|
|
|
|
|
|
|
ব্যাগ গুছিয়ে... |
বনের রাজার দরবারে
দূরে জঙ্গলের অন্ধকারে একজোড়া আলো জ্বলছে, চার সেলের আর্মি টর্চটা
সেই
আঁধারকে বিঁধতেই একটা বুনো শুয়োর দৌড়ে পালাল। হঠাৎ পাখিদের
ডানা ঝাপটানোর শব্দ আর ‘মাংকি কল’। ঘুরে এলেন অঞ্জন সরকার |
|
রাতের শেষ ঝিঁঝি পোকাটা ডাকতে ডাকতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, ব্রেন ফিভার পাখিটাও। নীল আকাশের চাঁদোয়ায় তারারা চুমকি হয়ে হাসছে। আমরা পাঁচ বন্ধু তখন লজের বারান্দায় বসে। কিছুক্ষণ আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। সেই গরমটা আর নেই। শুকনো একটা শালপাতা গা ঘষতে ঘষতে নেমে এল মাটিতে, তার নেমে আসার শব্দটা অনেকটা সময় ধরে কানে লেগে রইল। দূরে জঙ্গলের অন্ধকারে একজোড়া আলো জ্বলছে, চার সেলের আর্মি টর্চটা সেই আঁধারকে বিঁধতেই একটা বুনো শুয়োর দৌড়ে পালাল। হঠাৎ পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ আর ‘মাংকি কল’...আমাদের পাঁচ জোড়া কান সজাগ হল...তার পরে হঠাৎই আবার নিস্তব্ধতা ভর করল জঙ্গলে। প্রায় তিন থেকে চার মিনিট পরে সেই শুনতে-চাওয়া ডাকটা কানে এল....ডাকতে ডাকতে দূরে সরে যাচ্ছে বাঘটা!
|
|
পরদিন ভোর পাঁচটা। ব্রেকফাস্ট শেষ করে আমরা তৈরি। আগে থেকে বলে রাখা ‘জিপসি’ হাজির দরজায়। জঙ্গল-সাফারির অলিখিত নিয়ম বলছেজঙ্গলের রাস্তায় অন্য কোনও গাড়ির চাকা দাগ রেখে যাওয়ার আগেই যেন তোমার গাড়ি সে পথে যায়, তবেই জঙ্গলের বাসিন্দাদের দেখার সম্ভাবনা বেশি থাকে। সে নিয়ম মেনেই আমরা হাজির বনের দোরগোড়ায়। নিয়মকানুনের পালা শেষ হতে গাড়ি ছাড়ল। ধুলো উড়ছে...বেশ কিছুটা ফাঁকা, শুকনো ঘাসজমির শেষে ঢুকলাম বড় বড় গাছের ক্যানোপি ছাওয়া পথে। সকালের আলো মাঝে মাঝে সরাচ্ছে পাতার আড়াল, সে আলো আমাদের মুখে, গায়ে। এখনও যেন গত রাতের একটা আমেজ জড়িয়ে আছে বনের পরতে পরতে। বেশ একটা আদুরে ভাব। কেউ কোনও কথা বলছি না, শুধু জিপসির চলার একটা হালকা যান্ত্রিক শব্দ। নিস্তব্ধতাকে ভালবাসতে শিখছি।
হঠাৎই গাইডের ফিসফিসানি...তার দৃষ্টি অনুসরণ করে একটা গাছের মাথার দিকে তাকাতেই দেখি, একটা ‘ইজিপসিয়ান ভালচার’! ক্যামেরার মেমরি কার্ডে বন্দি হল পাখিটা! আবারও গাড়ি এগোল। দারুণ উত্তেজনায় ভরপুর মন, চোখ ক্রমাগত স্ক্যান করে চলেছে জঙ্গলের প্রতিটি কোনা, একটা পাতার খসে পড়াও যেন হারিয়ে না যায়। ক্যামেরা ধরে রাখছে বনের প্রতিটি রং, প্রতিটা অবস্থানের পরিবর্তন। তার পরে হঠাৎ যেন হৃৎপিণ্ডটা একেবারে থমকে গেল! একজোড়া হলুদ চোখ নিয়ে একটা হুতোম প্যাঁচা বসে আছে পাতার আড়ালে। কেন যে লোকে বলে প্যাঁচার মতো দেখতে!
