপতিরা যতই বোঝালেন এ বার দ্রুত দেশে ফিরে যাওয়া উচিত, ততই বাধা দিলেন তিনি। কলেঁকুর-এর কথাও কানে তুললেন না। অথচ মস্কো থেকে বেরিয়েই সুদক্ষ রুশ সেনাপতি কুতুজভ-এর বাহিনীর সঙ্গে প্রবল সংঘর্ষে পড়তে হল তাঁকে, মালোয়ারোস্লাভেত্স-এ। ছারখার হল তাঁর বাহিনী। এই সেই কুতুুজভ, তলস্তয়-এর ‘ওয়র অ্যান্ড পিস’ মহা-উপন্যাসে যাঁকে রাশিয়ার ত্রাতা-নায়কের ভূমিকায় দেখেছি আমরা। ভয়ানক সেই হানাহানির রাত শেষ হলে নেপোলিয়ন নিজেই ঘোড়ার পিঠে পরিদর্শনে বেরোলেন, দেখলেন ছোট্ট শহরটির প্রতিটি রাস্তায় শবদেহের স্তূপ।
এবং, অকস্মাৎ, সম্রাট ঘোষণা করলেন: ফিরে চলো!
শুরু হল প্রত্যাবর্তন। হাসল নিয়তি। অলক্ষ্যে।

নভেম্বরের সেই সপ্তাহ
প্রিন্স ইউজেন তাঁর চতুর্থ বাহিনী, পাঁচ হাজার অশ্বারোহী নিয়ে ফিরতি পথ ধরেছিলেন। ৪ নভেম্বর: ১২০০ ঘোড়া মারা গেল এক দিনে। ৫ নভেম্বর: মারা গেল আরও ২০০০। অশ্বারোহীরা গেলেন আরও দ্রুত। ৮ নভেম্বর: ইউজেন এবং ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ জন অশ্বারোহী প্রাণমাত্র বহন করে ধুঁকতে ধুঁকতে ভায়াজমা শহরে পা রাখলেন। রাজকুমার ইউজেন দ্য’ বোহার্নে নেপোলিয়নের পালিত পুত্র। বোরোদিনো আর মালোয়ারোস্লাভেত্স-এ বীরচূড়ামণির মতো লড়েছিলেন। ফেরার পথে রুশ প্রকৃতিদেবী চার দিনে তাঁকে নিঃস্ব করে দিলেন।
অথচ নভেম্বরের ওই সপ্তাহটির আগে মনে হচ্ছিল, এই তো সামনেই, আর একটু হাঁটলেই, ফেরা যাবে চেনা ভুবনে। আর ৮ নভেম্বর পেরোতে না পেরোতেই সংশয় দেখা দিল, অত বড় বাহিনীর একটি মানুষও অক্ষত ফিরতে পারবে কি না। আধপেটা খেয়ে, না ঘুমিয়ে, ঠান্ডায় জমে, খোলা আকাশের হিমে সাড়ে চারটি মাস ধরে অক্লান্ত অভিযানের পর প্রকৃতি বা মানুষ, কারও সঙ্গে যুঝবার ক্ষমতাই যখন হারিয়ে ফেলেছে অবশিষ্ট শীর্ণ-জীর্ণ ফরাসি-জার্মান-প্রাশিয়ান-পোলিশ-ইতালীয় মানুষগুলো, সেই সময় প্রকৃতি এবং মানুষ, দুই-ই যেন শত্রুতায় হিংস্রতায় ভীষণ আকার ধারণ করল। এ দিক ও দিক থেকে হানা লাগাল ছোট-মাঝারি রুশ সৈন্যদল, ক্রমাগত ঝরতে লাগল গ্রঁদ আর্মের বাকি কলেবর। আবারও ভুল করলেন নেপোলিয়ন। এত আহত মানুষ দেখে অস্থির হয়ে আদেশ দিলেন, যারা জখম হয়েছে, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ফিরতে হবে। সম্রাটের নির্দেশ, তাই ক্রমেই গাড়ি-ঘোড়া ভরে উঠতে লাগল অচল অক্ষম মানুষে। দুর্বহ হয়ে উঠল সেই ভার। একেই রুক্ষ বরফপথে এগোনো কঠিন, তার উপর এই ভার। কিছুক্ষণ পরেই দেখা গেল, চালকরা ইচ্ছে করে ঝাঁকিয়ে চলছে গাড়ি এবং ঘোড়া, যাতে আহত মানুষগুলো ছিটকে পড়ে যায়, ভার লাঘব হয়। যারা ছিটকে পড়ছে? পরমুহূর্তেই অন্য গাড়ি বা ঘোড়ার চাপে তারা পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে। যারা প্রাণ হারাচ্ছে? শাবল দিয়ে সমান করে দেওয়া হচ্ছে শবদেহগুলি, যাতে পরের গাড়ি-ঘোড়ার চাকা সেই দেহগুলির উপর দিয়ে সমান ভাবে গড়িয়ে যেতে পারে। কখনও-বা সেই শবদেহগুলিই টেনে নিয়ে তার তলায় আশ্রয়ের জন্য ঢুকছে জীবন্ত মানুষ, শীতের আচ্ছাদন হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে শব। যে কোনও রকম আচ্ছাদনের খোঁজে মানুষ তখন পাগলপারা, পারদ নামছে হুহু করে। একটির পর একটি বরফঝড়ের অসহনীয় রাত। খোলা তুষারপ্রান্তরে সেই সব রাত যেন কালান্তক, মনে হয় একটি প্রাণীও রক্ষা পাবে না আজ। তেমনই একটি রাত কোনও ক্রমে কাটিয়ে এক সেনানী সকালবেলা দূর থেকে দেখলেন আগুন ঘিরে বসে আছে এক দল মানুষ, সম্ভবত অন্য সেনারাই। ছুটে গেলেন তিনি সাহায্যের আশায়। কাছাকাছি পৌঁছেই আতঙ্কে অবশ হয়ে গেলেন হ্যাঁ, ওরা সেনাই বটে, তবে সেনাদের শব খাড়া বসেই ঠান্ডায় জমে পাথর হয়ে গেছে দেহসমূহ!
