ব্যাঙ্ক সামলে ব্যান্ড।
দিনভর হিসেবের অঙ্ক মিলিয়েও গানের অ্যালবাম। গত আড়াই বছর ধরে এই ‘আপাত অসাধ্য’ স্বপ্ন বুকে নিয়েই এক পা-দু’পা করে পথ চলেছে ‘দি ইস্টার্ন ব্লুজ’। আট গান-পাগল কর্পোরেট কর্তার হাতে গড়া বাংলা ব্যান্ড। বৃহস্পতিবারই বাজারে পা রাখল ওই ব্যান্ডের প্রথম অ্যালবাম ‘বন্ধু হাত বাড়াও’।
এই গান কতটা শ্রোতা টানবে, সে প্রশ্নের উত্তর এখনও অজানা। ঠিক যেমন জানা নেই, এই অ্যালবামকে আদৌ কতটা নম্বর দেবেন বিশারদেরা। কিন্তু এর মাধ্যমে এই ইঁদুর দৌড়ের দুনিয়ায় অন্তত একটু অন্য রকম ভাবার বার্তা খুব স্পষ্ট করে দিতে পেরেছেন একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের ওই আট কর্তা। সেই সঙ্গে হয়তো উস্কে দিয়েছেন একটা প্রশ্নও। তা হল, দিনের প্রায় সবটাই খেয়ে নেওয়া কাজের ‘শিডিউল’ আর ‘টার্গেট’ পূরণের ক্রমাগত চাপ কর্মীদের স্রেফ শুষে নিচ্ছে জেনেও, তাঁদের ভাললাগার পরিসরটুকু সামান্য প্রশস্ত করতে কতটা আগ্রহী কোনও কর্পোরেট সংস্থা? কাজের ক্ষতি না-করে কতটা আগ্রহী কর্মীদের উৎসাহ দিতে? আখেরে তাঁদের মন ফুরফুরে আর চাঙ্গা থাকলে, তবেই তো তার ছাপ পড়বে কাজের পরিসরে। |
সৌর্যেন্দু, প্রিতম, অতনু, মুকুন্দ, সায়ন্তন, শুভব্রত, দেবরাজ এবং মিত্রাক্ষর। এঁদের সকলেরই দাবি, এই অ্যালবামের জন্য ব্যাঙ্ক এবং সহকর্মীদের থেকে প্রায় প্রতি পায়ে সহযোগিতা পেয়েছেন তাঁরা। গান গাওয়ার জন্য ব্যাঙ্ক হয়তো অফিস ছুটি দেয়নি। কিন্তু তেমনই বাধাও হয়ে দাঁড়ায়নি গিটার হাতে তুলতে। বরং উৎসাহ দিতে মেল মারফত সব কর্মীকে জানিয়ে দিয়েছে অ্যালবাম প্রকাশের সাফল্য। আর সেই কারণেই সারা রাত গান-বাজনার পরেও অফিসের কাজে ভোরের ফ্লাইট ধরতে তেতো হয়নি মুখ। ক্লান্তি আসেনি ফের হিসেবের খাতা টেনে বসতেও।
কোনও বিষয়ের প্রতি নিখাদ ভালবাসা থাকলে, তার জন্য অক্লান্ত হতে পারে মানুষ। পারে চড়া রোদেও মাইলের পর মাইল হাঁটতে। যে কারণে সকাল সওয়া ন’টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত টানা অফিসের ধকল সামলানোর পরও রাত তিনটে পর্যন্ত অক্লেশে গান করেছেন এই আট এইচডিএফসি ব্যাঙ্ক কর্তা। শনি-রবিতে শপিং মলে ছোটেননি। বরং ক্রমাগত খুঁজে গিয়েছেন গিটারের সঙ্গে তবলা কোথাও বেতালা বাজছে কিনা। নিজেদের গাঁটের কড়ি খরচা করে এক এক করে কিনেছেন যাবতীয় সরঞ্জাম। ‘মিক্সিংয়ের জন্য’ এসেছে কম্পিউটার। ভাড়া করা দু’কামরার ফ্ল্যাটেই নিজেদের মতো করে গড়ে ফেলেছেন আস্ত স্টুডিও। অ্যালবামের যাবতীয় গান রেকর্ড হয়েছে সেখানেই। রেকর্ডিং ‘সাউন্ডপ্রুফ’ করতে ব্যবহার হয়েছে কম্বল। কখনও আবার কাজে এসেছে তোয়ালেও।
