পুস্তক পরিচয় ১...
গল্পের ভুবনে মিশে থাকে মানুষ
ভারতজোড়া কথনকথা, সম্পাদনা: রামকুমার মুখোপাধ্যায়। মিত্র ও ঘোষ, ৪০০.০০

There nowhere is or had been a people without narratives...
it is simply there, like life itself.

Roland Barthes

প্রত্যেক জনগোষ্ঠীরই নিজস্ব গল্প থাকে। সন্ন্যাসীর কুলপরিচয় আর নদীর উৎসস্থল কেউ জানে না, বলেছিলেন দুর্যোধন। এই সব গল্পেরও জন্ম নির্ণয় করা যায় না, যেন জনগোষ্ঠীটির সঙ্গে সঙ্গেই চলে আসছে গল্পগুলি, মুখ থেকে কানে, কান থেকে মুখে চলতে চলতে হয়তো বা সহস্রাধিক বছরও পার করেছে ঈশপ জাতক পঞ্চতন্ত্রের মতো বহু বহু গল্পধারা। নদীর মতোই শত ধারায় বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে কখনও। যেমন বিভিন্ন ধর্মে ও দেশে দেশে বিস্তৃত হয়ে যাওয়া কোনও এক আদিম বন্যার গল্প, ফল-ফসল চক্রের সঙ্গে জড়িত শীত-বসন্ত ও মৃত্যু-পুনর্জন্মের গল্পমালা। আবার, যাত্রাপথের সাক্ষ্য যেমন নদীজল নিজেই বহন করে আনে, এই প্রাচীন ‘কথা’সমূহের শরীরেও লেগে থাকে সেই লোকসমাজের চিহ্ন, যে একে বহন করে আনে। প্রাচীন সমাজ এই সকল আখ্যানের মধ্যে নিজের ইতিহাস, বিশ্বাস, নৈতিকতা, মূল্যবোধ রীতি-নিয়মের কথা বলে। এদের যদি আমরা লোকগল্প বলি, তা হলে এদের মধ্যে সেই ‘লোক’দের কেবল নয়, তাদের উত্তরাধিকারী, পরিবর্তিত যে সমাজ, তারও শিকড়ের কিছু কিছু বৃত্তান্ত ধরা থাকে।
ভারতবর্ষীয় সমাজের সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব এর বৈচিত্র। এ দেশে কথিত ভাষার সংখ্যা সম্পূর্ণ ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের চাইতে বেশি, ১৪০০। এর মধ্যে মাত্র শতখানেক কিংবা তার চেয়েও কম ভাষারই লিপি আছে। বিশাল এই দেশের দূর-দূর প্রান্তে কত যে ছোট ছোট ভাষাগোষ্ঠী আছে! অধুনা ত্রিপুরাবাসী বংচের-দের মতো কোনও ভাষায় হয়তো মাত্র একশো কুড়িটি পরিবার, আটশো জন মানুষ কথা বলেন। কিংবা অরুণাচলের সিয়াং থেকে ব্রহ্মপুত্র ধরে ধরে অসমের এক অংশ পর্যন্ত চলে আসা মিসিং-রা। এ রকমই লেপচা, সায়েরা, রাংখল আরও কত ছোট ছোট বিরল ভাষাগোষ্ঠী যাঁদের কাছে তাঁদের প্রাচীন সব গল্পকথা রক্ষিত আছে আজও, বিরল প্রজাতির ফসল বীজের মতো, যা এখনও তাঁদের পুষ্টি জোগায়। স্বকীয়তা নিয়ে বেঁচে থাকার পথে নানান প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও, ‘সভ্য হওয়া’ মানে নিজেদের বাসভূমি, সংস্কৃতি, জীবিকা থেকে চ্যুত হওয়ার প্রবল চাপ সত্ত্বেও এ রকম নানান ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী যে এ দেশের প্রান্তে প্রান্তে আজও কী রূপবর্ণময় সংস্কৃতির জীবন যাপন করেন, সে আমরা, ‘আধুনিকতা’র রোলারে সমসত্ত্ব ঢালাই-হয়ে-যাওয়া ছিন্নমূল নগরবাসী পাঠককুল আন্দাজ, এমনকী কল্পনাও করতে পারি না।