দিনগুলিও কম বিভীষিকা নয়। এক সৈন্যের বয়ানে, “সকালবেলা কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর আবার হুইসল শুনে রওনা হওয়ার পালা, তখনও দেখি অনেকেই ঠায় ব’সে। ঘুমোচ্ছে ভেবে ধাক্কা দিয়ে ওঠাতে গিয়ে দেখি, নাঃ, মরে গিয়েছে সব ক’জন, ব’সে ব’সেই।” তাপমান তখন -১০ থেকে -১৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। একেবারেই কি অদৃষ্টপূর্ব এই শীত, ইউরোপীয় মানুষগুলির কাছে? না তো! তবে কেন এমন? কেননা, কোনও শীতবস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার চল ছিল না তখন, শীতকালে যুদ্ধ হতই না মোটে। আর ঘর-বাড়ি-কুঁড়ে কোনও আশ্রয় মেলার সম্ভাবনাও ছিল না, রাশিয়ায় এতই কম জনবসতি। নেপোলিয়নের পরিকল্পনা ছিল শীতের আগেই ফিরে আসার। কিন্তু পরিকল্পনামাফিক তো এগোয়নি রাশিয়ার যুদ্ধ। সুতরাং এই নভেম্বরে নেপোলিয়নের সৈন্যদের কাছে সম্বল বলতে ছেঁড়াখোঁড়া মাফলার, মস্কোয় লুঠ করা পোশাক, শবদেহ থেকে খুলে নেওয়া কাপড়। ঠান্ডা আস্তে আস্তে কেড়ে নেয় শরীরের সংবেদনশক্তি। ঠান্ডার তীব্রতায় অস্ত্রের সঙ্গে আটকে যায় দেহাংশ। ঠান্ডার কামড়ে পা থেকে খুলে বেরিয়ে ঝুলতে থাকে পায়ের চামড়া। বরফের উপর বড় বড় রক্তের ছাপ। চামড়া খুলে বেরিয়ে যাওয়ার পর খুলে পড়ে পদতলের মাংসপিণ্ডও। তবু তারা হাঁটে। এই যে তাদের জীবনের শেষ দিনের হাঁটা!
