দেদার জল চুরি
সঙ্কট চলছেই
গোড়ায় গলদ!
আর সে কারণেই হাওড়া শহরে পানীয় জলের সঙ্কটের মোকাবিলা করতে পারছে না পুরসভা।
পুরসভার সূত্রে খবর, পদ্মপুকুর জলপ্রকল্প থেকে যে পাইপলাইন শহরে ছড়িয়ে পড়েছে সেই পাইপলাইনের নকশাই খুঁজে পাচ্ছে না পুরসভা। নকশা না থাকায় কোথায় কী কারণে জলের চাপ কমে যাচ্ছে বা কোন লাইন থেকে জল চুরি হচ্ছে তা বুঝে উঠতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট দফতরের ইঞ্জিনিয়ারেরা।
অথচ হাওড়া পুর কর্তৃপক্ষের দাবি, বেপরোয়া চুরির জন্যই হাওড়ায় পানীয় জলের এই সঙ্কট। হাওড়া জুড়ে কেবল বেআইনি পাইপলাইন সংযোগ এবং ফেরুলের উপদ্রবই নয়, প্রচুর জল চুরি হচ্ছে সংলগ্ন বালি পুর এলাকা থেকেও। একই সঙ্গে হাওড়ার জল চুরি করে পঞ্চায়েত এলাকাতেও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পানীয় জলের সঙ্কটে জেরবার হাওড়ার মেয়র মমতা জয়সোয়ালের বক্তব্য, “আমাদের যথেষ্ট জল আছে। কিন্তু চুরি ও রাস্তায় জল পড়ে নষ্ট হয়ে যাওয়ার জন্য এই সঙ্কট তৈরি হচ্ছে।” যদিও এই সঙ্কট থেকে বেরনোর কোনও নীল নকশা তাঁর হাতে নেই।
আর্থিক চুক্তির ভিত্তিতে বালিতে দৈনিক ৩ লক্ষ মিলিয়ন গ্যালন জল দেয় হাওড়া পুরসভা। এই জল দেওয়া হয় পদ্মপুকুর জলপ্রকল্প থেকে। কী ভাবে এই জল দেওয়া হয়? হাওড়া পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, পদ্মপুকুর জলপ্রকল্প থেকে একটি ৯০০ মিলিমিটার পাইপের মাধ্যমে বালির জন্য প্রথমে জল পাঠানো হয় তিনটি ভূগর্ভস্থ জলাধারে। যে জলাধারগুলি রয়েছে লিলুয়ার ভট্টনগর, সালকিয়া এবং বালির লালবাবা কলেজের কাছে। সেখানে জল জমা হওয়ার পর তা পাম্প করে বালি পুরসভা পাঠিয়ে দেয় বাড়ি বাড়ি।
হাওড়া পুরসভার ইঞ্জিনিয়ারদের অভিযোগ, সম্প্রতি হাওড়ার কয়েকটি ওয়ার্ডে জলের চাপ কমে যাওয়ার কারণ তদন্ত করতে গিয়ে জানা গিয়েছে, যে চাপে পদ্মপুকুর জলপ্রকল্পের পাম্প থেকে শহরের জন্য জল ছাড়া হচ্ছে সেই চাপ মাত্র আধ কিলোমিটার গিয়ে ৭০ শতাংশ কমে যাচ্ছে। অর্থাৎ এই আধ কিলোমিটারের মধ্যেই জল কোথাও বেরিয়ে যাচ্ছে বা টেনে নেওয়া হচ্ছে। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে ইঞ্জিনিয়ারেরা জানতে পারেন, পাম্প চালাবার পরই বেলগাছিয়া ও সালকিয়া ভূগর্ভস্থ জলাধারের (আন্ডারগ্রাউন্ড রিজার্ভার বা ইউজিআর) ভাল্ভ খুলে রাখায় ওই জল হু হু করে টেনে নিচ্ছে বালির পাইপলাইন। ফলে হাওড়া শহরে জলের চাপ কমে যাচ্ছে। জল পাচ্ছে না হাওড়া পুরসভার কিছু ওয়ার্ড।
হাওড়ার মেয়রের অভিযোগ, “বালি পুরসভার দিকে বেশি জল চুরি হচ্ছে। এই কারণে পদ্মপুকুরের পাম্প চালাবার পরই প্রচুর জল টেনে নিচ্ছে। চাপ কমে যাচ্ছে আমাদের। আমরা এই নিয়ে বালি পুরসভার কাছে অভিযোগ জানাব।” পাশাপাশি মেয়রের দাবি, শুধু বালি পুরসভাই নয়, হাওড়া পুরসভা সংলগ্ন পঞ্চায়েত এলাকাগুলি, যেমন চকপাড়া, আনন্দনগর, জগদীশপুর, চামরাইল এলাকাতেও পদ্মপুকুরের পাইপলাইনে বেআইনি সংযোগ করে জল চুরি হচ্ছে।
