রবিবাসরীয় প্রবন্ধ
দুখটান

‘...বহুকাল আগের কথা, তখন জমি ছিল অনুর্বর ও মানুষ ছিল অভুক্ত, ঈশ্বর পৃথিবীতে এক নারীকে পাঠিয়ে দিলেন তাদের সমস্ত দুঃখ-দুর্দশা দূর করতে। সেই নারী মর্তে এসে ঘুরে বেড়াতে লাগল। যেখানে তার ডান হাত মাটি স্পর্শ করল, জন্ম নিল আলু; যেখানে বাঁ-হাত মাটি স্পর্শ করল, জন্ম নিল ভুট্টা। এই ভাবে বসুন্ধরা এক দিন সুজলা-সুফলা হয়ে উঠল। দীর্ঘ পথশ্রমে ক্লান্ত সেই নারী তখন মাটিতে বসে পড়ল বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। তখন তার স্পর্শে জন্ম নিল তাবাকা...’
হুরোন ইন্দিয়োদের কিংবদন্তি
৪৯২ সাল; নভেম্বর মাসের গোড়ার কথা। অতলস্পর্শী সুগভীর এক মহাসাগরের মাঝে বিন্দুর মতো ফুটে থাকা নদী-পাহাড়-ঝরনায় ভরা অনিন্দ্যসুন্দর এক দ্বীপ। সেই দ্বীপেরই ঘন দুর্ভেদ্য জঙ্গল, তার ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলেছে চারটি মানুষ; তাদের মধ্যে দু’জন শ্বেতাঙ্গ, পরনে ইয়োরোপীয় পোশাক, তারা স্পেন দেশের বাসিন্দা; অন্য দু’জন নেহাতই তামাটে-রঙা বুনো মানুষ, যৎসামান্য কটিবন্ধে নিবারিত হয়েছে লজ্জা। স্প্যানিয়ার্ড দু’জনকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে তারা। আলমিরান্তে তার দুই সঙ্গীকে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন ছ’দিনের মধ্যে প্রার্থিত সুসংবাদ নিয়ে তারা যেন ফিরে আসে।
আলমিরান্তে, অর্থাৎ অ্যাডমিরাল ক্রিস্টোফার কলম্বাসকে স্প্যানিয়ার্ডরা ডাকত কোলোন নামে। অপরূপ কুবানাকান (আজকের কুবা বা কিউবা)। দ্বীপটিতে পৌঁছে তিনি ভেবেছিলেন এই তাঁর স্বপ্নের এশিয়া ভূখণ্ড। এখান থেকেই কিছু দূরে তাঁদের আগমনের সংবাদ পেয়ে অপেক্ষা করছেন মার্কো পোলো-বর্ণিত ক্যাথে নামক দেশের প্রবল প্রতাপশালী মহামহিম সম্রাট গ্রেট খান চিন দেশের কুবলাই খান।
বহু প্রার্থিত এই সাক্ষাৎকারের সম্ভাবনাতেই তিনি এই সমুদ্রযাত্রায় সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন লুইস দে তোর্রেস নামে এক হিব্রু ও আরবি জানা দোভাষীকে, যে লোকটা আদতে ছিল জেলখাটা এক আসামি। আর অন্য শ্বেতাঙ্গটি হল রোদরিগো দে খেরেস। তারা বারো লিগ দূরে এক গাঁয়ে পৌঁছে দেখল সেখানে গোটা পঞ্চাশেক কুঁড়ে ঘর। চামড়ার সাদা রং দেখে মানুষজন তাদের দেবতা ভেবে সাদরে বরণ করে নিল; তাদের হাত ও পায়ে চুমু খেয়ে এবং গোটা দেহ, পোশাক-আশাক স্পর্শ করে নিশ্চিত হতে চাইল সত্যিই রক্তমাংসের মানুষ কি না! দোভাষী সেখানে কোনও কাজেই এল না। আর আকাঙ্ক্ষিত সোনারও খোঁজ মিলল না, মূলত যে সোনার লোভেই এই বিপদসঙ্কুল সমুদ্রযাত্রা; এমনকী সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া বিভিন্ন মশলাপাতি। যেমন, মরিচ, দারচিনি প্রভৃতি দেখে নাতিভোরা জানাল সেখানে এমন কোনও কিছু পাওয়া যায় না। তবে অনেক দূরে