‘চ্যালেঞ্জ’টা কঠিন, বিলক্ষণ বুঝেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই মতো ‘দাওয়াই’ দেওয়াও শুরু করেছিলেন। রাজ্যবাসীর মনে হয়েছিল, ‘পরিবর্তন’ শুরু হচ্ছে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থেকেই।
এক দিকে হাসপাতালে-হাসপাতালে ‘সারপ্রাইজ ভিজিট’। অন্য দিকে রাজ্য ও জাতীয় স্তরে কাজের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন আমলাকে স্বাস্থ্যসচিব করে নিয়ে আসা।
ক্ষমতায় আসার পর মহাকরণ যাওয়ার পথে আচমকা কোনও সরকারি হাসপাতালে ঢুকে পড়াটা প্রায় ‘রুটিন’ করে নিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর আচমকা ‘ভিজিট’ শুরু হওয়ার পরে তটস্থ হন হাসপাতাল সুপাররা। সময়ে খুলতে থাকে আউটডোর। চিকিৎসকরাও আসা শুরু করেন সকাল-সকাল। অভূতপূর্ব তাঁর ‘সারপ্রাইজ ভিজিটে’র বার্তা ছিল স্পষ্ট কাজ না করে পার পাওয়ার দিন শেষ!
আর পাঁচটা সরকারি ক্ষেত্রের মতো স্বাস্থ্যেও কাজ না করার অভ্যাস দীর্ঘ দিনের মজ্জাগত। সঙ্গে ‘দলতন্ত্র’ তো ছিলই। তাই অতিবৃষ্টিতে কলকাতার ডুবে যাওয়া যেমন ভবিতব্য, তেমনই রাতারাতি রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবাকে জাদুকাঠি ছুঁইয়ে ‘সুস্থ’ করে দেওয়া যাবে, সেই ভাবনাও অলীক। কারণ, কাজ না করার অভ্যাসের সঙ্গে আছে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর জনসংখ্যার বিপুল চাপ। পাশাপাশিই সরকারি হাসপাতালে স্থান-সঙ্কট, চিকিৎসকের অভাব, জনসংখ্যার একটা বড় অংশের বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে ‘সুচিকিৎসা কেনার’ আর্থিক অক্ষমতা। ক্ষমতায় এসে মমতা তাই প্রথমেই শুরু করলেন সমস্যার শিকড়ে পৌঁছে সেটা চিহ্নিত করার কাজ। যার প্রথম উদাহরণ তাঁর হাসপাতাল পরিদর্শন।
যে ‘মানবিক’ দৃষ্টিভঙ্গির অভাব ছিল সরকারি হাসপাতালে, মুখ্যমন্ত্রী তা-ও বদলাতে চেয়েছেন। চিকিৎসকদের বলেছেন, “আগে টাকা নিয়ে পরে চিকিৎসা কেন হবে? জরুরি ভিত্তিতে কোনও রোগী এলে আগে কেন তাঁর কাছে টাকা চাওয়া হবে? কেন চিকিৎসা শুরু করা হবে না?” |
এখনও চিন্তা |
প্রতিশ্রুতি |
কী অবস্থা |
• এক বছরে সাতটি স্বাস্থ্যজেলা |
* হয়েছে দুটি |
• পাঁচ বছরে নতুন ১০টি মেডিক্যাল কলেজ |
* এখনও একটিরও কাজ শুরু হয়নি |
• হেলথ রিক্রুটমেন্ট বোর্ড গঠন |
* বোর্ড এখনও তৈরি হয়নি |
• ৪০টি নবজাতক চিকিৎসা কেন্দ্র |
* এখনও হয়েছে ১৫টি |
• ওয়ার্ডে ডাক্তারদের সন্ধ্যার রাউন্ড |
* অধিকাংশই মানছেন না |
• জনওষধি প্রকল্পে নতুন ওষুধের দোকান |
* চালু দোকানও বন্ধের মুখে |
• প্রেসক্রিপশনে ওষুধের ‘জেনেরিক’ নাম |
* চিকিৎসকদের বড় অংশই মানছেন না |
|
কলকাতা এবং জেলার মেডিক্যাল কলেজগুলি বাদ দিয়ে রাজ্যে মহকুমা ও জেলা হাসপাতালের সংখ্যা ৬০। তাতে ডাক্তার-নার্স-সহ কর্মীর সংখ্যা ২৩ থেকে ২৫ হাজার। অথচ প্রতিদিন এক-একটি হাসপাতালের আউটডোরে আসেন গড়ে পাঁচশোরও বেশি রোগী। অর্থাৎ, মাসে প্রায় ১৫ হাজার! এ ছাড়াও রয়েছে ৩৩টি স্টেট জেনারেল হাসপাতাল। গ্রামীণ হাসপাতাল, ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র মিলিয়ে আরও প্রায় ১২ হাজার। চটজলদি একে শৃঙ্খলায় বাঁধা বাস্তবিকই কঠিন।
