শুধু জি-২০ বা রিও+২০ বৈঠকই নয়, প্রধানমন্ত্রিত্বের দীর্ঘতম সফরে বেরিয়ে আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও ভারসাম্যের উপরেও জোর দিলেন মনমোহন সিংহ। জি-২০ থেকেই চিনের প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাওয়ের সঙ্গে সমন্বয় রেখে চলছেন মনমোহন। রিও+২০ বৈঠকে এসেও জিয়াবাওয়ের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেছেন তিনি। সেই সঙ্গেই আঞ্চলিক ভারসাম্যের কথা মাথায় রেখে তিন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীদের সঙ্গেও বৈঠক করে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে মজবুত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে সচেষ্ট হলেন ‘ব্যস্ত’ মনমোহন।
সাউথ ব্লকের কর্তাদের মতে, পর পর দু’টি শীর্ষ সম্মেলনে দীর্ঘদিন পরে নয়াদিল্লি ও বেজিং পারস্পরিক সমন্বয় রেখে যে ভাবে অভিন্ন অবস্থান নিয়েছে, তা দু’দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে গত কাল ওয়েন জিয়াবাওয়ের সঙ্গে মনমোহনের দীর্ঘ বৈঠক যথেষ্টই ইতিবাচক হয়েছে। এর পর আজ নেপালের প্রধানমন্ত্রী বাবুরাম ভট্টরাই ও শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মহিন্দা রাজাপক্ষের সঙ্গে বৈঠকও কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। বিশেষ করে বাবুরাম ভট্টরাইয়ের সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতিতে মনমোহনের বৈঠককে আলাদা করে গুরুত্ব দিচ্ছে সাউথ ব্লক। চিন-ভারত সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতের নেপালের অবস্থান যথেষ্টই গুরুত্বপূর্ণ। তার উপর সাম্প্রতিক কালে নেপালের সঙ্গেও নয়াদিল্লির সম্পর্কে কিছুটা টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। তামিল আবেগের প্রশ্নে এ দিন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মনমোহনের বৈঠকেরও রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে বলে জানাচ্ছেন কূটনীতিকরা।
রিওয় মনমোহন।
ছবি: পিটিআই |
দু’দিন আগেই নেপালে কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে বেরিয়ে এসেছেন দলের প্রভাবশালী নেতা মোহন বৈদ্য। তাতে সেখানে বর্তমান সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দুর্বল হয়ে পড়েছে। বাবুরাম ভট্টরাই ও প্রচণ্ডের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে এই মাওবাদী নেতার অভিযোগ, বাবুরাম জমানায় নেপালের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নয়াদিল্লি অনেক বেশি প্রভাব খাটাচ্ছে। তাই ভারত-নেপাল সব চুক্তি বাতিল করে নতুন করে চুক্তি করতে হবে। নেপালে এই রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে আজ বাবুরাম-মনমোহন বৈঠক হয়। সেই বৈঠকের পরে বিদেশ সচিব রঞ্জন মাথাই আজ জানান, গত বছরের শেষে নেপালের সঙ্গে ভারতের যে দু’টি চুক্তি হয়েছিল (বিনিয়োগ সুরক্ষা চুক্তি এবং ডবল ট্যাক্সেশন অ্যাভয়ডেন্স এগ্রিমেন্ট) তা অটুট রয়েছে। সাউথ ব্লক সূত্রে বলা হচ্ছে, নেপাল নিয়ে ভারত সতর্ক পদক্ষেপ করে চলতে চাইছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক ভাবে কারও পক্ষ নিতে চায় না ভারত। বরং নয়াদিল্লির প্রতি যাতে নেপালের মানুষের আস্থা বাড়ে, সে দিকে বাড়তি নজর দেওয়া হবে। তাই মাথাই আজ বলেন, “নয়াদিল্লি চায় নেপালের গণতন্ত্র সুস্থির হোক। সেই সঙ্গে সেখানকার উন্নয়নেও আগ্রহী ভারত। ভারতের বেসরকারি সংস্থাগুলি নেপালে পরিকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে চায়। নেপালে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনেও ভারতের আগ্রহ রয়েছে। তবে তার আগে নেপালের বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটাতে ভারত সাহায্য করে যাবে।”
