বিনিয়োগের পথে বড় বাধা হল অনিশ্চয়তা। আর মামলা-মোকদ্দমার জটিলতায় সেই অনিশ্চয়তারই মাত্রা বেড়ে যায়। তাই সিঙ্গুর-বিবাদকে কোর্টের আঙিনায় দীর্ঘায়িত না-করে টাটা মোটরসের সঙ্গে সমস্যা ‘আপসে’ মিটিয়ে নেওয়ার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আর্জি জানাল শিল্পমহল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে তাদের বক্তব্য: লগ্নি টানতে হলে সহায়ক পরিবেশ একান্ত জরুরি। দীর্ঘ আইনি জটে লগ্নি আটকে পড়লে যে কোনও লগ্নিকারীই সে রাজ্যে পা রাখতে দু’বার ভাববেন বলে শিল্পমহল আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।
সিঙ্গুর-আইনকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করে শুক্রবার কলকাতা হাইকোর্টের যে রায়, টাটা মোটরস কর্তৃপক্ষ এ দিন সে সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তাঁরা শুধু জানিয়েছেন, আদালতের নির্দেশ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। টাটা মোটরসের সহযোগী সংস্থাগুলিও ‘সরকারি ভাবে’ কোনও প্রতিক্রিয়া দেয়নি। যদিও আদালত তাদের বক্তব্য শোনায় সহযোগীদের কেউ কেউ ঘনিষ্ঠ মহলে ‘সন্তোষ প্রকাশ’ করেছে বলে শিল্প-সূত্রের খবর।
উল্লেখ্য, সিঙ্গুর-মামলায় টাটার আইনজীবী সমরাদিত্য পাল এ দিন রায়ের পরে ‘ব্যক্তিগত ভাবে’ দু’পক্ষের প্রতি আর্জি জানিয়েছেন, রাজ্যের স্বার্থের কথা মাথায় রেখেই তাঁরা যেন আলোচনায় বসে ঐকমত্যের মাধ্যমে সমাধান-সূত্র খুঁজে নেন।
শিল্পমহলের একাংশের মতে, গত ক’দশক ধরে পশ্চিমবঙ্গের ‘ভাবমূর্তি’ই লগ্নি আকর্ষণের পথে বৃহত্তম প্রতিবন্ধক। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম তাতে আরও ইন্ধন জুগিয়েছে। এবং জমির সমস্যা বা সরকারি দীর্ঘসূত্রতার চেয়েও লগ্নি-প্রস্তাব ঘিরে অনিশ্চয়তাই বেশি ভয় ধরিয়েছে লগ্নিকারীদের মনে। ঠিক যে ভাবে বাম আমলেও নানা সময়ে জঙ্গি আন্দোলনের জেরে অনিশ্চয়তায় ভুগেছে রাজ্যের শিল্পক্ষেত্র। বণিকসভা অ্যাসোচ্যামের সেক্রেটারি জেনারেল ডি এস রাওয়াতের দাবি, এখনও অনিশ্চয়তারই জন্য পশ্চিমবঙ্গ খানিকটা লগ্নি-বিমুখ।
এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে সিঙ্গুর-রায় তাঁকে সন্তুষ্ট করেছে বলে জানিয়েছেন রাওয়াত। একই সঙ্গে রাজ্যের স্বার্থে মুখ্যমন্ত্রী-সহ প্রশাসনের প্রতি তাঁর আর্জি, সিঙ্গুর-মামলার জল যেন সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত আর না-গড়ায়। কারণ, তাতে আরও কয়েক বছর
চলে যাবে, বাড়বে অনিশ্চয়তা। “মুখ্যমন্ত্রীকে আমার বিনীত অনুরোধ, ওই দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বদলে বরং তাঁরা আলোচনায় বসে সমস্যা মিটিয়ে নিন।” বলেন অ্যাসোচ্যাম-কর্তা। তাঁর যুক্তি: পূর্বতন ও বর্তমান সরকারের আমল মিলিয়ে এ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে প্রায় পাঁচ লক্ষ কোটি টাকা লগ্নির প্রস্তাব রয়েছে। টাটাদের সঙ্গে আলোচনায় বসে সিঙ্গুর-জট কাটাতে পারলে তা ইতিবাচক বার্তা দেবে। তাতে অপেক্ষমান লগ্নির পথ সুগম হবে, আখেরে যা রাজ্যের উন্নয়ন ঘটাবে।
ফিকি’র পূর্বাঞ্চলীয় কর্তা গৌরব স্বরূপও বলছেন, লগ্নিকারীরা আইনি লড়াইয়ে ভয় পায়। তাই কেউ মামলার জালে আটকে থাকতে চায় না। এ দিনের সিঙ্গুর-রায় আইনি ব্যবস্থার উপরে মানুষের আস্থা আরও মজবুত করবে বলে আশা প্রকাশ করলেও নিছক আদালতের রায় যে লগ্নি টানতে পারে না, তা-ও স্পষ্ট জানিয়েছেন গৌরব। যাঁর মন্তব্য, “সিঙ্গুর-কাণ্ডে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছিল। লগ্নি দূরে সরে গিয়েছিল। সেই অবস্থার বড় কোনও পরিবর্তন এখনও হয়নি। রাজ্য সরকারেরও কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কোনও সংস্থাই আইনি লড়াইয়ে ফেঁসে থাকতে চায় না।”
বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্সের প্রেসিডেন্ট হর্ষ ঝা’র কাছেও জমির পাশাপাশি লগ্নি-সহায়ক পরিস্থিতিটা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর কথায়, “ভাবমূর্তির সঙ্কট আগেও ছিল, এখনও রয়েছে। কোন সরকার ক্ষমতায় রয়েছে, তা প্রাসঙ্গিক নয়। লগ্নিকারী দেখতে চান, কোথায় তাঁর লগ্নি সুরক্ষিত থাকবে। এখানেই শিল্পের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।”
অন্য রকম ভাবনাও অবশ্য রয়েছে। যেমন ভারত চেম্বারের প্রেসিডেন্ট অশোক আইকত সিঙ্গুরের সঙ্গে লগ্নির বিষয়টি জড়াতে নারাজ। তাঁর মতে, সিঙ্গুরের ঘটনা রাজনৈতিক বিষয়। পশ্চিমবঙ্গের ‘শিল্পবন্ধু’ ভাবমূর্তি আগের তুলনায় উজ্জ্বল হয়েছে বলে দাবি করছেন অশোকবাবু। পাশাপাশি এ-ও বলছেন, “সিঙ্গুর-সমস্যার সমাধান এমন হতে হবে, যাতে সব শরিক সন্তুষ্ট হয়। আর সেই সমাধান-সূত্রই রাজ্যের ভাবমূর্তি অন্য পর্যায়ে নিয়ে যাবে।” |