|
|
|
|
প্রবন্ধ... |
ধরুন, এটাই ছাদনাতলা |
বিয়ে মানেই জৌলুস! ফলে, ভারতের বিবাহ-বাজারে পোয়াবারো।
এক দিকে
অমিতব্যয়। অন্য দিকে অনাহার। বিচিত্র এই দেশ! লিখছেন
মাধবী মাইতি |
বিশ্বায়ন অনেক কিছুই পালটে দিয়েছে। এ দেশের বিয়ের বাজারও। ভারতের বিবাহ-বাজারে পণ্যদ্রব্যের যে লেনদেন হয়, তার আনুমানিক দাম বছরে ১ লক্ষ ২৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। প্রতি বছরে এর বৃদ্ধির হার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। এক-একটা ভারতীয় বিয়ের গড়পড়তা খরচ ৫ লক্ষ থেকে ৫ কোটির মধ্যে। ৫০ হাজারের নীচে বিয়ে গ্রামের এক জন গরিব নিম্নবিত্ত খেতমজুর বা শহরের এক জন রিকশাচালকও ভাবতে পারেন না। বিশেষজ্ঞদের সমীক্ষা বলছে, ২০০৯ সালেই ভারতীয় মধ্যবিত্তের বিয়ের খরচ ছিল ১৫ লাখের মধ্যে, তাও আবার গয়না বাদ দিয়ে।
১২৫ কোটির দেশে যদি গড়ে প্রতি পাঁচ জনের জন্য যদি একটি পরিবার ধরা হয়, তা হলে পরিবারের সংখ্যা ২৫ কোটি। বছরে অন্তত ১ কোটি বিয়ে। কম করে ধরলেও ১০ গ্রাম থেকে ৪০ গ্রাম সোনা খরচ হয় প্রতিটি বিয়েতে। কোনও ঊর্ধ্বসীমা নেই। সোনার গয়না ছাড়া বিয়ের কথা ভাবতে পারেন না গরিব-বড়লোক নির্বিশেষে। শুভকাজে সোনার ব্যবহার ভারতের পুরনো প্রথা। ভারত সোনা আমদানি করে বছরে ৩০০০ টন।
সমীক্ষা অনুযায়ী একটি ভারতীয় পরিবার সারা জীবনে যা আয় করে, মোটামুটি তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ খরচ করে বিয়ের জন্য। কে না ব্যবসা করে এখানে? ইভেন্ট ম্যানেজার, ওয়েডিং প্ল্যানার ডেকরেটর, বিউটি ইন্ডাস্ট্রি, বড় বড় কসমেটিক কোম্পানি, হোম অ্যাপ্লায়েন্স (ফ্রিজ, টিভি, মডিউলার কিচেন, ওয়াশিং মেশিন, ওয়ার্ডরোব, খাট-বিছানা কত শত জিনিস), অর্কেস্ট্রা, ভিডিয়ো, জুতো, মোবাইল ফোন, অ্যাকসেসরিজ, ট্রাভেল এজেন্সি, বিয়ের বিজ্ঞাপন সংস্থা (প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া), ফ্যাশন ডিজাইনার, কেটারিং কোম্পানি, ফুলের দোকান, বিউটি পার্লার, তত্ত্ব সাজানোর এক্সপার্ট অর্থাৎ প্যাকেজিং এজেন্সি, মিষ্টির দোকান, জ্যোতিষী, পুরোহিত, এখন আবার ইনশিওরেন্স কোম্পানি। এক-একটা ডিজাইনার নেমন্তন্ন কার্ডে কেউ কেউ ১০০ টাকাও খরচ করেন। |
 |
একটি বিশেষ ব্র্যান্ডের কোম্পানি কেবলমাত্র বিয়ের কথা মাথায় রেখে বাজারে ছেড়েছিল এমন একটি হাতঘড়ি, যার দাম মোটামুটি ৮ থেকে ১০ লাখ। অনায়াসেই বাঙালি মধ্যবিত্ত কনের জন্য ডিজাইনার লেহঙ্গা চোলি কেনেন ১ লাখ টাকার। বাঙালি বিয়েতেও এসে গেছে থালি গার্ল, মেয়েদের সংগীত, মেহেন্দি, ব্যাচেলর পার্টি। ফিল্ম সেটের অনুসরণে বিয়ের মণ্ডপ তৈরি করছে উচ্চবিত্ত। বলিউডের সেট ডিজাইনাররা প্যান্ডেল তৈরি করছেন। ফাইভ স্টার হোটেলের ধারণা পুরনো হয়ে গেছে। রাজা-রাজড়াদের প্রাসাদ ভাড়া নেওয়াটাও নতুন কিছু নয়। এখন ২৫০ থেকে ৩০০ ‘বারাতি’ উড়ে যাচ্ছে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর। বলিউডি স্টারদের ডাকা হচ্ছে মনোরঞ্জনের জন্য। শাহরুখ খান এক-একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য ফি নেন ৩ থেকে ৪ কোটি টাকা। অর্কেস্ট্রার বদলে এখন ডি জে’রা বিয়ের অনুষ্ঠান পরিচালনা করে। সাধারণ মধ্যবিত্তের বিয়েতেই ফুল লাগে ২ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকার। উচ্চবিত্তের ক্ষেত্রে কত লাখ? প্রতি প্লেট খাবারের জন্য লোকে হামেশাই খরচ করে ৭০০ থেকে ১০০০ টাকা। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় একটি ব্যবসায়ী পরিবারের বিয়েতে দেখেছি ৯০০ টাকা প্লেট। তেমন উচ্চবিত্ত নয় পরিবার। আমরা সকলেই জানি এত দামি-দামি খাবারের শেষ পরিণাম কী। সাম্প্রতিক সমীক্ষায় উঠে এসেছে ভারতে উৎপাদিত সব্জি ও শস্যের ১৫ ভাগ নষ্ট হয় কেবলমাত্র বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোয়। আর গ্রাম ভারতের ৫০ শতাংশ বাচ্চা অপুষ্টিতে ভোগে।