দক্ষিণ-পশ্চিমের এক দ্বীপে নাকি এগুলোর দেখা মেলে। তাই আর বৃথা সময় নষ্ট না করে স্প্যানিয়ার্ড দু’জন ফিরে এল। তবে সেখানে তারা একটা অদ্ভুত জিনিস দেখেছিল: গেঁয়ো লোকগুলো এক ধরনের গাছের পাতা গোল করে পাকিয়ে তার ডগায় আগুন ধরিয়ে বেশ মৌজ করে তার ধোঁয়া টানছে। এই ধোঁয়া পেটে গেলে নাকি তাদের সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যায়, শরীর চনমনে চাঙ্গা হয়ে ওঠে। এই বস্তুটি স্থানীয়দের কাছে পরিচিত ছিল ‘তাবাকা’ নামে। প্রথমে একে ‘ইন্ডিয়ান উইড’ নামে ডাকা হলেও পরবর্তীতে ইয়োরোপীয়দের জবানিতে হয়ে দাঁড়াবে ‘টোব্যাকো’।
ক্ষণটি ঐতিহাসিক, কারণ পুরনো পৃথিবীর বাসিন্দারা এই প্রথম বারের জন্য সাক্ষী থাকল ধূমপানের। অবশ্য, আলমিরান্তে তার লগ বুকে লিখে গেছেন দু’মাস দশ দিনের সমুদ্রযাত্রার শেষে ল্যান্ড ফল অর্থাৎ ‘প্রথম ডাঙা স্পর্শ’ করা হয় যে গুয়ানাহানি দ্বীপে, যেটির নতুন নাম রাখা হয়েছিল সান সালভাদোর সেখানে তিনি আগেই এই গাছের পাতা দেখেছিলেন। সেখানকার আরাওয়াক ইন্দিয়ো বাসিন্দারা ডিঙিতে করে তাদের জাহাজে নিয়ে আসত নানা রকমের ভেট: অজানা-অচেনা সব ফলমূল ও এক ধরনের শুকনো পাতা। যে পাতা দৃশ্যত নাতিভোদের কাছে ছিল মহার্ঘ বস্তু। কলম্বাস ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গোরা ফলমূলগুলো খেয়ে নিতেন, কিন্তু কটু গন্ধওলা সেই পাতাগুলোকে নিয়ে কী করবেন, তা বুঝতে না পেরে ফেলে দিতেন।
খেরেস-ই প্রথম ইয়োরোপীয়, যে এই তাবাকার স্বাদ নেয়। পরে সে যখন দেশে ফিরে আসে, দেখা যায় সেটি তার নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ দিকে স্পেনে তখন ইনকুইজিশন জারি। কথায় কথায় মানুষের ওপর নেমে আসে শাস্তির খাঁড়া। বউ-বাচ্চা নিয়ে ঘর করা ছাপোষা গেরস্থ মানুষ খেরেসের নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়া বেরোতে দেখে ভারী ভয় পেয়ে গেল। আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে কোথাকার কোন বুনো-জংলিদের দেশে গিয়ে কী সব জাদুটোনা শিখে এসেছে হতচ্ছাড়া! অবশ্য তখন লোকে জানত না আটলান্টিক হল এক মহাসাগর, তার নামও ছিল ভিন্ন ওশান সি; তারা দিল হোলি ইনকুইজিশনের কর্তাদের কাছে নালিশ ঠুকে। অদ্ভুতুড়ে এই কাণ্ডকারখানাকে ঈশ্বর-বিরোধী বিবেচনা করে খেরেসের সাত বছর কারাবাসের হুকুম হল। জেল থেকে যখন ছাড়া পেল সে, তখন গোটা স্পেন জুড়েই ধূমপান জনপ্রিয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সেই সময়, পঞ্চদশ শতকের শেষ ভাগে, ‘পুরনো পৃথিবীতে’ মনুষ্য-জ্ঞাত এই দুনিয়ার অন্তর্গত ছিল কেবল এশিয়া, ইয়োরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশ। নতুন পৃথিবী বা ‘নুয়েভো মুনদো’, অর্থাৎ আমেরিকা মহাদেশের অস্তিত্ব সম্বন্ধে জানা যায় কলম্বাসের