বালি পুরসভার চেয়ারম্যান অরুণাভ লাহিড়ী অবশ্য জল চুরির অভিযোগ মানতে চাননি। তিনি বলেন, “বিভিন্ন বাড়িতে পাম্প লাগিয়ে জল চুরি করতে পারে। ভাল্ভ খুলে রেখে জল টেনে নেওয়ার অভিযোগ ঠিক নয়। তবে বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখব।”
এই চুরি বন্ধ করেও সঙ্কট মেটার নয়। কারণ, পানীয় জল নিয়ে আরও বড় বেনিয়ম চলছে হাওড়া পুর এলাকাতেই। অভিযোগ উঠেছে, এক শ্রেণির কাউন্সিলর প্রভাব খাটিয়ে, সমস্ত নিয়মকানুন অগ্রাহ্য করে যে যাঁর ক্ষমতা অনুযায়ী নিজেদের এলাকায় পাইপলাইনের সংযোগ করে নিয়েছেন। ওই সব পাইপলাইনের যেমন কোনও নকশা নেই, কোথায় কী পাইপলাইন রয়েছে তার কোনও হিসেবও নেই। যার ফলে কোনও এলাকায় জলের চাপ বেড়ে গিয়েছে, আবার কোনও এলাকা একেবারে নির্জলা হয়ে গিয়েছে।
এই সঙ্কট থেকে বেরনোর উপায় কী?
মেয়রের কাছে অন্তত তার কোনও জবাব নেই। তিনি বলেন, “দীর্ঘ দিন বেআইনি ভাবে পাইপলাইন টেনে জল নেওয়ায় এখন পাইপলাইনের নকশা পর্যন্ত পুরসভায় নেই। এই বিশৃঙ্খলা দূর করতে না পারলে পানীয় জলের সঙ্কট মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।”
হাওড়া পুরসভার ৫০টি ওয়ার্ডের মধ্যে অধিকাংশ ওয়ার্ডে পানীয় জল সরবরাহ হয় মূলত পদ্মপুকুর জলপ্রকল্প থেকে। পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, এই প্রকল্পের বর্তমানে দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৩০ মিলিয়ন গ্যালন। এ ছাড়া পদ্মপুকুর জলপ্রকল্পের ভিতরে কেএমডিএ-র জলপ্রকল্পে উৎপাদন হয় ১৫ মিলিয়ন গ্যালন। ইঞ্জিনিয়ারদের মতে, এই ৪৫ মিলিয়ন গ্যালন জল হাওড়া শহরের পক্ষে যথেষ্ট।
পদ্মপুকুর জলপ্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক প্রাক্তন ইঞ্জিনিয়ারের মতে, পদ্মপুকুর জলপ্রকল্প চালুর সময় কয়েকটি ত্রুটি হয়েছিল। সেই ত্রুটিগুলিও জল সঙ্কটের অন্যতম কারণ হিসেবে ধরা যেতে পারে। ত্রুটিগুলি হল,
১) প্রকল্পটি তৈরির সময় একটি আমেরিকান সংস্থা শহরে পাইপলাইন পাতার যে নকশা তৈরি করেছিল তা বাতিল করে দিয়েছিলেন তৎকালীন বোর্ড কর্তারা।
২) ওই নকশা বাতিল করে খরচ বাঁচাতে শহরের পুরনো পাইপলাইন দিয়ে জল সরবরাহের ব্যবস্থা হয়। বর্তমানে যা মাটির তলায় অনেক জায়গাতেই ভেঙে পড়ছে।
৩) যখনই যে ওয়ার্ডে জলের সমস্যা হয়েছে সেই সব ওয়ার্ডের কাউন্সিলররা প্রভাব খাটিয়ে পদ্মপুকুর জলপ্রকল্পের পাইপলাইন থেকে সংযোগ নিয়ে নিজেদের এলাকায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন। ওই সব পাইপলাইনের কোনও নকশা যেমন পুরসভার কাছে নেই, নেই সমস্যা মেটাবার রাস্তাও। আর এই কারণেই একটি ওয়ার্ডে জলের চাপ থাকলেও পাশের ওয়ার্ডে চাপ কমে গিয়েছে। পুরসভার জলের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক ইঞ্জিনিয়ার বলেন, “এই অপরিণামদর্শিতার জন্য শহরের নীচ দিয়ে এখন শাখাপ্রশাখার মতো যে পাইপলাইন গিয়েছে তার কোনও নকশাও তৈরি হয়নি। ফলে, কোথায় জলের সমস্যা হচ্ছে বা কোথায় চুরি হচ্ছে, তা উদ্ধার করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। মূলত এই কারণেই হাওড়ায় জল সঙ্কট মেটা কঠিন।”




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.