|
|
|
|
৪৮ ঘণ্টা ব্যবসা বনধের ডাক ব্যবসায়ীদের |
অপরাধ বাড়ায় আতঙ্কিত বনগাঁবাসী
তোপ দাগলেন পুলিশের বিরুদ্ধেই |
নিজস্ব সংবাদদাতা • বনগাঁ |
মাস খানেক আগে ভর সন্ধ্যায় দুষ্কৃতীরা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বনগাঁয় একটি সোনার দোকানে চড়াও হয়ে কয়েক লক্ষ টাকা লুঠ করে গুলি ও বোমা ছুড়তে ছুড়তে পালিয়ে যায়। বোমার আঘাতে ৯ জন পথচারি জখম হন। তাঁদের কয়েকজন এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। শুধু ওই ঘটনাই নয়, সাম্প্রতিক কালে খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, চুরি, কেপমারি ও পাচারের একাধিক ঘটনায় গোটা বনগাঁর মানুষ আতঙ্কিত। তাঁদের অভিযোগ, যে ভাবে অপরাধ বেড়ে চলেছে তাতে পুলিশের ভূমিকা নিয়েই তাঁদের মনে সন্দেহ জেগেছে। একের পর এক ঘটনা ঘটলেও পুলিশকে সে ভাবে সক্রিয় ভূমিকা নিতে দেখা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় স্বাভাবিক ভাবেই আতঙ্ক ছড়িয়েছে। সাধারণ মানুষ তো বটেই পর পর দোকানে চুরি, ডাকাতিতে আতঙ্কিত ব্যবসায়ীরাও। বনগাঁ বাটার মোড়ে সোনার দোকানে লুঠপাটের ঘটনা তাঁদের সেই আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। অবস্থা এমনই যে অনেকেই নিরাপত্তার অভাব বোধ করায় সন্ধ্যার পরেই দোকান বন্ধ করে দিচ্ছেন। যদিও প্রতিটি ঘটনার পরে নিয়মমাফিক পুলিশ তদন্তে গিয়েছে। কিন্তু দুষ্কৃতীরা বেশিরভাগই অধরা থেকে গিয়েছে। এই অবস্থায় পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে এবং নিরাপত্তার দাবিতে শুক্রবার থেকে ৪৮ ঘণ্টার ব্যবসা বন্ধের ডাক দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বনগাঁ সাব ডিভিশন চেম্বার অফ কমার্স, বনগাঁ কেন্দ্রীয় ব্যবসায়ী সমিতি, বঙ্গীয় স্বর্ণশিল্পী সমিতি-সহ মোট ১৯টি সংগঠন এই বন্ধ পালন করছে। |
|
বন্ধ দোকানপাট। |
জেলার পুলিশ সুপার চম্পক ভট্টাচার্য বলেন, “সোনার দোকানে ডাকাতির ঘটনার তদন্ত চলছে। তদন্তের বিষয়ে বেশি কিছু বলা যাবে না। তবে আইনশৃঙ্খলার উন্নতির প্রশ্নে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। গরু পাচার বন্ধে মহকুমার তিনটি জায়গায় চেকপোস্ট তৈরি করা হয়েছে। এলাকায় অপরাধ দমনে ও শান্তি রক্ষায় পুলিশকর্মীরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন।”
গত ২৫ মে বাটার মোড়ে সোনার দোকানে লুঠপাঠের ঘটনায় সেখানে ছুটে গিয়েছিলেন জেলার পুলিশ সুপার, ডিআইজি (পিআর) অনিলকুমার, আইজি (দক্ষিণবঙ্গ) মিহির ভট্টাচার্য। যা সম্প্রতি আর কোনও এমন ধরনের ঘটনায় দেখা যায়নি। অনিলকুমার জানিয়েছিলেন, ডাকাতির কিছু সূত্র পাওয়া গিয়েছে। দুষ্কৃতীদের শীঘ্রই গ্রেফতার করা হবে। আইজি, মহকুমার পুলিশ কর্তাদের নিয়ে এক বৈঠকে বিষয়টিকে পুলিশের ‘সম্মানের’ বিষয় হিসাবে উল্লেখ করেন। রাজ্য এবং জেলা পুলিশের এমন তৎপরতায় এবং আশ্বাসে স্বস্তি পেয়েছিল ব্যবসায়ী মহল। স্বস্তি পেয়েছিলেন বনগাঁর মানুষও। কিন্তু ঘটনার এতদিন পরেও ওই দুষ্কৃতীরা গ্রেফতার না হওয়ায় এবং ডাকাতি, ছিনতাই, খুনের ঘটনা ঘটতে থাকায় বাধ্য হয়েই পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তুলেছেন ব্যবসায়ীরা। এবং এই কারণেই এ দিন থেকে ব্যবসা বন্ধ পালন করছেন তাঁরা। এ দিন মহকুমার প্রায় সব দোকানপাট বন্ধ ছিল। তবে নিউমার্কেট ব্যবসায়ী সমিতি এই বন্ধে সামিল না হওয়ায় ওই বাজার খোলা ছিল। কেন তাঁরা আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে ব্যবসা বন্ধে সামিল হলেন না জানতে চাওয়া হলে নিউমার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক বিশ্বজিৎ বসু বলেন, “বাটার মোড়ে সোনার দোকানে ডাকাতির পরে আমরা দুষ্কৃতীদের গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলন করেছি। ভবিষ্যতেও এ ব্যাপারে যে কোনও আন্দোলনে সামিল হব। তবে বন্ধ সমর্থন করি না।” তবে সামগ্রিক স্বার্থে এই বন্ধে নিউমার্কেট ব্যবসায়ী সমিতি সামিল না হওয়ায় তা নিয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ীমহল ক্ষুব্ধ। বন্ধ পালন করা হলেও ব্যবসায়ীরা বন্ধের আওতা থেকে ওষুধ, পরিবহণ, শিক্ষার মতো পরিষেবাকে বাদ দিয়েছেন। |