কেবল শীত নয়, আর এক পরম শত্রুও আছে, যার নাম ক্ষুধা। খাদ্য কোথায় তাদের জন্য, সংখ্যায় কমতে কমতেও যারা এখনও হাজার সত্তর! কেবল মৃত ঘোড়ার মাংস ভরসা। মৃতই বা কেন শীতে কাবু কোনও ঘোড়া মাটিতে পড়ে গেলেও ছুটে আসে দলে দলে মানুষ, জীবন্ত অবস্থাতেই অস্ত্রাঘাতে খুবলে নেওয়া হয় তার হৃত্যন্ত্র, যকৃৎ খেতে যে ওই অংশগুলিই সেরা। না, কাঁচা নয়, আগুনে সামান্য ঝলসানো। ‘ম্যারিনেশন’-এর মশলা তো রয়েইছে কার্তুজ ছিঁড়ে বার করে নেওয়া বারুদ! রুটির চিন্তা চমৎকারা। তাই খড় জলে ভিজিয়ে চেপেচুপে তৈরি হয় নতুন ধরনের ‘বিস্কুট’। আরও খিদে পেলে? অনেক মাথা একত্র হয়ে দেশের খাবারের কথা ভাবা এবং বলার খেলা কার কী খেতে মন যায় বলো, স্যুপ স্যান্ডউইচ ক্রেপ? ক্ষুধার নিশ্চিত উপশম।
তবে সবচেয়ে বড় শত্রুর নাম কসাক। রাশিয়ার দুর্ধর্ষ দস্যু বাহিনী। এ দেশে ঢোকার সময়ে বলীয়ান গরীয়ান গ্রঁদ আর্মে এদের পাত্তাও দেয়নি, ফেরার সময়ে সুদে-আসলে উসুল। ঝাঁক ঝাঁক প্রাণ যায় ঝাঁক ঝাঁক কসাকের হাতে। কখনও গাছে ঝুলিয়ে কখনও পাথর দিয়ে মাথা ফাটিয়ে কখন জ্যান্ত কবর দিয়ে শেষ হয় হাজার হাজার মানুষ।
বিরক্তি অশান্তি অস্থিরতা পেরিয়ে নেপোলিয়ন তখন পৌঁছে গিয়েছেন তূরীয় নিশ্চুপতায়। ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতেও কাবু হননি, শত অনভ্যস্ত অসুবিধেতেও নয়। পরমপ্রতাপশালী সম্রাট তখন ছিন্ন তাঁবুতে মলিন পোশাকে উকুন-অধ্যুষিত চুলে অনিদ্রাতাড়িত আত্মমগ্ন। মাঝেমধ্যে নাকি ছটফট করে উঠছেন অসংখ্য সেনার কথা ভেবে, ‘‘বেচারিদের কথা ভেবে আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, কিন্তু ওদের জন্য আমি কিছুই করতে পারছি না।’’ হয়তো সেনারাও টের পেতেন। তাই, যে সম্রাটের বিকৃত উচ্চাশার অপরিণামদর্শী অভিযান তাঁরা প্রাণ দিয়ে সফল করতে এসেছেন, যাঁর জন্য তাঁরা আজ মরণাধিক যন্ত্রণায় আর্ত, তাঁর প্রতি সে দিনও অপরিমিত শ্রদ্ধা তাঁদের। আদ্যন্ত সম্রাট-বিরোধী প্রাশিয়ান সেনাপতিও ক্ষুব্ধচিত্তে স্মরণ করেন, দরকারে সৈন্যরা কেমন ভাবে আপন শরীর উৎসর্গ করেও সম্রাটকে উষ্ণতা দিতে রাজি, শত কষ্টেও তাদের মুখে সম্রাট বিষয়ে একটিও নালিশ নেই, মৃতপ্রায় সেনাটিও হাত তুলে শেষ বস্ত্রাংশটুকু দিয়ে দিতে চায়: “এই নাও, নিয়ে যাও সম্রাটের জন্য!”
সম্রাট। গোটা ইউরোপে উনিশ শতকের প্রথম সওয়া দশকে সম্রাট বলতে এক জন অমিতবিক্রম মানুষকেই বোঝাত, বাকিরা সব রাজা। সেই সম্রাটের গুণাগুণ, তাঁর মধ্যে ফরাসি বিপ্লবের উত্তরাধিকার, এ নিয়ে ঐতিহাসিকরা অনন্ত তর্ক করে যাবেন। তাঁর চারিত্রিক ভালমন্দ নিয়ে অনন্ত আলোচনা হবে। তাঁর মনে নাকি নিভৃত ইচ্ছে ছিল তুরস্ক, আরব পেরিয়ে ভারতে এসে টিপু সুলতানের সাহায্যে ব্রিটিশ হটিয়ে ভুবনবিজয়ী হবেন: ফলে সে দিন তাঁর এমন পরাজয় না ঘটলে কী ভাবে পাল্টাত ইউরোপের ইতিহাস, কী ভাবেই বা পাল্টাত ইউরোপের এশিয়া-বিভাজন, কেমন দাঁড়াত বিশ্ব-রাজনীতি আমরা ভেবে চলব।
কিন্তু এই কাহিনির নায়ক তো কেবল সম্রাটই নন। আরও এক নিভৃত নায়ক আছে এখানে। তার নাম রাশিয়া। ২৪ জুন নিয়েমেন পার থেকে ৭ ডিসেম্বর আবারও নিয়েমেন পেরিয়ে ওয়ারস’য় পা রাখা পর্যন্ত পাঁচটি মাস যে ভাবে পাল্টে দিল সম্রাট, সাম্রাজ্য, বিশ্বক্ষমতার চালচিত্র, তাতে অতঃপর ‘রাশিয়া’ হয়ে উঠল প্রবাদের দেশ। অঘটন-ঘটনের দেশ। মহানকে সাধারণ, অপরাজেয়কে পরাজিত, পরমপ্রতাপকে নির্বাসনে নিক্ষেপণের প্রতীক।
নেপোলিয়নও কি রাশিয়ার প্রতি কৃতজ্ঞ হতেন না আজ থাকলে, ফিরে ভাবলে? তিনি তো নায়কই হতে চেয়েছিলেন? সত্যিকারের নায়ক যে ট্র্যাজেডিরই নায়ক!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.