এই আট গানওলার কেউ ভাইস প্রেসিডেন্ট, কেউ বা ব্রাঞ্চ ম্যানেজার। তাই স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ছিল, দিনভর হিসেব-নিকেশ, ঋণ আর সুদের অঙ্ক কষে কখনও ক্লান্তি আসেনি? মনে হয়নি যে বড় বেশি চাপ নিচ্ছি নিজের উপর? সৌর্যেন্দু থেকে মিত্রাক্ষর, অতনু থেকে প্রিতম সকলেরই জবাব, “না। বরং গানেই ধুয়ে গিয়েছে ক্লান্তি। যাবতীয় চাপ শুষে নিয়েছে তবলার বোল। তার ফলে কাজের জগতে অনেক তরতাজা থাকতে পেরেছি আমরা।”
হয়তো এই কারণেই সম্প্রতি কলকাতায় বাংলা ব্যান্ড গড়েছেন পাঁচ ব্যস্ত ডাক্তার। ‘ডক্টর্স ব্যান্ড’ হয়েছে পুণেতেও। মাথায় সারাক্ষণ চেপে থাকা চাপ সরাতে সম্প্রতি তুলি ধরেছেন কেশব মহীন্দ্রা, আজিম প্রেমজি, নয়না লাল কিদোয়াই-সহ দেশের প্রথম সারির ২৫ জন সিইও। রীতিমতো আগ্রহ নিয়ে ছবির প্রদর্শনীও করেছেন তাঁরা। এ ভাবেই কাজের বাইরে নিজের জন্য এক্কেবারে নিজের মতো করে স্বতন্ত্র একটা জায়গা তৈরি করতে চাইছে ‘টার্গেট’ আর ‘ডেডলাইন’-এর পিছনে সারাক্ষণ দৌড়ে ক্লান্ত কর্পোরেট দুনিয়া। এবং বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রবণতা বাড়ছে যথেষ্ট দ্রুত গতিতে।
এ প্রসঙ্গে উপদেষ্টা সংস্থা প্রাইসওয়াটারহাউস কুপার্স-এর ট্যালেন্ট ডেভেলপমেন্ট বিভাগের প্রধান বীর্যেন্দু গুপ্ত জানাচ্ছেন, “আজকের প্রজন্ম পছন্দসই চাকরি বাছতে শুধু বেতনের অঙ্ক দেখে না। মেপে নেয় সেখানকার কাজের ‘ফ্লেক্সিবিলিটি’ এবং শেখার সুযোগ। ভাবে, নিজের মতো করে চিন্তা-ভাবনা করার আদৌ কতটা সুযোগ রয়েছে সেখানে।” তাঁর মতে, যে কারও ভাললাগার বিষয়ে পাশে দাঁড়ানো হয়তো সব সময় সম্ভব নয় সংস্থার পক্ষে। কিন্তু কাজের ক্ষতি না-হলে, উচিত নয় তাতে বাধা দেওয়াও। একমাত্র তবেই সংস্থার জন্যও নিজেকে উজাড় করে দেবেন কর্মীরা।
কিছু সংস্থা যে ইতিমধ্যেই এই পথে হাঁটতে শুরু করেনি, এমনটা নয়। যেমন, গুগ্ল ইন্ডিয়ার কর্পোরেট কমিউনিকেশন্স এবং পাবলিক অ্যাফেয়ার্স বিভাগের প্রধান পরমা রায়চৌধুরীর দাবি, “সপ্তাহে এক দিন ইঞ্জিনিয়ারদের নিজের পছন্দসই প্রোজেক্টে কাজ করার সুযোগ দিই আমরা। এমনকী এর থেকেই জন্ম জি-মেল এবং গুগ্ল নিউজের। এ ছাড়া বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে অংশ নিতেও কর্মীদের সব সময় উৎসাহ দেয় সংস্থা।” কর্মীদের চিন্তার এমন স্বাধীনতা দেওয়ার পক্ষপাতী আরও বেশ কিছু বিদেশি সংস্থাও। কিন্তু ভারতে এই সংস্কৃতি এখনও দূর অস্ৎ বলেই এঁদের দাবি। |