এগিয়ে চলি। গরম বাড়ছে। বছরের এই সময়টায় এখানকার তাপমাত্রা ৪০-৪২ ডিগ্রির মধ্যেই ওঠানামা করে। এসে পড়েছি একটা ‘বহেরা’র (ছোট জলাশয়) সামনে। গাড়ি থামে কিছুটা সময়, যদি কিছু নজরে আসে! বেশ কিছুটা সময় অপেক্ষার পরে দুটো চিতল হরিণ ধীর পায়ে খুব সন্ত্রস্ত ভাবে এসে জলে মুখ ছোঁয়াল। তিরিশ সেকেন্ড...তার পরেই চকিতে ঘাড় তুলে, কান খাড়া করে কিছু শোনার চেষ্টা...আর পরক্ষণেই ছুটে জঙ্গলের ভিতর হারিয়ে যাওয়া। এর ঠিক তিন মিনিটের মধ্যেই আমাদের জিপসিতে ওয়াকিটকির মাধ্যমে খবর এলবাঘ দেখা গেছে! ওঃ! জিপ ছুটল একটু দ্রুত, মন তারও আগে আগে। বনের মাঝে এক জায়গায় জিপ থামল। আরও দু’তিনটে জিপ সেখানে। একটা হাতি দাঁড়িয়ে, সওয়ার হব আমরা। গজেন্দ্রগমনে চললাম বাঘদর্শনে।
বড় বড় ঘাসঝোপ সরিয়ে হাতি যেখানে নিয়ে গেল সেখানে দেখি, আরও দুটি হাতি দাঁড়িয়ে একটা বড় গাছকে ঘিরে। আমাদের মাহুতের ইশারায় হাতি এগোল সে দিকে। সামনে পৌঁছেই দেখি, যার জন্য আমাদের প্রতীক্ষা সেই ‘বনের রাজা’ তার হলুদ-কালোয় ডোরাকাটা শরীরটা নিয়ে রোদ পোহাচ্ছে অলস ভাবে! আলো পিছলে যাচ্ছে লোমের উপর দিয়ে। আমাদের সব ক’টা ক্যামেরা সচল। ফটো শু্যট শেষ হওয়ার পরেও আমি অনেক ক্ষণ তাকিয়ে রইলাম তার চোখের দিকে। কী অসামান্য পূর্ণ দৃষ্টি তার কাজল-কালো পিঙ্গল চোখের তারায়! এতটুকু হিংস্রতা নেই, মর্মস্পর্শী চাহনি! কী যেন বলতে চায়।
গাড়ি এ বার অভয়ারণ্যের কেন্দ্রে। একটা ছোট্ট পাহাড়, নীচটা ঘিরে আছে বড় বড় শাল আর নানা পর্ণমোচী গাছ। পাহাড়ের সামনের ঘাসজমিতে বেশ কিছু শকুন একটা চিতল হরিণের শরীর ঘিরে। এর পরে এক পুরনো দুর্গ। কথিত আছে, এ দুর্গ তৈরি হয়েছিল প্রায় ২০০০ বছর আগে। জঙ্গলের মাঝে ক্ষয়ে-যাওয়া দুর্গম পাহাড়ে ঘেরা এই দুর্গ এক আলাদা মাত্রা যোগ করেছে।
গরম, শুকনো হাওয়া বইছে। আমাদের গাড়ি এ বার ফেরার পথে। ফিরতি পথে দেখা হল সার্পেন্ট ঈগল, মাছরাঙা, সম্বর, গাউর বা ভারতীয় বাইসন আর দারুণ সুন্দর একটা র্যাট স্নেকের সঙ্গে। দিনের শেষে আদ্যোপান্ত ধুলো মেখে যখন লজের বারান্দায় চেয়ারে গা এলিয়ে দিলাম, তখন বান্ধবগড়ের জঙ্গল চুঁইয়ে সূর্য মরমিয়া। টিয়াপাখির একটা দল হইচই করতে করতে জঙ্গলে ফিরে গেল। লজের পিছনের নালাটায় বয়ে যাওয়া জলে গ্রামের মোষগুলো নেমে গা ভেজাচ্ছে। অন্ধকার জড়িয়ে ধরতে চাইছে বান্ধবগড়কে। আমাদের কটেজের সামনের বড় শালগাছটার গোড়ায় জমে থাকা শুকনো পাতার দলে একটা সবুজ পাতা নজরে এল।
যখনই যান না কেন, বান্ধবগড়ের জঙ্গল বড় মায়াবী। তার গায়ে জড়ানো অন্ধকার, নানা অশরীরী শব্দ, তার আড়ালে লুকোনো সূর্য...আদরে গলতে থাকা রুপোলি চাঁদ...পাখির ডাক...বুনো গন্ধ...সব নিয়ে যেন একটা গান। যত শুনবেন ততই সে আপনার মনকে নিজের করে নেবে। আপনিও হারিয়ে যেতে থাকবেন।
জঙ্গল তার ভালবাসা আজ আমাকে উজাড় করে দিয়েছে। সেই ভালবাসাকে মনের এক কোণে সযত্ন রাখতে রাখতে যখন চোখ দুটো বুজে এল, তখন আবারও সেই পিঙ্গল চোখ দুটো আমার সামনে! সুজানা ভেগার সেই বহু-পরিচিত গানটা তখন আমায় ঘুম পাড়াচ্ছে...‘লুক মি ইন মাই আইজ...ইন মাই আইজ’!
|
কী ভাবে যাবেন |
সরকারি বা বেসরকারি বাসে অথবা ভাড়া করা গাড়ি বা ট্যাক্সিতে
জব্বলপুর, কাটনি, সাতনা, উমরিয়া থেকে বান্ধবগড় (টালা)। |
কোথায় থাকবেন |
|
সরকারি ফরেস্ট লজ, ফরেস্ট হাউস, পি ডবলিউ ডি রেস্ট হাউস এবং বেসরকারি কিছু হোটেল। |
|
কখন যাবেন |
সব চেয়ে ভাল সময় নভেম্বর থেকে জুন। জুলাইয়ের প্রথম থেকে অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত জঙ্গল বন্ধ থাকে। |
মনে রাখবেন |
জোরে কথা বলবেন না, গাড়ি থেকে নামবেন না, পারফিউম ব্যবহার করবেন না, ধূমপানও নয়। |
|
|
|
|
|
|
|