শনিবারের ইডেন চেয়েছিল ঐতিহাসিক শততম সেঞ্চুরির সম্মানে একটা মনে রাখার মতো দিন। ছিল ইতিহাস-ছোঁয়া স্বপ্নের নায়ককে কাছ থেকে দেখার প্রত্যাশা। তার বদলে প্রাপ্তি? সচিনের মুখে চারটে বাংলা শব্দ। “কেমন আছো?...ভাল আছি!” আর শুরু হতে না হতেই শেষ হয়ে যাওয়া সংবর্ধনা।
শনিবারের ইডেন চেয়েছিল সচিন তেন্ডুলকরের ব্যাট থেকে একটা মন ভাল করে দেওয়া ইনিংস। তার বদলে কপালে জুটল স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা। ম্যাচ শুরুর দশ মিনিটের মধ্যে ড্রেসিংরুমে ফিরে গেলেন সচিন। এবং ফিরে গেলেন ইডেন জুড়ে একটা প্রশ্ন তুলে দিয়ে। সচিন কি আদৌ আউট ছিলেন?
দিনের তিন নম্বর ওভারের প্রথম বলে সচিনকে স্টাম্পড্ করে উইকেটকিপার মনবিন্দর বিসলা এবং বোলার সাকিব আল হাসানের জোড়া আবেদনে যখন টিভি আম্পায়ারের দিকে সিদ্ধান্ত ঠেলে দিয়েছেন ফিল্ড আম্পায়ার, ইডেন জুড়ে তখন একটাই আকুতি। সচিন যেন আউট ঘোষিত না হন জায়ান্ট স্ক্রিনে। যাঁর ব্যাটের ফুলঝুরি দেখতে মাঠে আসা, তিনি কী করে এত তাড়াতাড়ি ফিরে যাবেন ডাগআউটে? ‘বেনিফিট অব ডাউট’ বলেও তো একটা ব্যাপার আছে! দেখা গেল টিভি আম্পায়ারের মনে কোনও ‘ডাউট’-ই ছিল না। জায়ান্ট স্ক্রিনে জ্বলজ্বলে লাল ‘আউট’ শব্দটা ভেসে উঠতে লাগল মিনিট দুয়েক। |
আম্পায়ারের মনে কোনও সন্দেহ না থাকতে পারে। ইডেন নিঃসন্দেহ হতে পারছে কই? ম্যাচ শেষে হার্শেল গিবস খুঁতখুঁতে গলায় বলে গেলেন, “আমি ভেবেছিলাম সচিন বেনিফিট অব ডাউট পাবে। ডাগআউটে যারা বসেছিল, তাদেরও অনেকের একই কথা মনে হয়েছে। যাক গে, ক্রিকেটে তো এ রকম হয়েই থাকে।” গিব্স ওই পুনশ্চটা জুড়লেও প্রাক্তন উইকেটকিপার সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় সোজাসুজি বলে দিচ্ছেন, “হান্ড্রেড পার্সেন্ট বেনিফিট অব ডাউট পাওয়া উচিত ছিল সচিনের। ওর পা হাওয়ায় ছিল এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের জন্য। টিভি আম্পায়ার আরও বেশি সময় নিয়ে রিপ্লেটা দেখতে পারতেন।” প্রাক্তন জাতীয় আম্পায়ার সুব্রত পোড়েল আবার বলছেন, “বেনিফিট অব ডাউট টিভি আম্পায়ার কখনও দিতে পারেন না। কারণ তাঁর কাছে সব রকম ক্যামেরা, যন্ত্রপাতি থাকে। আর আমি নিজে সচিনের আউটটা দেখেছি। বেল যখন পড়ে, সচিনের পা তখন হাওয়ায় ছিল।”
ইডেনের আশাভঙ্গের উদাহরণ একমাত্র এটাই নয়। সচিনের সংবর্ধনা ঘিরেও তো খুচরো মনখারাপ নিয়ে মাঠ ছাড়লেন তাঁর ভক্তেরা। অথচ আয়োজনের কোনও ত্রুটি ছিল না। রাতারাতি শহর জুড়ে বসে গিয়েছিল লিটল মাস্টারের কাটআউট। ইডেনের প্রতিটা সিটে রাখা ছিল বিশেষ পোস্টার‘সিএবি স্যালুট্স সচিন’। ভাবা হয়েছিল মহানায়কের সংবর্ধনায় থাকবেন আর এক মহানায়কও সুনীল গাওস্কর। মজুত ছিল গল্ফ কার্ট। জিপ। দর্শকদের দিকে সচিনের ছুড়ে দেওয়ার জন্য একশোটা বল সব। কিন্তু গল্ফ কার্টে চড়ে সচিন গোটা ইডেন চক্কর মারছেন, সেই দৃশ্যটা ভক্তদের কল্পনা থেকে আর বাস্তবে রূপান্তরিত হল না। স্রেফ সময়ের অভাবে। গাওস্করের বদলে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করলেন সমীর কোচার। |
নির্ঘণ্ট অনুযায়ী, সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শুরুর কথা ছিল ঠিক দুপুর তিনটেয়। আইপিএলের নিয়ম মেনে কাঁটায় কাঁটায় তিনটে পঁচিশে মাঠ ছেড়ে দিতে হত আম্পায়ারদের। কারণ, সাড়ে তিনটেয় টসের সময় পিছনো সম্ভব নয়। সেখানে অনুষ্ঠান শুরু হতে হতেই বেজে গেল প্রায় সওয়া তিনটে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মাঠে ঢুকতে না ঢুকতেই অনুষ্ঠান শুরু করলে কী হবে, শেষ পর্যন্ত ‘খলনায়ক’ সেই সময়ই। সচিনকে উত্তরীয় পরিয়ে দেওয়া, সোনার ব্যাট, একশো গিনি, সনাতন দিন্দার আঁকা ছবি, রাজভোগ, বই উপহারসবই হল একে একে। কিন্তু ভিড়ে ঠাসা ইডেন ভাল করে ব্যাপারটা বুঝে উঠতে না উঠতেই অনুষ্ঠানে যবনিকা পতন! তড়িঘড়ি অনুষ্ঠান শেষ করে ইডেন থেকে বেরিয়ে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী। সচিন ফিরে গেলেন তাঁর মুম্বই ইন্ডিয়ান্স সতীর্থদের সঙ্গে ম্যাচের আগে গা ঘামাতে। মাঠে পড়ে থাকল চার বালতি ভর্তি বল। সচিনের ব্যাটের ছোঁয়া পাওয়া হল না সেগুলোর। মে মাসের চড়চড়ে রোদে মাঠ ভরানো দর্শকদেরও আর পাওয়া হল না আজীবন সাজিয়ে রেখে দেওয়ার মতো একটা স্মারক।
তার চেয়েও যেটা বেশি হতাশার, ইডেনের বেশির ভাগ দর্শকই কাছ থেকে দেখতে পেলেন না সচিনকে। ক্যামেরাবন্দি করে রাখা হল না সেই অসাধারণ মুহূর্ত গোটা মাঠ ঘুরছেন সচিন, দর্শকদের দিকে হাত নাড়ছেন, হাসিমুখে ফিরিয়ে দিচ্ছেন তাঁর দিকে আছড়ে পড়া ভালবাসা এবং সম্মান।
দিনটা সচিনের ছিল না। তাঁর ভক্তদেরও না।
|