পারি না, যতক্ষণ না কেউ যত্ন করে সে রকম গল্পকথার কোনও সংকলন আমাদের হাতে তুলে দেন। এ রকমই ঐশ্বর্যময় একটি বই ভারতজোড়া কথনকথা। উদ্যোগী হয়ে সমস্তটা সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন আজকের বাংলা ভাষার এক বরিষ্ঠ কথাকার রামকুমার চট্টোপাধ্যায়। ভারতীয় কথাভুবনের সঙ্গেও তাঁর পরিচয় গভীর। সেই পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে, নিজে লোকজীবনের কথাকার হওয়ার ও শ্রদ্ধার অনুশীলনে, অন্তত চার বছরের নিরলস পরিশ্রমে রামকুমার এই মহাকার্যটি সমাধা করেছেন। এর আগে ভারতীয় কথনকাহিনির প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বই আমাদের হাতে ছিল প্রায় কুড়ি বছর আগে প্রকাশিত এ কে রামানুজনের ফোকটেলস ফ্রম ইন্ডিয়া। বাইশটি প্রধান ভাষা থেকে সংকলন করে সেই কাহিনিগুলি রামানুজন নিজে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। আরও অন্তত এক-দেড়শো বছর আগে যে-সব মিশনারিরা ‘আদিবাসী’ মানুষদের কাছ থেকে দেখে চমৎকৃত হন, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ প্রচলিত গল্প সংকলন করেছিলেন। কিন্তু সে সব বই সে ভাবে সংরক্ষিত হয়নি। ভারতজোড়া কথনকথা-র ‘ভারতজোড়া’ বিশেষণটি সার্থক এই হিসেবে যে, এতে অন্তত বাহান্নটি ভাষাগোষ্ঠীর বলা গল্প বিধৃত রয়েছে। সম্পাদক জানাচ্ছেন যে, এর প্রায় প্রতিটি গল্পই প্রকৃত কথকের মুখ থেকে শুনে অনুবাদ করা। মোট একষট্টি জন অনুবাদক কাজ করেছেন। কোনও জনগোষ্ঠীই দেশের একটি মাত্র রাজ্যে বসবাস করেন না, কিন্তু প্রায়ই নিজেদের কাহিনিগুলিকে এরা সঙ্গে করে নিয়ে যান। ওই সব ‘কথা-কহানি’ই যেন জীবিকার সন্ধানে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ানো ছড়িয়ে পড়া মানুষদের মাতৃভূমি, তাঁদের শিকড় পরিচয় হয়ে থাকে। বলা গল্প শোনার যাঁদের অভিজ্ঞতা আছে, তাঁরা জানেন এ সব গল্পের প্রাণ হল তার কথনভঙ্গিমা। প্রতি বারই কথক একটু করে ঢুকে পড়েন কথিত গল্পের মধ্যে, তাই একই গল্প নানা ভাষায়, নানা দেশে বারে বারে বদলে যায়। আশপাশের জলহাওয়া গাছ-মাটি ঘরগৃহস্থালি কথকের মধ্য দিয়ে গল্পের গায়ে মেখে যায়। আলোচ্য সংকলনের গল্পগুলোয় সেই অলংকৃত বিস্তার, ভাষা ভেদে একই আখ্যানের সেই ভিন্নতা বোধগম্য ভাবে ধরা আছে।