সৌজন্যেই। জানা ছিল না পৃথিবীর প্রায় আশি শতাংশ জল ধারণ করে যে মহাসমুদ্র, সেই প্রশান্ত মহাসাগরের কথাও বেলাডোনা বা নিকোটিনা আফ্রিকানা নামক তামাক গাছের অল্পস্বল্প সন্ধান পাওয়া গেলেও সেগুলি যে নিয়মিত ভাবে চাষ-আবাদ বা দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করা হত, তেমনটি ভাবার মতো কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের মতে খ্রিস্টের জন্মের ছ’হাজার বছর আগে আমেরিকায় তামাক গাছের উৎপত্তি। তবে সেটির ব্যবহার শুরু সবে প্রথম খ্রিস্টপূর্বাব্দে; ধোঁয়া টেনে ও চিবিয়ে; আর পেরুর আগুয়ারুনা ইন্দিয়োদের মতো কেউ কেউ তা ব্যবহার করত হ্যালুসিনোজেনিক এনিমা রূপেও। খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে মায়া-সভ্যতার অন্তর্গত জনজাতির মানুষেরা মহাদেশের মধ্যভাগ থেকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। মায়াদের থেকেই ধূম্রপানের প্রথাটি আসে তোলতেকদের কাছে। শেষ সার্বভৌম আজতেক সম্রাট মনতেসুমার সভাসদেরা নৈশভোজন-পরবর্তী আমোদপ্রমোদের অনুষঙ্গ হিসেবে সকলে মিলে তামাকের সঙ্গে অন্যান্য গাছ-গাছালির রজন মিশিয়ে নলখাগড়া বা ফাঁপা বাঁশের কঞ্চির সাহায্যে ধোঁয়া টেনে তার মৌতাত নিত; অনেক সময় এর সঙ্গে সুগন্ধিও মেশানো হত। অন্য দিকে গরিবগুর্বোরা অত ঝুটঝামেলার মধ্যে না গিয়ে শুকনো তামাককে পাম বা ভুট্টা পাতায় মুড়ে তার ডগায় আগুন ধরিয়ে নিত। এ হেন ধূমপানের প্রথম সচিত্র প্রমাণ পাওয়া যায় গুয়াতেমালায়, মৃৎপাত্রে; সেখানে অঙ্কিত ছবিতে দেখা যায় তামাকপাতাকে পাকিয়ে তাকে সুতোর সাহায্যে বেঁধে নেওয়া হয়েছে। এই বিশেষ রূপে ধূম্রপান পদ্ধতিকে বলা হত সি’কাহর, যার থেকেই উৎপত্তি ‘সিগার’ শব্দটি।
যাঁর নামে এই নতুন মহাদেশটির নাম যদিও ভ্রান্তিবশত সেই আমেরিগো ভেসপুচ্চি জানিয়েছেন ইন্দিয়োরা গলায় দুটো লাউয়ের খোল ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াত; একটায় থাকত তামাক পাতা, অন্যটায় এক ধরনের পাউডার। প্রথমে তারা তামাকপাতা মুখে দিত, তার পরে একটা ডাল থুতু দিয়ে ভিজিয়ে পাউডারে ডুবিয়ে সেটা মুখের পাতায় লাগাত। এ ভাবেই চিবিয়ে তামাকের স্বাদ নেওয়া হত।
মৃত্যু-পেশায় সিগারেটের রমরমা সাফল্য। বিগড়োনোর জন্য হার্ট আর লাংস হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করবে। কম বয়সে হার্ট অ্যাটাকের জন্য যত মৃত্যু নথিবদ্ধ, তাদের চার জনের তিন জন ধূমপানের বলি। অন্য দিকে, ভাগ্য ভাল হলে ব্রঙ্কাইটিস হয়ে ফুসফুসটা আস্তে আস্তে পচবে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ফুসফুসে ক্যান্সার হবে। এই ক্যান্সারে বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা এখনও অনেকটাই কম। আর ফুসফুসের ক্যান্সার রোগীদের নাকি ৮৭%-ই