দুর্যোগের আশঙ্কা সত্ত্বেও আগামী জুলাই মাসের মধ্যেই ‘গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ (জিটিএ) ভোট করার প্রস্তুতি নিচ্ছে রাজ্য সরকার। নির্বাচনের প্রয়োজনে তৈরি রাখা হবে দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রশিক্ষিত একাধিক দলও (ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট টিম)। রাজ্য সরকারের তরফে এই নির্বাচন নিয়ে যেমন ‘তৎপরতা’ রয়েছে, তেমনই দেরি করতে চাইছেন না গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা নেতৃত্বও। মোর্চা অন্দরের খবর, দলের নেতাদের একটা বড় অংশ শীর্ষ নেতৃত্বকে জানিয়েছেন, জিটিএ নির্বাচনের আগে জিটিএ-তে তরাই-ডুয়ার্সের এলাকার অন্তর্ভুক্তির দাবিকে ‘আপাত-গৌণ’ রাখতে আপত্তি নেই তাঁদের। মোর্চার প্রচার সচিব হরকা বাহাদুর ছেত্রী বলেন, “জিটিএ-ভোট যে কোনও সময়েই হতে পারে। আমরা প্রস্তুত।”
জিটিএ-চুক্তির পরে প্রায় বছর ঘুরতে চললেও ভোট না হওয়ায় উন্নয়নের কাজ করতে সমস্যায় পড়ছে প্রশাসন। তার উপরে মোর্চা ও তাদের বিরোধী শিবিরের লাগাতার আন্দোলন-বন্ধ কর্মসূচির ‘ক্ষতিকর’ প্রভাব পড়ছে পর্যটন-সহ একাধিক শিল্পে। প্রশাসন সূত্রের খবর, সেই প্রেক্ষিতেই ভরা বর্ষায় পাহাড়ে জিটিএ-র ভোট প্রক্রিয়া মেটাতে চাওয়া হচ্ছে। ফি বছর জুনের মাঝামাঝি থেকে জুলাই জুড়ে বৃষ্টির পরে পাহাড়ে ধস নেমে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়। সেই সম্ভাবনা মাথায় রেখে জুন মাস থেকেই দার্জিলিঙের তিন মহকুমায় দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রশিক্ষিত একাধিক দল রাখা হবে। সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলে সীমান্ত সড়ক বাহিনীকেও কাজে লাগানোর কথা ভাবা হয়েছে। এমনকী, কয়েকটি হেলিকপ্টারও ভাড়া নেওয়ার ভাবনা চলছে। দার্জিলিঙের জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন বলেন, “এমনিতেই জুন-জুলাইয়ে ধস সরাতে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট টিম তৈরি রাখা হয়। ভোট প্রক্রিয়া শুরু হলে ধসের কারণে মিটিং-মিছিলের যাতে বিঘ্ন না ঘটে সে জন্য বাড়তি ‘টিম’ রাখতেই হবে। না হলে সকলেরই অসুবিধা হবে।” |
জুলাইয়ের জট |
২০০৭: কার্শিয়াঙের সেন্ট মেরি’জ-এ ধস হিলকার্ট রোডে
২০০৮: কালিম্পঙের পথে রাম্ভি, লিকুভিরে ধস
২০০৯: রাম্ভি, কালিঝোরায় ধস। ভাঙল ২০টি বাড়ি। বিচ্ছিন্ন কালিম্পং
২০১০: লাইনে ধস। দীর্ঘদিন বন্ধ টয় ট্রেন
২০১১: ধস দার্জিলিং, লিকুভির, কার্শিয়াংয়ে |
|
বস্তুত, জিটিএ-নির্বাচন না হওয়ায় তাঁদেরও ‘অসুবিধা’ হচ্ছে বলে ঘনিষ্ঠ মহলে স্বীকার করছেন কিছু মোর্চা নেতা। কারণ, জিটিএ গঠনের পরে সাধারণ পাহাড়বাসী স্বশাসনের মাধ্যমে যে বাড়তি সুবিধা পাবেন বলে আশা করেছেন, তা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় নিজেদের এলাকাতেই প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে মোর্চার প্রথম সারির অনেক নেতাকে। যে কোনও দুর্ঘটনা-দুর্যোগের পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেবের বারবার পাহাড়ে ছুটে যাওয়াটা সাধারণ পাহাড়বাসীর প্রত্যাশা বাড়িয়ে দিয়েছে। তা ছাড়া, মোর্চার অন্দরের খবর, পাহাড়ে উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের কাজ জোরদার করতে মুখ্যমন্ত্রী বারেবারেই যে আর্জি জানাচ্ছেন, তারও ‘প্রভাব’ রয়েছে পাহাড়বাসীর একটা বড় অংশের উপরে। তরাই-ডুয়ার্সের কিছু এলাকার দাবি আদায়ের জন্য রাজ্যের সঙ্গে সংঘাতে যাওয়ার অবস্থান নিয়ে দলের নিচুতলার কর্মী-সমর্থকদের ক্ষোভও বাড়ছে বলে আঁচ করেছেন মোর্চা নেতৃত্ব।
গ্রীষ্মের পর্যটন মরসুমে তরাই-ডুয়ার্স নিয়ে লাগাতার আন্দোলনের কথা বলেও, পরে সুর নরম করে মোর্চা। পাহাড়বাসীর ‘উষ্মা উপলব্ধি’ করেই মোর্চার ওই অবস্থান পরিবর্তন, বলে অভিমত রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের। ওই ঘটনার পরেই আমজনতার কাছে নিজেদের ‘উন্নয়নকামী’ ভাবমূর্তি তুলে ধরতে পাহাড়ে মেডিক্যাল কলেজ, আইটিআই, পলিটেকনিক, আইটি হাব তৈরির জন্য মহাকরণে তদ্বিরে যান মোর্চা নেতারা। সরকারি সূত্রের খবর, তখনই রাজ্যের তরফে মোর্চাকে জানিয়ে দেওয়া হয়, পূর্ব ঘোষণা মতো জুনের প্রথম সপ্তাহেই জিটিএ-তে তরাই-ডুয়ার্সের অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শ্যামল সেনের নেতৃত্বাধীন উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির রিপোর্ট জমা পড়বে। সেই রিপোর্ট সব পক্ষকে মানতে হবে। তবে কারও আপত্তি থাকলে বিবেচনার রাস্তাও থাকবে।
যদিও দলের একাংশ এবং পাহাড়ের বাসিন্দাদের একটা বড় অংশের ‘মনোভাব’ মাথায় রেখে তাঁরা যে তরাই-ডুয়ার্সের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি নিয়ে জিটিএ-ভোটের আগে ‘বিশেষ চাপাচাপি’ করতে চান না, ঘনিষ্ঠ মহলে সে কথা অস্বীকার করছেন না মোর্চার কিছু শীর্ষ নেতা। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের কথায়, “ জিটিএ-তে তরাই-ডুয়ার্সের এলাকা অন্তর্ভুক্তির দাবি আমাদের আছে। থাকবে। তবে অগ্রাধিকারের তালিকায় রয়েছে জিটিএ গঠন। ভোটটা তো সে জন্যই দরকার।” |