|
পথ অবরোধ ব্যবসায়ীদের। |
শুধু তাই নয়, শনিবার দ্বিতীয় দিন মাছ ও সব্জি বাজার বন্ধের বাইরে রাখা হবে বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
বনগাঁ কেন্দ্রীয় ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক শিবুপ্রসাদ বসু ও বনগাঁ চেম্বার অফ কমার্সের সম্পাদক বিনয় সিংহ বলেন, “বনগাঁয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশি ব্যবস্থা তলানিতে এসে ঠেকেছে। চুরি-ডাকাতি, খুন, ছিনতাই, কেপমারির ঘটনা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। আমরা চাই বনগাঁয় কড়া প্রশাসন। ব্যবসায়ীরা এবং সাধারণ মানুষ যাতে সুস্থভাবে ব্যবসা করতে পারেন, নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন সে জন্যই বন্ধ ডাকতে বাধ্য হয়েছি।” বঙ্গীয় স্বর্ণশিল্পী সমিতির বনগাঁ শাখার সহ সম্পাদক দিলীপ মজমদার বলেন, “আমরা এমনও বলেছিলাম, দুষ্কৃতীরা গ্রেফতার হলে বা লুঠ হওয়া মালপত্র উদ্ধার হলে পুলিশকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে।” ব্যবসায়ী সংগঠন সূত্রে জানানো হয়েছে, কয়েকদিন আগে মহকুমাশাসক অভিজিৎ ভট্টাচার্যের কাছে মিছিল করে স্মারকলিপি দিয়ে ডাকাতির ঘটনার সিআইডি তদন্তের দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। দুষ্কৃতীদের গ্রেফতার ও আইনশৃঙ্খলার উন্নতির দাবিতে কয়েকটি প্রতিবাদ সভাও করেন। কিন্তু পুলিশকে সে ভাবে নড়েচড়ে বসতে দেখা যায়নি। তাঁদের অভিযোগ, পুলিশের একাংশের সঙ্গে দুষ্কৃতীদের যোগসাজশের কারণেই পুলিশ কোনও কড়া ব্যবস্থা নিতে পারছে না। পাশাপাশি পুলিশের কাজে স্থানীয় রাজনৈতিক মহলের হস্তক্ষেপেরও অভিযোগ তুলেছেন তাঁরা। যদিও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বনগাঁয় ক্রমশ বেড়ে চলা অপরাধমূলক কাজের জন্য পুলিশি নিষ্ক্রিয়তাকেই দায়ী করেছে। একইসঙ্গে দুষ্কৃতী ধরতে পুলিশ কর্মীদের দক্ষতার অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বনগাঁর প্রাক্তন বিধায়ক গোপাল শেঠ।
বাগদার প্রাক্তন বিধায়ক দুলাল বর বলেন, “থানাগুলি থেকে ‘ডাকমাস্টার’ না সরালে আইন শৃঙ্খলার কোনও উন্নতি হবে না।” বনগাঁ শহর কংগ্রেসের সভাপতি কৃষ্ণপদ চন্দ্র বলেন, “গত দেড় বছরে বনগাঁ থেকে চারজন এসডিপিও বদলি হয়েছেন। অপরাধীদের প্রচ্ছন্ন মদত দিতেই ওই বদলি করা হয়েছে। বনগাঁর জনপ্রতিনিধিদেরও আইনশৃঙ্খলার উন্নতিতে কোনও সদর্থক ভূমিকা নিতে দেখা যাচ্ছে না।” প্রসঙ্গত বৃহস্পতিবারই বনগাঁ থানায় নতুন আইসি জাফর আলি যোগ দিয়েছেন। তবে এ ভাবে পুলিশের ভূমিকাকে খাটো করে দেখতে রাজি নন বনগাঁ উত্তর কেন্দ্রের তৃণমূল বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস। তাঁর কথায়, “আইনশৃঙ্খলার অবনতির প্রশ্নে ব্যবসা বন্ধ ডাকা হলেও সব ব্যবসায়ীরা তাতে সামিল হননি। তাঁরা পুলিশের উপরে ভরসা রেখেছেন। অন্য ব্যবসায়ীদের উচিত ছিল পুলিশকে আরও সময় দেওয়া।” কংগ্রেসের বক্তব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা ঠিক কি তা কংগ্রেসের নেতারা জানেন না।” তবে বিধায়ক যাই-ই বলুন, দুষ্কৃতীদের গ্রেফতার ও আইনশৃঙ্খলার অবনতির প্রশ্নে পুলিশকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চান বনগাঁর মানুষ।
|
—নিজস্ব চিত্র। |
|
|
|
|
|