ধূমপায়ী। ফুসফুস জবাব দিলেই, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও আর অক্সিজেন পৌঁছবে না, হাত-পা অকেজো হয়ে যাবে। ডাক্তার সেগুলো কেটে বাদ দিয়ে দেবেন। বাঁচোয়া একটাই। বেশি দিন এই বিকলাঙ্গ জীবনটাকে বইতে হবে না। সিগারেট তার ভক্তদের প্রতি দু’জনের এক জনকে মেরে ফেলবেই, তাদের অর্ধেককে আবার মধ্য বয়সের আগেই খতম করে দেয়। গড় ধরলে, ধূমপায়ীদের জীবন, মেয়াদের অন্তত ১৩.২ বছর আগেই শেষ হয়ে যায়। মহিলাদের ক্ষেত্রে হিসেবটা ১৪.৫ বছর।
মূলত, স্পেন ও পর্তুগালের নাবিকদের মাধ্যমেই এক বন্দর থেকে অন্য বন্দর হয়ে ক্রমে গোটা ইয়োরোপ জুড়ে তামাকের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম দিকে অন্ত্যজবর্গের মানুষ কিছুটা কৌতূহলবশতই এর স্বাদ নিত; আর তার থেকে নেশায় পরিবর্তিত হতে বেশি সময় লাগত না। তবে রাজানুগ্রহ লাভ করতে তামাকের অবশ্য আরও বেশ কিছু দিন লেগে যাবে।
ধীরে ধীরে তামাক নিয়ে নানা উদ্ভট ধ্যানধারণাও ইয়োরোপে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ১৫৬০ সালে পর্তুগালে কর্মরত ফরাসি রাষ্ট্রদূত জঁনিকো দে ভিইয়েমাঁ তাবাকাকে ‘সর্বরোগহর ঔষধ’ হিসেবে বর্ণিত করে ফ্রান্সের রাজমাতা ক্যাথরিন দে মেদিসির কাছে তামাকের গুঁড়ো পাঠিয়ে দেন তার ছেলে দ্বিতীয় ফ্রান্সিসের মাথাধরা রোগ সারানোর জন্য। এর কয়েক বছর পরেই আর এক ফরাসি আঁদ্রে থেবে ঘোষণা করেন, ‘ধূমপান মস্তিষ্কের অভ্যন্তরস্থ অতিরিক্ত জলীয় বাষ্পকে শুষে নিতে সাহায্য করে।’ আর জার্মান চিকিৎসক মিখায়েল বেনার্ড ভালেন্টিনি আর এক ধাপ এগিয়ে তাঁর ‘এক্সটিক রেমেডিজ’ বইটিতে জানান ধূমপান করলে কলিক পেন, নেফ্রাইটিস, হিস্টিরিয়া, হার্নিয়া, ডিসেন্ট্রি প্রভৃতি রোগও সেরে যায়। স্পেনের এক চিকিৎসক নিকোলাস মোনারদেস তাঁর ‘দে ইয়েরবা পানাসেয়া’ বইটিতে ছত্রিশটি রোগের একটি তালিকাও প্রকাশ করেন, যেগুলি নাকি ধূমপানের সাহায্যে প্রতিরোধ করা সম্ভব। ১৮৯৯ সালে বিশ্বখ্যাত মার্ক ম্যানুয়াল-এর প্রথম সংস্করণে দাবি করা হয় ধূমপান করলে ব্রঙ্কাইটিস ও অ্যাজমা সেরে যায়। এ ছাড়াও রোগ-মুক্তির তালিকায় বিভিন্ন সময়ে সংযুক্ত হয় দাঁতের ব্যথা, কৃমি, নিশ্বাসে দুর্গন্ধ, এমনকী ক্যান্সার ।
ও দিকে তখন ইংল্যান্ড জুড়েও জোর হইচই। কলোনি গড়ে তুলতে যে সমস্ত ইংরেজ ভার্জিনিয়ায় পাড়ি দিয়েছিল তারা দেশে ফিরে এল, আর প্লিমাথের জাহাজঘাটায় পা রাখামাত্র দেখা গেল অনেকের মুখে ঝুলছে নলাকৃতি এক ধরনের বস্তু, আর তা থেকে গলগল করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। এই সব কাণ্ডকারখানা দেখে গোটা দেশ আলোড়ন সৃষ্টি হল। স্বয়ং রানিও এই হুজুগেপনা থেকে বাদ গেলেন না, স্যর ওয়াল্টার র্যালের প্ররোচনায় এলিজাবেথ ধূমপানের স্বাদ গ্রহণ করলেন। ইংল্যান্ডে টোব্যাকো জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে স্যর ওয়াল্টারের অবদান অনস্বীকার্য; তাঁর আবার এ নেশায় হাতেখড়ি ফ্রান্সিস ড্রেকের কাছে। পরে যখন দেশদ্রোহিতার অভিযোগে র্যালের শিরশ্ছেদ করা হয়, তখন জেলকুঠরিতে পাওয়া যায় একটি তামাকের বাক্স, যার ওপরে খোদাই করা ছিল তাঁর স্বহস্তে লেখা কথাগুলি, ‘এই অসহনীয় সময়ে আমার একমাত্র সান্ত্বনা।’
