রবীন্দ্র-সার্ধশতবর্ষের পরে এ বার বিবেকানন্দ ১৫০।
সম্প্রতি রবীন্দ্র প্রযোজনার ঢল দেখেছে বাংলা রঙ্গমঞ্চ। তবে রবীন্দ্রনাথকে চরিত্র করে বা তাঁর জীবনকে কেন্দ্র করে নাটক সেই ভাবে হয়নি। বিবেকানন্দ কিন্তু নিজেই মঞ্চে এসেছেন, আসছেন। ইতিমধ্যেই সমীর মজুমদার এবং চন্দন সেনের পরিচালনায় বিবেকানন্দের দু’দু’টি জীবন-নাট্য মঞ্চস্থ হয়েছে। আজ, শনিবার ফাল্গুনী চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় আসছে ‘বিলে’, যেখানে বিবেকানন্দের ভূমিকায় দেবশংকর হালদার।
রাধাকান্ত দেব (আগন্তুক), আওরঙ্গজেব (শাজাহান ও আওরঙ্গজেব), দেবব্রত বিশ্বাস (রুদ্ধসঙ্গীত)-এর পর এ বার বিবেকানন্দ। চার-চারটি ‘ঐতিহাসিক’ চরিত্রে অভিনয় করার মুখে দেবশংকর। পাশেই আছেন সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় সিরাজদ্দৌল্লা (সিরাজদ্দৌল্লা), ডিরোজিও (আগন্তুক), গিরিশ ঘোষ (বিনোদিনী কথা) এবং শম্ভু মিত্র (শ্রীশম্ভু মিত্র)।
বাংলা নাট্যচর্চার আদি যুগে ঐতিহাসিক-পৌরাণিক কাহিনিরই ছিল জয়জয়কার। জীবনী-নাট্যে তখন শাজাহান, আলমগীর, চন্দ্রগুপ্ত, সিরাজদ্দৌল্লার রাজত্ব। গিরিশ ঘোষ থেকে শিশির ভাদুড়ী, ছবি বিশ্বাস পর্যন্ত রঙ্গমঞ্চে ‘বৃহৎ’ চরিত্রেরই আনাগোনা। নাটক এবং সিনেমায় দেশাত্মবোধক কাহিনির ছড়াছড়ি। |
গ্রুপ থিয়েটারের ঘরানায় কিন্তু উৎপল দত্ত বাদে কেউই নিয়মিত ভাবে ঐতিহাসিক চরিত্রদের মঞ্চে আনেননি। উৎপল দত্তের পরিচালনাতেই মাইকেল থেকে স্তালিন, তিতুমীর থেকে লেনিন, রামমোহন-ডিরোজিও থেকে গাঁধীর মতো চরিত্ররা মঞ্চে এসেছেন। উৎপল দত্ত, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, সমীর মজুমদাররা নিয়মিতই বিভিন্ন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। শম্ভু মিত্র করেছেন গ্যালিলেও, মুদ্রারাক্ষসে চাণক্য। সবিতাব্রত দত্ত মুকুন্দদাসের ভূমিকায়। নান্দীকার করেছিল ‘নটী বিনোদিনী’। তবে খুব নিয়মিত আকারে ঘন ঘনই এমন সব চরিত্রদের নিয়ে নাটক হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না। ‘জুলিয়াস সিজারের শেষ সাত দিন’, ‘গ্যালিলেও’ বা ‘সোক্রাতেস’-এর মতো কিছু প্রযোজনা ছাড়া জীবনী-নাট্যের অভিনয় অনেক দিন পর্যন্ত জনপ্রিয় হতে দেখা যায়নি। জীবনীমূলক পালার বাজার অনেক বেশি তাজা থেকেছে যাত্রামঞ্চে।
