প্রতি পক্ষ
অন্য এক প্রান্তিক বিনোদন
ই পি এল ফুরোল সদ্য। কলকাতা নাইট রাইডার্স বিজয়ী, তাই গোটা শহর ভেসে যাচ্ছে আনন্দে। ‘সিটি অব জয়’ নামটা, অন্য ভাবে, সার্থক হয়ে উঠছে আরও এক বার। এখন, এই মৌজমস্তির সময়, আসুন, অন্য এক ধাঁচের আনন্দের দিকে তাকাই। তখন তাপপ্রবাহে দগ্ধ গোটা শহর। সেই দুঃসহ গরমে, অস্বস্তিসূচককে অনেকখানি ঠেলে তুলে শরীর যখন ঘামে গলে যাচ্ছে প্রায়, সে রকমই একটা সময় শুরু হল সেই মস্তি।
একদম সেই উৎসবপ্রাঙ্গণ থেকে বলছি... না, আমার নামটা জরুরি নয়। এই জন্যেই নয় যে আসলে আমার কোনও নাম নেই। কারণ, এই যে এখানে জমায়েত হয়েছে যে জনতা, নিতান্ত খেটে-খাওয়া জনতা, তাদেরও আসলে কোনও নাম নেই। আজ আমি সেই জমায়েতেরই একটা টুকরো। আপনাদের সামনে তুলে ধরছি এই বিচিত্র মস্তির ধারাবিবরণী। যদি অবশ্য ধারাবিবরণী বলে কিছু হয় এই মোচ্ছবের, কারণ চরিত্রে এই বস্তুটি নিতান্তই দৃশ্য-শ্রাব্য, পরিভাষায় অডিও-ভিস্যুয়াল! তাকে স্রেফ শব্দে ধরা কঠিন শুধু নয়, কার্যত অসম্ভব। তবু, একটা চেষ্টা করা যাক।
এই জায়গাটা আসলে একটি সিনেমা হল। খাস কলকাতার একটি সিনেমা হল। হালফিলের লব্জে, সিঙ্গল-স্ক্রিন থিয়েটার। বাংলায় কী হবে, এক-পর্দা প্রেক্ষাগৃহ! সুতরাং, মাল্টিপ্লেক্স-এর সুরম্য পরিষেবা এখানে মিলবে না। হাতের পাশে পপকর্নের প্যাকেট নেই, তবে কাগুজে ঠোঙা আছে। তাতে ঝালমুড়ি, হলের বাইরে জমিয়ে মাখছে এক ঝালমুড়িওলা! তারই কাঁচা লঙ্কার টুকরো-টাকরা মাঝেমধ্যে ঝিকিয়ে উঠছে জিভে, তখন উস-আস শব্দ! আছে হজমি। আচার। সস্তার আরও নানা খাদ্যবস্তু। এখন দুপুর, কিন্তু বোঝা যাচ্ছে, এখনই অনেকের পেটে কড়া দেশি মদ। গন্ধ আসছে, ঝাঁঝালো কটু গন্ধ, কিন্তু তাতে নাক সিঁটকোলে চলবে না। গ্রীষ্মের রোদ আর বছরভর খাটুনির দাহ এখন তরল আগুন হয়ে দেখা দিয়েছে।
সেই আগুন নেভায় কে?
কে আবার, ওই যে পর্দায় নাচছে যে মেয়েটি, সে!
সিনেমা হলে এখন একটি ভোজপুরি ছবি চলছে।
উঁহু, অত পরিশীলন-টিলন আশা করবেন না। রীতিমতো আইটেম নাম্বার! হাঁটুর অনেকটা ওপরে কাপড়, দুই উরু দৃশ্যমান, তাদের আবার সুন্দরী প্রতিযোগিতার নিরিখে মোটেই সুগঠিত বলা যাবে না, কিন্তু সেই বিপুল উরুদেশই এখানে দর্শকদের মধ্যে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে। শরীরের আরও নানা বাঁক, বিভঙ্গও দৃশ্যমান। কী ভাবে দৃশ্যমান, তার বিবরণ দেওয়া মুশকিল, কারণ খুব শালীন মধ্যবিত্ত বঙ্গীয় শব্দরুচিতে তাকে ধরা যাবে না।
ধরা যায়ও না। আর, গানটা যখন চলছে, নাচটাও, তখন ওই যে কিছু লোক উঠে দাঁড়িয়ে নাচতে শুরু করল, সিটি দিচ্ছে, তালি দিচ্ছে, ওদের এই উল্লাসকে, এই অঙ্গভঙ্গিকেই বা কী ভাবে ধরবেন, শব্দে? ক্যামেরা বের করা যাবে না এখানে, চার পাশের লোকজন ঝাঁপিয়ে পড়বে তৎক্ষণাৎ!
অলঙ্করণ : দেবাশীষ দেব
এ এক বিচিত্র প্রদেশের কাহিনি। এখানে মেয়েরা অসম্ভব রকম শরীরী, খলনায়কেরাসাক্ষাৎ অসুর, নায়ক দেবতুল্য, মহা বলবান। খলনায়কেরা অদ্ভুত, কামার্ত ভঙ্গিতে ঝাঁপ দেয় মেয়েদের গায়ে। পোশাক-টোশাক সব এলোমেলো হয়, মানে ওই, ছিঁড়ে-টিঁড়ে একেবারে...না, আবার ওই শালীনতার টেমপ্লেট-এ আটকাবে!