১৬৬৫ সালে গোটা ইয়োরোপ জুড়ে যখন প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিল, তখন মনে করা হত ধূমপান করলে মহামারিটির প্রতিরোধ সম্ভব। এর বহুকাল পরে, এই ২০০৩ সালে, এশিয়ায় যখন ‘সার্স’ (সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) রোগটি দেখা দিল, তখন চিন, ফিলিপিন্স, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশের মানুষ বিশ্বাস করত ধূমপান করলে এই রোগের খপ্পর থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। কেবল মধ্যযুগেই নয়, আজও ধূমপানকে নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে নানা কুসংস্কার রয়ে গিয়েছে।
১৬১০ সালে প্রথম টোব্যাকো ভেন্ডিং মেশিনটি তৈরি করা হয় ইংল্যান্ডে; একটি বাক্স, যার নাম ছিল ‘অনার বক্স’, সেখানে একটি গিনি ফেললেই খুলে যেত ছোট আর একটি বাক্সের ঢাকা, সেটির ভেতর থেকে তুলে নিতে হত তামাক। পৃথিবীর প্রাচীনতম টোব্যাকো কোম্পানি ‘তাবাকালেরা’ স্থাপিত হয় স্পেনে, ১৬৩২ সালে। সতেরো ও আঠেরো শতকে দেখা গেল সমাজের সর্বস্তরের মানুষজন এর নেশায় জড়িয়ে পড়েছে।
তামাককে যে যুদ্ধজয়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে, তা দেখিয়েছিলেন আমাদের অতিপরিচিত লর্ড কর্নওয়ালিস। তখন মার্কিন দেশের দায়িত্ব তার কাঁধে; বেয়াড়া মার্কিনিগুলোকে একটু সমঝে দেওয়ার উদ্দেশে সে দেশের বৈদেশিক ঋণ পাওয়ার মাধ্যম তামাকের বিরুদ্ধে ১৭৮০ সালে ভার্জিনিয়ায় শুরু করলেন ‘টোব্যাকো ওয়র’। পরে গৃহযুদ্ধের সময় খোদ মার্কিনিরাই তামাকে শুল্ক বসিয়ে তিন মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করে খাইখরচ মেটানোর জন্য। ফ্রান্স, ইতালি, অস্ট্রিয়া বা ইরান প্রমুখ দেশেও নানা সময়ে টোব্যাকো হয়ে উঠেছিল সংগ্রামের প্রতীক। ১৯৯০ সালে দেশে সিগারেটের ঘাটতি দেখা দেওয়ার ফলে মস্কোর রেড স্কোয়ারে বিক্ষোভ দেখায় রুশ ধূমপায়ীরা। এর ঠিক একশো বছর আগে ১৮৯০ সালে ইরানেও শাহের তামাক-নীতির বিরুদ্ধে ক্রুদ্ধ যাজকসম্প্রদায় ফতোয়া জারি করেন, ধূমপানে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে পারসিকরা বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন, যা পরিচিত টোব্যাকো রেবেলিয়ন বা টোব্যাকো রায়ট নামে।
