এখন বাংলায় ভূত-চতুর্থী। এক দিকে রমরমিয়ে চলেছে অনীক দত্তের ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’। অন্য দিকে সত্যজিৎ রায় ও শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা চারটি ভূতের গল্প নিয়ে সন্দীপ রায় তৈরি করতে চলেছেন তাঁর নতুন ছবি। তারই মধ্যে আগামী শুক্রবার মুক্তি পাচ্ছে জয়দীপ ঘোষের ছবি ‘মায়াবাজার’।
জয়দীপ এর আগে এর আগে কয়েকটি তথ্যচিত্র করেছেন। কিন্তু ন্যাশনাল ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (এনএফডিসি)-এর প্রযোজনায় ৫৭ লক্ষ টাকার খুদকুঁড়োয় তৈরি ‘মায়াবাজার’ই তাঁর প্রথম কাহিনিচিত্র।
বাংলা সিনেমার বাজারে প্রতিটি ‘ভূতদর্শন’ই আলাদা। অনীক দত্ত আজকের সামাজিক বাস্তবতাকে ভূতেদের কৌতুকমুখর সংলাপে ধরেছিলেন। সন্দীপ রায় আগামী অগস্ট থেকে শুরু করবেন তাঁর শু্যটিং। ‘‘কৌতুক নয়। হরর ফিল্মের বীভৎসতাও নয়। আমি গা-ছমছমে অনুভূতি প্রকাশ করতে চাইছি,’’ বলছিলেন সন্দীপ। অন্য দিকে জয়দীপের ছবিতে মানুষের অবচেতনই উপজীব্য। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ও রাজশেখর বসুর তিনটি ছোট গল্প নিয়ে তৈরি ‘মায়াবাজার’। তিনটিই ভূতের গল্প। কিন্তু জয়দীপের চেষ্টা, সিনেমা মাধ্যমে তাদের দিয়ে অন্য কথা বলানো।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ছবির প্রথম গল্প ‘স্মৃতি’ (শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দেহান্তর’ অবলম্বনে)। নায়িকা রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের স্বামী বিজন রায় যুদ্ধে মারা গিয়েছেন। পরে তাঁর জীবনে যে অন্য প্রেমিক আসেন, তাঁর আইডেন্টিটিও ক্রমে বদলে যায়। তিনিও বিজন রায়ের মতো কড়া গলায় কথা বলেন, পাইপের ধোঁয়া ছাড়েন। শরদিন্দুর গল্পে বিজনের আত্মা মৃত্যুর পরেও ঈর্ষাকাতর। স্ত্রীর প্রেমিকদের উপর ভর করত সে। জয়দীপের ছবিতে ঈর্ষাই সব নয়। রয়েছে স্বামীর অবদমিত যৌন আকাঙ্ক্ষা। মৃত্যুর ও পার থেকে বিজন রায় রূপাকে জানান, ‘আমাকে আর ডেকো না। আমার বয়স যৌবনেই থেমে আছে। কিন্তু তুমি বুড়ি হয়ে গিয়েছ।’ তার পরই নিভু-নিভু আলোর পানশালায় রূপার নিঃসঙ্গ মদ্যপান। ফ্ল্যাশব্যাকে বলা গোটা কাহিনিটিই ‘হ্যালুসিনেশন’ নয় তো? “চরিত্রটা ওই কারণেই নিয়েছিলাম। সাদামাঠা গল্প নয়, বাস্তব আর পরাবাস্তবতার মাঝে ঝুলিয়ে রাখে,” হাসছেন নায়িকা। |
হিন্দিতে তুলসী র্যামসে, শ্যাম র্যামসে নামে দুই ভাই এক সময় ভূত, ড্রাকুলা নিয়ে হরদম ছবি বানাতেন। হাল আমলে রামগোপাল বর্মাও ছোট ছোট ভূতের গল্প নিয়ে তৈরি করেছেন ‘ডরনা মানা হ্যায়’ বা ‘ডরনা জরুরি হ্যায়’-এর মতো ছবি। কিন্তু সেগুলি নিছক ‘হরর ফিল্ম’। আর এই ‘হরর’ বা আতঙ্কের অনুভূতিটাকেই এড়িয়ে যেতে চান বর্ষীয়ান সন্দীপ থেকে তরুণ জয়দীপ সকলেই। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডিজের শিক্ষক মৈনাক বিশ্বাসের মতে, “হলিউড থেকে বলিউড সর্বত্র ভূতের ছবিগুলি ফিল্ম-অর্থনীতির প্রান্তে পড়ে থাকে। বড় বাজেট, মহাতারকা এবং দামি বিপণন কৌশল থাকে না।”
সত্যজিৎ রায়ের ‘মণিহারা’ ছবির শেষ শটে কথক অদৃশ্য, পড়ে আছে গাঁজার কল্কে। ‘তিন কন্যা’র এই ছবিটিকে কেটে শুধু ‘পোস্টমাস্টার’ আর ‘সমাপ্তি’ বিদেশে পাঠিয়েছিলেন সত্যজিৎ। তাঁর ধারণা ছিল, বিদেশি দর্শক ভূতের গল্প বুঝবে না। কয়েক দশক পেরিয়ে আজকে তাঁর পুত্র সন্দীপ আনতে চাইছেন গা ছমছমে ভাব। একুশ শতকে আমরা তা হলে ভূত-বিশ্বাসী হয়ে উঠলাম? “একেবারেই নয়,” কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের শিক্ষক তিলোত্তমা মুখোপাধ্যায় জানালেন, “ভূত ব্যাপারটা অবদমিত মনের ‘যৌন ফ্যান্টাসি’র বহিঃপ্রকাশ। তাই মানুষ ভয় পায়। কিন্তু এই অবদমন যখন সাহিত্যে বা সিনেমায় প্রকাশ পায়, ভয়টা আর থাকে না।” তিনি মনে করিয়ে দিলেন, ‘ভারতীয় মনোবিজ্ঞানের জনক’ গিরীন্দ্রশেখর বসু প্ল্যানচেট করতেন। তাঁর বন্ধু শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ভাই রাজশেখর বসুও থাকতেন সেখানে।
উনিশ শতকে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় কৌতুকছলে চেতন মনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এই হিমবাহের দিকেই নির্দেশ করেছিলেন, ‘যেমন জল জমিয়া বরফ হয়, অন্ধকার জমিয়া তেমনি ভূত হয়।....মানুষের মনের ভিতরে যে কত অন্ধকার, সীমা নাই, অন্ত নাই। কোদাল দিয়া কাটিয়া ঝুড়ি পুরিয়া এই অন্ধকার কলে ফেলিলেই প্রচুর পরিমাণ ভূত প্রস্তুত হইতে পারিবে।’
জয়দীপ সিনেমার পর্দায় কয় ঝুড়ি অন্ধকার তুলে আনলেন, বক্স অফিস-ই বলে দেবে। |