স্বাস্থ্য-প্রশাসন পরিচালনার জন্য মুখ্যমন্ত্রী দিল্লি থেকে আনেন প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের অফিসার সঞ্জয় মিত্রকে। এ রাজ্যের প্রশাসনে অতীতেও যাঁর কাজের দক্ষতা প্রশংসিত হয়েছে। তিনিও কখনও আচমকা হাসপাতালের আউটডোরে হাজির হয়ে, কখনও হাজিরা নিয়ে কড়াকড়ির নীতি চালু করে, আবার কখনও বা ‘ভাল কাজে পুরস্কার, কাজ না-করলে শাস্তি’র নীতিতে মমতার প্রশাসনিক কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন। যদিও তাঁর সব পরিকল্পনা এখনও সাফল্য পায়নি। কিন্তু সমস্যাকে চিহ্নিত করার কাজে তিনিও মুখ্যমন্ত্রীর পদাঙ্ক অনুসরণ করছেন।
সরকারি হাসপাতালে কর্মসংস্কৃতি বদলানোর ব্যাপারে নতুন সরকারের ‘সদিচ্ছা’ নিয়ে প্রশ্ন ছিল না। সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে মমতা তার মূলে পৌঁছতে চেয়েছেন বলেই হাসপাতাল পরিদর্শন দিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। যদিও জনতার অত্যুৎসাহের জেরে কোথাও হাসপাতালের দোরগোড়া থেকে ফেরত আসতে হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রীকে, কোথাও আবার ভিড় নিয়ে প্রশ্ন তোলায় মুখ্যমন্ত্রীর ‘কোপে’ পড়েছিলেন হাসপাতাল অধিকর্তা। আগাছা সাফ করতে গেলে হয়তো কিছু গোলাপ গাছও কাটা পড়ে, কিন্তু তাতে আগাছা সাফের মূল কাজটা হয়, এ ক্ষেত্রেও তেমনই ছোট-বড় কিছু সমস্যা দেখা দিলেও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের অচলায়তনে ঝাঁকুনিটা দিতে পেরেছিলেন তিনি।
মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং বারবার বলেন, কোনও ফাইল আটকে রাখা চলবে না। স্বাস্থ্য দফতরের কাজে গতি আনতে এই প্রথম তাঁর হাতে থাকা কোনও দফতরে প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ করেছেন তিনি। কিন্তু স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশ মনে করছেন, তাতে অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ ছাড়া এখনও ফাইল নড়ছে না। প্রতিমন্ত্রীর কাজের পরিধি খুবই সীমিত।
আবার বাম আমলের সরকারি হাসপাতালের ‘রোগী কল্যাণ সমিতি’তে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিকে সামিল করার সিদ্ধান্ত এখনও বদলানো যায়নি। প্রশ্ন উঠেছে, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালন ব্যবস্থাকে রাজনীতির কবলমুক্ত করতে মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে ‘অনিলায়ন’ ভেঙে আইন বদলের পথে গেলেন, সে ভাবেই হাসপাতাল পরিচালনায় রাজনীতির ‘দখল’ দূর করা যাচ্ছে না কেন? এক বছরের সরকার এখনও এ বিষয়ে কোনও দিশা দেখায়নি।