এটা লক্ষণীয় যে বরাবর রাজারাজড়া বা শাসকশ্রেণির মর্জির ওপরই নির্ভর করেছে ধূমপানকে ঠিক কী চোখে দেখা হবে। তাঁদের বিষনজরে পড়লে কড়া নিষেধাজ্ঞা, সঙ্গে নানা শাস্তি; আবার মহামহিমদের যদি নেকনজরে থাকে তা, তা হলে নানা ভাবে উৎসাহও দেওয়া হত। যেমন, রাশিয়াতে পিটার দ্য গ্রেটের আমলে ধূমপানের ওপর থেকে যাবতীয় নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। তুর্কিতেও চতুর্থ মুরাদের পরে জমানার বদল হতেই নিষেধাজ্ঞাও বেমালুম গায়েব। জাপানে রাজা হিরোহিতো জন্মদিনে তাঁর সমস্ত স্টাফদের সিগারেট উপহার দেওয়ার চল শুরু করেন, যে প্রথাটি অবশ্য পরে রাজা আকিহিতোর আমলে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
১৬০৩ সালে ইংল্যান্ডের চিকিৎসক সম্প্রদায় রাজা প্রথম জেমসের কাছে হত্যে দিয়ে পড়ল। অভিযোগ এই যে, সাধারণ মানুষ প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ধূমপান করছে, ঘোরতর অন্যায়, এমনটা চলতে থাকলে লোকে আর রোগজ্বালা হলে ডাক্তারের কাছে আসবে না, নিজেরাই ইচ্ছেমত ওষুধের বন্দোবস্ত করে নেবে! এর পরের বছর খানিকটা যেন তাদের ডাকে সাড়া দিয়েই জেমস ‘আ কাউন্টারব্লাস্ট টু টোব্যাকো’ নামে গোটা একটি বই-ই লিখে ফেললেন। আর তার সঙ্গে তামাকের রফতানি শুল্ক চার হাজার শতাংশ বাড়িয়ে দিলেন। অবশ্য এখানেই থামলেন না রাজা, টোব্যাকো আমদানির অধিকার একমাত্র রাজার হাতে থাকবে এই ‘রয়্যাল মনোপলি’র নির্দেশ জারি করে জানালেন বাৎসরিক মাত্র চোদ্দো হাজার পাউন্ডের বিনিময়ে সেই অধিকার ক্রয় করা যেতে পারে। ও দিকে রাজারই এক মোসাহেব তামাক ব্যবহারের অপকারিতা সম্বন্ধে কবিতাও লিখে ফেলল: টোব্যাকো দ্যাট আউটল্যান্ডিশ উইড/ইট স্পেন্ডস দ্য ব্রেন অ্যান্ড স্পয়েলস দ্য সিড/ইট ডালস দ্য স্পিরিট, ইট ডিমস দ্য সাইট/ইট রবস আ উওম্যান অব হার রাইটস।
এক রাজার যখন এমন সব কীর্তিকলাপ, তখন অন্য রাজারাও কি পিছিয়ে থাকতে পারেন? স্পেনের রাজা তৃতীয় ফিলিপ ডিক্রি জারি করলেন কেবলমাত্র কিউবা, সান্তো দোমিংগো, ভেনেজুয়েলা ও পুয়ের্তো রিকোয় তামাক চাষ করা যাবে; এ-ও ঘোষণা করলেন যে, বিদেশিদের কাছে তামাক বিক্রির শাস্তি হল মৃত্যুদণ্ড। রাশিয়ায় রোমানফ-রা তামাক নিষিদ্ধ করলেন। পরে জার আলেক্সিস এই নিষেধাজ্ঞা জারি রাখেন, অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী শাস্তিরও তারতম্য ছিল: প্রথম বার হলে বেত্রাঘাত, নাক কেটে দেওয়া বা সাইবেরিয়ায় নির্বাসন; আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে মুণ্ডুখানা একেবারে ঘচাং! আবার জার মাইকেলের আমলে এর শাস্তি হিসেবে ঠোঁট চিরে দেওয়া হত সমাজে আর মুখ দেখানোর জো থাকত না! চিন দেশের রাজাও ঘোষণা করেন ধূমপান করলে মুণ্ডুটি হারাতে হবে। মঙ্গোলিয়াতেও মৃত্যুদণ্ডের আদেশ জারি হল। তুর্কি দেশের সুলতান চতুর্থ মুরাদ ধূমপায়ীদের বিধর্মী ঘোষণা করে মৃত্যুদণ্ডাদেশ জারি