‘টেমপ্লেট’ শব্দটার ঠিকঠাক বাংলা কী হয়, কে জানে! কাঠামো বললে বোধহয় অনেকটা কাছাকাছি যাওয়া যায়। সে যাই হোক, ওই যে বলছিলাম, শালীনতার টেমপ্লেট-এ আটকাবে! তাতে এই উল্লসিত জনতার কিচ্ছু যায়-আসে না!
তারা দারুণ উপভোগ করছে এই ছবি! এই যে এখানে সফ্ট পর্নোর টাকনা সহযোগে সামাজিক-পারিবারিক-পৌরাণিক একটি খিচুড়ি পরিবেশিত হচ্ছে, সেটা তারা চেটেপুটে খাচ্ছে!
কী ভাবছেন, প্রলেতারিয়েত! সংস্কৃতিবান নয়! রুচি একটু নিম্নগামী!
উঁহু, অত সোজা নয়। মূল্যবোধ অতি বিষম বস্তু। পাশাপাশি, নানা রকম বিচিত্র জিনিস জড়ো হয় সেখানে। ফলে, ঝট করে একটা বিধান হেঁকে দেওয়া কঠিন! যেমন, এই যে দেশি মদে চুর, নাচতে থাকা লোকটির পাশে, ধরা যাক, অন্য একটি ছবি ভেসে উঠবে তৎক্ষণাৎ! অভিজাত একটি নিশি-নিলয়ে পোল ডান্স চলছে, সেখানে ঝকঝকে বিলিতি অক্ষরে আহ্বান, আসুন, পাপ করি! ডান্স ফ্লোর-এ অগুনতি চটুল শরীর। এই রাত তোমার আমার, পাপের হাতছানিতে যদি এখনও না ভাসি, তা হলে আর কবে!
ও সব এখানে নেই। এখানে শুধু মস্তি আছে। তুমুল মস্তি! কথা নেই বার্তা নেই, মেয়েদের শরীর খানিকক্ষণ অন্তর অন্তর দেখা দিচ্ছে পর্দায়। তখন দর্শকদের প্রতিক্রিয়া কী হয়, সে সব খবর বড় কাগজে ঠাঁই পায় না। কোনও মাইক্রোফোন আসে না সামনে, ‘আপনার কেমন লাগল?’ বলে সরু চোখে, মধুর হেসে তাকান না কোনও টেলি-সুন্দরী!
এখানে পর্দায় নাচ শুরু হতেই দর্শকরাও প্রবল উত্তেজনায় বিবিধ চিৎকার শুরু করেন। সে সব আদপেই সুললিত নয়। তাঁরা আরও কী করেন, কী করতে চান, সে সব প্রত্যক্ষ করেছি বটে, কিন্তু সে মোটেই ভদ্রবাড়ির ভাঁজ-করা আড়খ্যামটা নয়, খ্যামটারই সম্পূর্ণ এবং আনসেন্সর্ড (নাকি, ‘অকর্তিত’) সংস্করণ! সে সবের মধ্যে আর ঢুকে কাজ নেই।
এ সম্পূর্ণ অন্য জগৎ! এখানে ‘মনোজ তিওয়ারি’ বললে মোটেই কে কে আর মনে পড়ে না। তা সে যতই তিনি শেষ ওভারে পরপর বাউন্ডারি হাঁকিয়ে শাহরুখ খানকে আই পি এল এনে দিন! এখানে ‘মনোজ তিওয়ারি’ মানে একটি ফিল্মি, গুম্ফবান নায়ক।
এখানে ‘রানি’ মানেও মোটেই মুখোপাধ্যায় নয়, চট্টোপাধ্যায়। রানি চট্টোপাধ্যায়। বঙ্গীয় শহুরে চক্ষুতে অচেনা ঠেকতে পারে, ‘গুগল’ করলেই দেখা যাবে, তিনি কে! আর, সংখ্যা-গুরুরা জানিয়ে দেবেন, মাল্টিপ্লেক্স এবং তথাকথিত মূল স্রোতকে তুড়ি মেরে কী দাপটে কাজ করছেন এই কন্যা, কত অজস্র মানুষ, থুড়ি পুরুষ তাঁর জন্য পাগল!
এই জগৎ, আমাদের চেনা কলকাতার অন্য দিক। অচেনা দিক। এ সবের বড় একটা খবর নিই না, ওই মাঝে মধ্যে, ফিচার-টিচার হলে, তখন...
হল থেকে বেরিয়ে এসেছি। আকাশে মেঘ করে এল। হাওয়া দিচ্ছে, এলোমেলো!
আই পি এল-এর নানাবিধ নায়কদের ছবি-সাঁটা ব্যানার দুলছে।
নিম্নবর্গের মহান উৎসবপ্রাঙ্গণ থেকে আপনাদের যার যার বাড়িতে ফিরিয়ে দিচ্ছি আমি...
না, আমার নামটা জরুরি নয়, কারণ...




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.