বাবুরামের সঙ্গে বৈঠকের পর শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মহিন্দা রাজাপক্ষের সঙ্গে প্রথমে একান্তে পরে প্রতিনিধি পর্যায়ের বৈঠক করেন মনমোহন সিংহ। কূটনৈতিক সূত্রে বলা হচ্ছে, শ্রীলঙ্কার ঘরছাড়া তামিল জনজাতির পুনর্বাসন ও পুনর্স্থাপনের বিষয়টি নিয়ে কলম্বোর ওপর আজ ফের চাপ বাড়িয়েছে নয়াদিল্লি। তবে রাজাপক্ষও জানিয়েছেন, পুনর্বাসনের বিষয়টিতে তাঁরা গুরুত্ব দিচ্ছেন। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট এ-ও দাবি করেছেন, উচ্ছেদ হওয়া মাত্র তিন হাজার মানুষ এখন শরণার্থী শিবিরে রয়েছেন। যদিও এই পরিসংখ্যান নয়াদিল্লির কাছে বিশ্বাসযোগ্য ঠেকছে না। তাই তামিল মানুষদের পুনর্বাসনের বিষয়টিতে ভারত যে নজর রেখে যাবে, সেই বার্তাও আজ স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
আট দিনের সফরে প্রধানমন্ত্রী শুধু শীর্ষ সম্মেলন এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতি নিয়ে আলোচনায় আটকে থাকেননি। বরং বিশ্বের শীর্ষ নেতাদের এই সমাবেশকে কাজে লাগাতে ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়ার মতো দেশের প্রধানদের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন। এবং সেই বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক কৌশলগত সম্পর্ককে ঝালিয়ে নিয়েছেন। লস কাবোসে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী দ্বিপাক্ষিক পার্শ্ব বৈঠক করেছিলেন জার্মানি, ফ্রান্স ও রাশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে। ওই বৈঠকগুলিতে প্রতিরক্ষা ও পরমাণু সহযোগিতার মতো কৌশলগত সম্পর্কই ছিল প্রধান আলোচ্য। আবার রিও-র মাটিতে পা রেখে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও শান্তির বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এই দু’ধরনের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকেই বাণিজ্য ও বিনিয়োগের প্রসারের বিষয়টিতে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি। কারণ ঘরোয়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে ওই দু’টি বিষয় তাঁর কাছে অত্যন্তই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের এক শীর্ষ কর্তার বক্তব্য, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মনমোহনের এই দ্বিপাক্ষিক বৈঠকগুলি আখেরে দিল্লির স্বাধীন ও সাবালক কূটনীতিরও পরিচয় দিচ্ছে। তা ছাড়া যে ভাবে রাশিয়া, চিন ও ইউরোপের শক্তিশালী দেশগুলির সঙ্গে তাঁর বৈঠক হয়েছে, তাতে বহু মেরু বিশ্ব স্থাপনে নয়াদিল্লির প্রয়াসের প্রতিফলন ঘটছে। সাউথ ব্লকের ওই শীর্ষ কর্তা বলেন, “এতগুলি দেশের রাষ্ট্রনেতাদের সঙ্গে এ ভাবে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের সচরাচর সুযোগ হয় না। দীর্ঘদিন পর সব মিলিয়ে প্রায় দশটি দেশের সঙ্গে এমন বৈঠক করলেন প্রধানমন্ত্রী।” ফলে লস কাবোসের পর চির উচ্ছ্বল রিও-কে ভাল করে দেখাও তাঁর কাছে গুরুত্ব পেল না! প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের এক কর্তার কথায়, “তাঁর সফর যে ‘সফল’ হয়েছে, তাতেই খুশি মনমোহন।” |