করেন; প্রতিদিন প্রায় এমন জনা আঠেরো বিধর্মীর প্রাণও যেত। ১৬২৪-এ খ্রিস্টধর্মের প্রধান ধর্মগুরু পোপ তো ঘোষণাই করে দিলেন কোনও ধর্মযাজক নস্যি নিলে তাকে চার্চ থেকে বহিষ্কার করা হবে, তার মতে নস্যি নিয়ে হাঁচা ছিল যৌনসম্ভোগের সমার্থক। এর একশো বছর পরেই কিন্তু আর এক পোপ ত্রয়োদশ বেনেডিক্ট পূর্ববর্তী পোপেদের জারি করা ‘পেপ্যাল বুল’ প্রত্যাহার তো করে নিলেনই, নিজেও ধূমপান করতে ও নস্যি নিতে শুরু করেন।
ধূমপানের ওপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে অনেক কাণ্ডের সাক্ষী ইতিহাস। কানেক্টিকাটের উপনিবেশে বিজ্ঞপ্তি জারি করে জনসমক্ষে ধূমপান নিষিদ্ধ হয়: নাগরিক সমাজকে সারা দিনে এক বার মাত্র ধূমপানের অনুমতি দেওয়া হয়, তাও অন্যের উপস্থিতিতে নয়।
বিংশ শতকের গোড়ার দিকে নিউ ইয়র্ক শহরের জনৈক বিচারক সন্তানের সামনে ধূমপান করার জন্যে এক মহিলাকে তিরিশ দিনের জন্য হাজতবাসের নির্দেশ দেন। একই বছরে সেখানে গাড়িতে বসে ধূমপান করার জন্যেও এক মহিলাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। মহিলাদের কথা উঠলে এ কথাটাও বলে
ছবি: কারমেন অপেরার
একটি পোস্টারের অংশ
নেওয়া উচিত যে, ঊনবিংশ শতকের শুরুতে প্যারিস শহরের গণিকারা নোৎরদাম দে লোরেৎ গির্জা সংলগ্ন অঞ্চল এই সমস্ত গণিকাদের কর্মভূমি হওয়ার সুবাদে এদের লোরেৎ নামেই ডাকা হত প্রথম সর্বসমক্ষে ধূমপান করতে শুরু করে। প্রসঙ্গত, ফ্রান্সে টোব্যাকোকে কেন্দ্র করে একটা গোটা মিউজিয়ামই বানিয়ে ফেলা হয় ১৯৫০ সালে, ‘ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব টোব্যাকো’!
তামাক নিয়ে লেখা হয়েছে অসংখ্য কবিতা, উপন্যাস। ১৮৪৫-এ প্রকাশিত স্পেনের আন্দালুসিয়ার এক টোব্যাকো ফ্যাক্টরিতে কর্মরতা এক মেয়েকে নিয়ে প্রসপার মেরিমে-র ‘কারমেন’ উপন্যাসটির ওপর আধারিত একটি অপেরাও জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। চার্লস ল্যাম্ব লিখেছিলেন, ‘ফেয়ারওয়েল টু টোব্যাকো’। ইংরেজ স্যর জেমস ব্যারি লেখেন ‘মাই লেডি নিকোটিন’ নামের উপন্যাস। একটি প্রকাশনা সংস্থা ধূমপানের গুণগান গেয়ে প্রকাশ করে ‘স্মোক উইদাউট ফিয়ার’ নামে বইটি।
আমাদের বাংলা ভাষাও খুব একটা পিছিয়ে নেই এ ব্যাপারে, সেখানে তাকে কল্পনা করা হয়েছিল এক পরি রূপে গত শতকের আশির দশকের শেষের দিকে কিশোরকুমার শারদীয়া বেসিক গানের এক অ্যালবামে সিগারেটের মহিমাকীর্তন করে গেয়েছিলেন, ‘সিগারেট নহ তুমি শ্বেতপরী’।
তবে, সিগারেট নিয়ে সবচেয়ে আকর্ষণীয় মন্তব্যটি করে গিয়েছেন ডেভিড স্টার জর্ডান নামে এক বায়োলজিস্ট, ‘যে ছেলে ধূমপান করে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করার কোনও প্রয়োজন নেই; কারণ, তার কোনও ভবিষ্যৎই নেই।’

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.