আর কী পরম আশ্চর্য সেই গল্পের ভুবন! প্রায়ই তার নিজস্ব কোনও বার্তা থাকে। সেই সব বার্তায় নিহিত থাকে কখনও সমাজের মূল্যবোধ, সমাজের নিজস্ব আশা-আকাঙ্ক্ষা, কখনও কৌতুক, কখনও বা ইচ্ছাপূরণ। যেহেতু এ সব গল্প বলা হত হয় অভিজাত/ ক্ষমতাশালীর মনোরঞ্জনের জন্য, কখনও বা কথকের আশপাশের মানুষদের চিত্ত বিনোদনের জন্য। প্রথম শ্রেণির গল্পগুলির মধ্যে গোপাল ভাঁড় তেনালি রাম বীরবল বা নাঈ-দের (রাজস্থানে অভিজাত তনয়দের সহচর নাপিত, যার অন্যতম কাজ হত গল্প বলা) নামে প্রচলিত গল্পে তির্যকতা, এমনকী প্রভুদের সমালোচনা একটি প্রধান অংশ থাকত, যেগুলিকে হয়তো এক রকমের ওরাল কার্টুন বলা যায়। এবং সেই ক্ষমতাশালীদের তা সহ্য করে নিতে হত, প্রায়ই হাসিমুখেই। অন্য ধরনের গল্পের প্রধান কথক ছিলেন মেয়েরা। পুরুষরাও কথকবৃত্তি অবশ্যই করতেন, মূলত তাঁদের অবলম্বন করেই নদীর ধারে কথকতার আসরের ঐতিহ্য বহু কাল ধরে চলে এসেছে। এঁদের উভয় দলেরই কথনে রূপবিস্তার একটি নিজস্ব পরিচয় তৈরি করত। ভারতজোড়া কথনকথা সেই নিজস্ব পরিচয়, যা মুখে বলা গল্পের প্রাণ, তাকে বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরেছে। গল্পের বিষয়বস্তু রাজপুত্র-রাজকন্যার কাহিনি থেকে গরিব তরুণের সুন্দরী স্ত্রী-লোভী রাজাকে মেয়েটির শাস্তিদান (ছেলেরছা, অসমিয়া), লোভী ধনীলোকের টাকার লোভে গাছের ছায়া বিক্রি (গাছের ছায়া, তামিল), ভূতেদের বাড়ির সামনে বসে রুটি গুনতে থাকা কুঁড়েরামকে পেত্নির বরদান (কুঁড়েরাম, নগহী) কত বিষয় নিয়ে কত রকমের যে গল্প! আর কত মত তার কথনভঙ্গি। সে গল্পের ভুবন মানুষকে ছাপিয়ে আরও অনেকখানি। জীবনমৃত্যু, প্রাণী-অপ্রাণী, হিংস্র পশু থেকে দরিদ্র বালকের খেতের ধান খেয়ে ফেলে অনুতপ্ত শাদা টিয়াপাখির দল, কাঁকড়া, শুয়োর, মাকড়সা, ঝর্নার রঙিন মাছ, ব্রতকথার আলপনাটিরও মধ্য দিয়ে সহজ গতায়াত। আর সেই বিস্তৃত ভুবনের সঙ্গে মিলেমিশে থাকা মানুষের অস্তিত্ব। এই গ্রন্থ সত্যিই এক মঞ্জুষা হয়ে উঠল সেই সব চন্দনপাথরের।
তারই সঙ্গে আরও একটি কোষগ্রন্থসুলভ কাজ যোগ করেছেন সম্পাদক। প্রতিটি গল্পের সংলগ্ন ভাষাগোষ্ঠীর একটি করে সংক্ষিপ্ত কিন্তু যথাযথ পরিচিতি দিয়েছেন পরিশিষ্টে। এই কাজটির জন্য গবেষকদের কাছে তো বটেই, সাধারণ পাঠকদের কাছেও দেশের মুখ অনেক স্পষ্ট চেহারা নিয়ে দেখা দেবে। অনুবাদক পরিচিতি তো আছেই।
এই বৃহৎ কলেবর গ্রন্থটি প্রকাশ করে মিত্র ও ঘোষ তাঁদের সুনামে আরও একটি জহরত যোগ করলেন। ছাপা সুন্দর। পৃষ্ঠাসংখ্যা কমাবার জন্য টাইপের সাইজ কমানো বা পাশের সাদা জায়গা ছাড়ায় কার্পণ্য করা হয়নি। হয়তো এতখানি দিয়েছেন বলেই প্রত্যাশা আর একটু বেড়েছে, কভারের মুদ্রণ আর পাঁচশো পৃষ্ঠার ওজনদার বইয়ের বাঁধাই আরেকটু যদি ভাল হত! এ বই তো পাঠকের কাছে বহু দিন সযত্নে থাকবে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.