আমরি-তে আগুন লাগার পরে দ্রুত মমতা ঘটনাস্থলে পৌঁছেছিলেন। উদ্ধারকাজে গতি আনা থেকে শুরু করে এসএসকেএমে ঠায় বসে থেকে দ্রুত ময়না-তদন্তের ব্যবস্থা করায় সে দিন তাঁর ভূমিকা প্রশংসিতও হয়েছিল। কিন্তু ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হাসপাতালের ক্ষেত্রে যা যা পদক্ষেপের ঘোষণা হয়েছিল, তা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। মমতার নির্দেশ ছিল, অগ্নিকাণ্ড এড়াতে দ্রুত সরকারি হাসপাতালে উপযুক্ত যন্ত্রপাতি কেনা হবে, জলের ব্যবস্থা হবে। কর্মীদের আগুন নেভানোর প্রশিক্ষণ দিতে হবে ‘ফায়ার ড্রিল’। আমরির পর ৫ মাস কেটে গিয়েছে। সরকারি হাসপাতালে এখনও এ ধরনের কোনও ব্যবস্থাই হয়নি।
শিশুমৃত্যু নিয়ে বারবার বিরোধীরা মমতাকে বিঁধেছে। মমতা জানিয়েছেন, তাঁর সরকারের আমলে শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। নবজাতকের মৃত্যুর হার কমেছে তিন শতাংশ, যাকে তিনি সরকারের ‘সাফল্য’ বলেই বর্ণনা করেছেন বারবার। কিন্তু স্বাস্থ্য দফতর থেকে প্রকাশিত তথ্যেই দেখা যাচ্ছে, যে সময়ে শিশুমৃত্যুর হার কমেছে সেটা ২০১০-১১ সাল। সেই সময় ক্ষমতায় বাম সরকার। তবে, তৃণমূলের আমলে ১৫টি নতুন ‘সিক নিউবর্ন কেয়ার ইউনিট’ এবং মা-শিশুর মৃত্যুর হার কমাতে গড়া টাস্ক ফোর্সকে অবশ্যই ইতিবাচক পদক্ষেপ বলা যায়।
পরিসংখ্যান বলছে, মফস্সলের হাসপাতাল থেকে কলকাতার হাসপাতালে ‘রেফার’-এর সংখ্যা কমেছে। আগে যে জেলা হাসপাতাল থেকে দিনে গড়ে সাত থেকে আটটি শিশুকে রেফার করা হত, এখন সেখানে সংখ্যাটা নেমেছে চার থেকে পাঁচে। যদিও রেফারেল রেজিস্টার চালুর প্রক্রিয়ায় এখনও সাফল্য পায়নি স্বাস্থ্য দফতর।
৭টি স্বাস্থ্যজেলা তৈরির কথা বলা হলেও এক বছরে মাত্র ২টি জেলা গঠন করা গিয়েছে। চিকিৎসকরা যে সময়ে হাসপাতালে পৌঁছন না, তা বুঝেই এসএমএস সার্ভিস চালু করেন তিনি। সাড়ে ন’টার মধ্যে আউটডোর খুলছে কি না, তা স্বাস্থ্য ভবনে জানানোর কথা। কিন্তু সেখানেও সত্যি তথ্য কতটা পেশ করা হচ্ছে এবং তা যাচাইয়ের জন্য যে ব্যবস্থা তা কতটা কার্যকরী, সে নিয়ে দফতরের কর্তাদের মধ্যেই সংশয় দেখা দিয়েছে।
দীর্ঘদিনের অচলায়তনে অভ্যস্ত স্বাস্থ্য দফতরের কর্তা থেকে কর্মীদের একটি বড় অংশ এত দিন মনে করে এসেছেন, কোনওক্রমে রোজকার কাজগুলো করে ফেলতে পারলেই হল। মমতা এসে সেই মানসিকতায় ঘা দিয়েছেন। তাতে নাড়া পড়েছে সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে কোথাও নীরব প্রতিবাদ, কোথাও বা এক ধাপ এগিয়ে অসহযোগিতার চেষ্টাও থেমে নেই। তবু মমতা অনড়। কর্মীদের এই জং ধরা মানসিকতায় কত দ্রুত পরিবর্তন আনতে পারেন, এই মুহূর্তে সেটাই তাঁর কাছে বড় চ্যালেঞ্জ।
|
আলিপুরদুয়ার মহকুমা হাসপাতালে তিন দিনে পাঁচ শিশুর মৃত্যু নিয়ে জলপাইগুড়ি জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক স্বপন সরকার বলেন, “প্রাথমিক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে সংক্রমণ এবং ওজন কম থাকায় ওই শিশুদের মৃতু্য হয়েছে।” |