উত্তর কলকাতা
চাপান-উতোর
আশঙ্কার হরিসা’
গেটের কাছে ঝুলছে পুরনো বৈদ্যুতিক তার। লোহার থাম দিয়ে ধরে রাখা রয়েছে দোতলার মেঝে। কোথাও কাঠার পাটাতন। বিভিন্ন জায়গায় খসে পড়ছে চাঙড়। পুরনো লোহার কড়িকাঠে মরচে পড়ছে। পুরনো বাড়ির এক দিক থেকে অন্য দিকে যাতায়াতের জন্য দোতলায় নির্মাণ করা হয়েছে রাস্তাও। একতলার একাংশ টিন দিয়ে ঘেরা।
এই চারতলা বাড়ির একতলায় বসে হরিদাস সাহার হাট (হরিসা’ হাট)। উত্তর কলকাতার এই জায়গায় রবি, সোম এবং বুধবার এই হাট বসে। আগে বাড়ির মধ্যেই হাট বসত। এখন হাট ছড়িয়ে গিয়েছে বাড়ির বাইরে রাস্তাতেও। এখানে প্রধানত জামাকাপড়ই বিক্রি হয়। জেলা থেকেও ক্রেতা-বিক্রেতা আসেন।
বাড়ির দোতলা এবং তিনতলায় মোট ২১২টি ঘরে থাকেন আবাসিকরা। চারতলায় ছাদ। উত্তর কলকাতার হাতিবাগানের কাছে খন্না সিনেমার পাশেই প্রায় ষাট বছর ধরে ১৫৬ এবং ১৫৬/৪ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোডে একই বাড়ির চত্বরের দু’টি অংশেই রমরম করে চলছে জামাকাপড়ের ব্যবসা। কলকাতা পুরসভা বাড়িটিকে পুরসভার বিল্ডিং দফতরের ১৯৮০-র আইনানুযায়ী ‘বিপজ্জনক’ ঘোষণা করেছে। অভিযোগ, এর পরেও বাড়ি মেরামতি বা নতুন করে নির্মাণে হেলদোল নেই। নথি থেকে জানা যায়, বাড়িটি ৭০ বছরের।
এই হাটে মোট বিক্রেতার সংখ্যা বারোশোর কিছু বেশি। এখানেও সমস্যা আবাসিক এবং ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসন। কলকাতা পুরসভার বিল্ডিং দফতরের মেয়র পারিষদ তথা কলকাতা পুরসভার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “বাড়িটিকে পুরসভা বিপজ্জনক ঘোষণা করেছে। সে কথা বাড়ির মালিক এবং আবাসিকদেরও জানানো হয়েছে। এর পরেও কোনও ব্যবস্থা না নিলে আইনত যা ব্যবস্থা নেওয়ার পুরসভা নেবে।”
কলকাতা পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, এই জমি এবং বাড়ি দেবত্র সম্পত্তি, এখন যা একটি ট্রাস্টের অধীন। ট্রাস্টই বাড়িটির রক্ষণাবেক্ষণ করে। গত বছর অক্টোবরে প্রায় চার বিঘা জমির ওপর গঠিত পুরনো এই বাড়ির একতলার মাঝামাঝি জায়গার একটি কাঠামো হঠাৎ করে ভেঙে পড়ে। ঘটনাটি রাতে হওয়ায় সেখানে কেউ না থাকায় কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি।
বাড়িটির পরিকাঠামোগত সমস্যাটি কী?
পুরসভার বিল্ডিং দফতরের এক আধিকারিকের বক্তব্য, পুরনো এই বাড়ির লোহার স্তম্ভে মরচে ধরে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছে। এগুলির অবস্থা খুবই খারাপ। পুরনো পরিকাঠামোয় তৈরি এই বাড়ি লোহার স্তম্ভের ওপরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। লোহার স্তম্ভগুলি পুরনো হয়ে যাওয়ায় যে কোনও সময়েই বাড়িটির যে কোনও অংশ ভেঙে পড়তে পারে। ওই আধিকারিক আরও জানান, পুরসভার সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে বাড়িটির কিছু অংশে লোহার থামগুলিকে না সারিয়েই পুরনো মেঝের ওপর কংক্রিটের ঢালাই করেছেন আবাসিকরা। ফলে, সে সব অংশের ওজন বেড়ে যাওয়ায় বাড়িটির সামগ্রিক পরিকাঠামো আরও বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় বাড়িটি পুরোটাই ভেঙে ফেলতে হবে। এর পরেই পুরসভা ২০১১-র নভেম্বরে বিল্ডিং দফতরের আইন মোতাবেক ৪১১/১ এবং ৪১১/২ ধারায় নোটিশ দেয়।
এ ছাড়াও, পুরসভা এবং দমকল কর্তৃপক্ষ যৌথ ভাবে বাড়িটিতে যে সমীক্ষা চালিয়েছেন তাতে দেখা গিয়েছে বাড়িটিতে অগ্নি সুরক্ষা বিধিও মানা হয়নি। দমকল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, এ বাড়িতে ব্যবসার জন্য দমকল থেকে কোনও ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি। তথ্য বলছে, ১৯৯৯-এ টিনের চালে আবর্জনা থেকে এক বার আগুন লেগেছিল। স্থানীয় কাউন্সিলর অতীন ঘোষ বলেন, “আবাসিক এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁদের স্বার্থেই বাড়িটি ছেড়ে দিতে বলেছি। পুরসভার ইঞ্জিনিয়ারদের দিয়েও বাড়িটি দেখানো হয়েছে। তাঁরা জানিয়েছেন, পুরো বাড়িটিই ভেঙে দিতে হবে, কোনও বিকল্প নেই।”
ট্রাস্টের পক্ষ থেকে গোপালচন্দ্র সাহা বলেন, “পুরসভার নোটিশ অনুযায়ী আমরা বাড়ির সব আবাসিক এবং ব্যবসায়ীকে বাড়ি খালি করে দিতে বলেছি। ইঞ্জিনিয়ারদের রিপোর্ট মেনে পুরো বাড়ি ভেঙে ফেলতে হবে। না হলে বড় ধরনের বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। আমরা সকলের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি। এমনকী, পরিকাঠামোজনিত কারণেই এ বাড়িতে দমকল কর্তৃপক্ষ ব্যবসা চালানোর ছাড়পত্র দেননি। আলোচনায় কাজ না হলে আদালতের দ্বারস্থ হব।”
হরিদাস সাহা বাজার আবাসিক কল্যাণ সমিতির সম্পাদক মুক্তিরাম গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “আমরা সমস্ত রকম সাহায্য করতে প্রস্তুত। কিন্তু বাড়ি মেরামতির আগে আমাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।” অন্য দিকে, পশ্চিমবঙ্গ তৈয়ারি পোষাকশিল্প ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রঞ্জিত রায় বলেন, “সব ব্যবসায়ীর পুনর্বাসনের জায়গা নেই। তবে ব্যবসায়ীদের স্বার্থেই বাড়ির মেরামতি করেই কাজ করতে হবে। মালিক না পারলে আমাদের হাতে মেরামতির ভার দিন।” স্থানীয় বিধায়ক সাধন পান্ডে বলেন, “বাড়ির মালিককেই সকলের সঙ্গে আলোচনায় বসে স্থায়ী সমাধান বের করতে হবে। বাড়িটি মেরামত করার দায়িত্ব খোদ মালিকেরই। তবে বাড়িটি পুরো ভেঙে মেরামতি করতে হলে আবাসিক এবং ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসন অবশ্যই জরুরি।”

ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.