নব্বইয়ের মাঝামাঝি (১৯৯৪) এল ‘পিরিতি পরমনিধি’। পাঁচ বছরেরও বেশি অভিনয় হয়েছিল সে নাটক। নব্বইয়ের শেষ দিকে মঞ্চস্থ হল হেলেন কেলারকে নিয়ে নাটক ‘জন্মদিন’ এবং সুপ্রিয় দত্তের চরিত্রায়ণে নর্মান বেথুনকে নিয়ে নাটক ‘গন্তব্য’। ২০০০ সালে গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘সিরাজদ্দৌল্লা’ প্রযোজনা করে রাজ্য তথ্য-সংস্কৃতি দফতর। পাঁচটা শো হয়। কিন্তু জনপ্রিয়তার বহর দেখে নাটকটি নিজের দলের ব্যানারে করলেন স্বপন সেনগুপ্ত। নাম ভূমিকায় সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০০৩-এ মঞ্চস্থ হল ‘শাজাহান’, নাম ভূমিকায় গৌতম হালদার। তার পরে ক্রমে আগন্তুক, আওরঙ্গজেব..। নাটক হয়েছে রামকিংকর, মানদাসুন্দরী, কেয়া চক্রবর্তীকে নিয়েও। “তবে সম্প্রতি বাস্তব চরিত্রদের নিয়ে নাটকে জনপ্রিয়তার যে নতুন ধারা দেখা যাচ্ছে, তার মুখ্য ভূমিকা অবশ্যই ‘রুদ্ধসঙ্গীতে’র”, বললেন দেবশংকর। ‘রুদ্ধসঙ্গীতে’র পথ ধরেই এসেছে ‘শ্রীশম্ভু মিত্র’। আসছে ‘বিলে’-ও। ‘আগন্তুক’ও পুনরুজ্জীবনের ভাবনা রয়েছে, জানালেন সুরজিৎ। অভিনয় চলছে ‘শৃন্বন্তু কমরেডস’, ‘চৈতন্য’, ‘তথাগত’-র।
নতুন করে এই জাতীয় নাটকের জনপ্রিয়তার কারণ? সুরজিতের মতে, বৃহৎ চরিত্রের অভিনয়ের জন্য তারকা-অভিনেতা প্রয়োজন হয়। “গ্রুপ থিয়েটারের মতাদর্শ তারকা নির্মাণের বিরোধী ছিল। এখন গ্রুপ থিয়েটারও একটা বদলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।” চারপাশে তাকিয়ে মানুষ খুব আদর্শ-স্থানীয় চরিত্র দেখতেও পাচ্ছেন না। “ফলে ঐতিহাসিক চরিত্রের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে”, বললেন ফাল্গুনী। ‘বিলে’কে অবশ্য ঠিক জীবনী-নাট্য বলতে চান না তিনি। তাঁর মতে, উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়ের লেখা এই নাটককে বিবেকানন্দের জীবনের সারাৎসার বলা যেতে পারে। সেখানে বিবেকানন্দ আর বিলের মধ্যে কথোপকথন চলতে থাকে। ফাল্গুনী এবং দেবশংকর দু’জনেরই বক্তব্য, বিবেকানন্দকে যতটা সম্ভব মানবিক ভাবে তুলে ধরাই তাঁদের লক্ষ্য। মানুষ বিবেকানন্দের ভিতরকার দ্বন্দ্ব, ক্ষোভ, রাগ, ভুলভ্রান্তি, নিবেদিতার প্রতি অধিকারবোধের দিকগুলোও থাকছে। ‘মানুষের মনে বিবেকানন্দের যে ছবিটা রয়েছে, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেও কী করে তাঁকে আরও রক্তমাংসের করে তোলা যায়’, সেটাই এ বার দেবশংকরের চ্যালেঞ্জ।
রক্তমাংসের দেবব্রত থেকে বিবেকানন্দ, পরিক্রমাটা কেমন লাগছে? “ভয়ও করছে, রোমাঞ্চও হচ্ছে,” বললেন দেবশংকর। |