বিয়ের জৌলুসের ব্যাপারে যে শুধু প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি বা বনেদি ব্যবসায়ী পরিবারগুলো এগিয়ে, এ কথা কিন্তু মোটেই বলা যাবে না। ঝলমলে বিয়ের ব্যাপারে বেশি আগ্রহী প্রথম প্রজন্মের বড়লোকেরা। তার মধ্যে যেমন শিল্পপতিরাও রয়েছে, তেমনই রয়েছেন রাজনৈতিক নেতা, রিয়েল এস্টেটের কারবারি, রিটেল চেনের মালিক এ রকম হরেক লোক। বিয়েটা তাঁদের সম্পদ প্রদর্শনের জায়গা। এ ভাবে তাঁরা ক্ষমতা কেনেন। যত ঝলমলে অনুষ্ঠান, তত ক্ষমতা। গত শতকের নয়ের দশকের অর্থনীতির উদারীকরণ যে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির সৃষ্টি করেছে, ঝলমলে বিয়েতে তাঁদের আগ্রহ বেশি।
আমরা জানি, এই অপুষ্টি ও অনাহারের দেশেও একটা বিশেষ শ্রেণির ভারতীয়ের আয় প্রচুর পরিমাণে খরচযোগ্য। ‘উন্নতীশীল’ এই ভারতের লোকেরা বিয়েটাকে ব্যবহার করছেন এক দিকে সম্পদ প্রদর্শনের ক্ষেত্র তো অন্য দিকে পরিবারের মান মর্যাদা আভিজাত্য উন্নতি সৌভাগ্যের মাপকাঠি। ‘খানদান কি ইজ্জত’। পণ দেওয়া নেওয়া মোটেও কোনও খারাপ কাজ নয়, বরং স্টেটাস সিম্বল। কিলো কিলো সোনা, লাক্সারি ফ্ল্যাট, জমি-বাড়ি, দামি গাড়ি যদি না-ই দিই তা হলে লোককে বলবটা কী? সবই তো এখন দেখাবার জিনিস। বিয়ের বিজ্ঞাপনে কনেটাকেও ‘প্রেজেন্টেবল’ চাওয়া হয়। কিন্তু খরচযোগ্য আয়ের বাইরে যাঁরা রয়েছেন, সেই সব মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত মানুষের কাছে ব্যাপারটা কতখানি ভয়াবহ? একে তো লোকদেখানো অমিতব্যয়িতা একটি ছোঁয়াচে রোগের মতো। বড় সহজে এ আশপাশের লোককে আক্রান্ত করে। তার পর চাপটা যখন বিয়ের পাত্রীর ওপরে পড়ে? সমস্যাটা তখন মরণ-বাঁচনের।
হিন্দি সিনেমা যা করে উঠতে পারেনি, টিভি সিরিয়াল তা করে দেখিয়েছে। সব হিন্দি সিরিয়ালই শুরু হয় বিয়ে অথবা বিয়ের প্রস্তুতি দিয়ে। কেউ বা কিছুটা সময় নেয়। কিন্তু বিয়ে আছেই। এমনকী বার বার বিয়ে। একই পাত্রপাত্রী ঘুরিয়েফিরিয়ে নানা ঘটনায় দুর্ঘটনায় বার বার বিয়ে করছে। সে সব বিয়ের ভারী ভারী গয়না, ডিজাইনার শাড়ি ও লেহঙ্গা, মণ্ডপ, বাড়ি সাজানো, দেওয়ালের রং আসবাবপত্র, গাড়ি— শুধু একবার দেখিয়েই ওরা ক্ষান্ত হয় না, ক্যামেরা বারবার প্যান করে মানুষগুলোর ঝকঝকে চুল, ঝকঝকে চামড়া, দামি লিপস্টিক, নেলপালিশ, আইশ্যাডো, আইলাইনার, বিশাল শোবার ঘর, ডিজাইনার আসবাব, ঝাঁ চকচকে রান্নাঘর ইত্যাদি অনেক কিছুর ওপর। বাংলা সিরিয়ালও দূরে নেই। মাঝে মাঝে সংলাপের মধ্যেই থাকছে গয়না ছাড়া বিয়ে অমঙ্গল। ঠিকমতো দিতেথুতে না পারলে ‘অপশগুন’ হয়ে যাবে। অপশগুন অর্থাৎ অশুভের অবশ্য শেষ নেই। সিরিয়ালগুলোতে কথায় কথায় অশুভের ভয় দেখানো হয়। বাজার এই জায়গাটা নেয়। সব অমঙ্গল কেটে যাবে ধনতেরাস কিনলে। পুরনো প্রথা, রীতি-নীতি, নিয়মকানুন নতুন করে নিয়ম করে ফিরে আসছে। বেশি প্রথা, বেশি আচার-বিচার, বেশি ব্রত, বেশি উৎসব তার মানে বেশি জিনিসপত্র, বেশি উপহার, বেশি কেনাকাটা। বাজার এই তো চায়। |
|
|
 |
|
|