অবস্থান বদলের আশায় শিল্পমহল
রাজধর্ম পালনের ইঙ্গিত মমতার তবে ‘পরিবর্তন’ এখনও প্রতীকীই
ক বিপুল জয়ের এক বছরের মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝতে পারছেন, ‘পরিবর্তন’ কত কঠিন! বিশেষ করে সেটা যদি এমন এক বিশ্বাসের পরিবর্তন হয়, যা নির্বাচনে রাজনৈতিক ফায়দা দিয়েছে।
তৃণমূল নেত্রী বুঝতে পারছেন, পরিবর্তন তখনই সম্ভব হবে, যখন নিজেদের বিরোধী রাজনৈতিক চরিত্র পাল্টে ফেলে প্রশাসনিক চরিত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। কাজটা সহজ নয়। কিন্তু ঘটনা হল, কংগ্রেস হোক বা বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরে মানুষের প্রকৃত উন্নয়নের স্বার্থে অনেক দলকেই তাদের নির্বাচনী ইস্তাহারে বহু ঘোষিত অবস্থানে আমূল বদল আনতে হয়েছে। ’৭৭ সালের পর সিপিএমেও কম পরিবর্তন হয়নি। কারণ, কোনও বিশ্বাসই মানুষের চেয়ে বড় নয়।
ঠিক এই রকম এক প্রেক্ষাপটে গত কাল বিশিষ্ট শিল্পপতি বসন্তকুমার বিড়লার দাম্পত্য জীবনের ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে তাঁদের বাড়িতে গিয়েছিলেন মমতা। যে মমতা সাধারণত কোনও ব্যবসায়ীর বাড়িতেই যান না, সেই তিনি এই মারোয়াড়ি পরিবারের সঙ্গে প্রায় আধ ঘণ্টা সময় কাটানোর মধ্যে দিয়ে যে শিল্পায়নের আবহ তৈরির লক্ষ্যে ইতিবাচক বার্তা দিয়েছেন, সেটা বুঝতে ভুল হয়নি শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়েরও। গত কাল সন্ধ্যায় বিড়লা বাড়িতে বসন্ত বিড়লা ও তাঁর স্ত্রী সরলা বিড়লার পাশাপাশি হাজির ছিলেন কন্যা মঞ্জুশ্রী খৈতান এবং তাঁদের নাতি কুমারমঙ্গলম বিড়লা ও তাঁর স্ত্রী নিরজা।
শনিবার বিড়লা-দম্পতির সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী। নিজস্ব চিত্র
আমরি-কাণ্ডের পর গোটা শহর জুড়ে হিন্দিভাষী সমাজে বিশেষত মারোয়াড়ি মহলে নিরাপত্তার অভাববোধ তৈরি হয়েছিল। জনসংখ্যার নিরিখে কলকাতা শহরের বাসিন্দাদের অর্ধেকই অবাঙালি। আমরি-কাণ্ডের পর তাঁদের অধিকাংশেরই ধারণা হয়েছিল যে, শুধু বেছে বেছে মারোয়াড়িদেরই গ্রেফতার করা হয়েছে। পরে চাপের মুখে অন্য সম্প্রদায়ের কেউ কেউ গ্রেফতার হলেও দ্রুত জামিন পেয়ে গিয়েছেন তাঁরা। আদালতে এই মামলার শুনানির প্রথম দিন আমরি কর্তাদের হয়ে যাতে কোনও আইনজীবী না-দাঁড়ান, সে জন্য শাসক দলের সমর্থকেরা হুমকি দিয়েছিল বলেও অভিযোগ। এ শহরের মারোয়াড়ি সমাজের বক্তব্য, জরুরি অবস্থায় সময় সঞ্জয় গাঁধীও এমনটা করেননি। এমনকী, আমরির অন্যতম অংশীদার হওয়ার কারণে ইমামি গোষ্ঠীকেও রাজ্য সরকার বিরূপ চোখে দেখেছে বলে তাঁদের অভিমত। ফলে সব মিলিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল কলকাতার অবাঙালি সমাজে।
এহেন পরিস্থিতিতে যখন শোনা যাচ্ছে যে আমরি কর্তৃপক্ষ কলকাতা থেকে তাঁদের হাসপাতাল গুটিয়ে নিয়ে মুম্বই চলে যাচ্ছেন, ইমামির মতো প্রতিষ্ঠান তাদের আড়াই হাজার কোটির লগ্নি পরিকল্পনা বাতিল করে কলকাতা থেকে পাততাড়ি গোটাতে চাইছে, ঠিক তখন মমতার এই উদ্যোগ শহরের হিন্দিভাষীদের নিরাপত্তার অভাববোধ কাটানোর জোরালো প্রচেষ্টা। কুমারমঙ্গলম বিড়লা দেড়শো কোটি টাকার বিনিয়োগ করে কলকাতায় একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চান। সে কথা শুনে মমতা তাঁকে জমি দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। মমতা বলেন, “আমরি অগ্নিকাণ্ড একটি পৃথক ঘটনা। তার সঙ্গে শিল্প বিরোধিতা বা কোনও একটি সম্প্রদায়কে নিশানা করা এ সব কুৎসা, অপপ্রচার। আমি সবাইকে নিয়ে চলতে চাই। এবং সবাই মিলে রাজ্যকে বাঁচাতে হবে।”
অসুখ
হিন্দিভাষী শিল্প মহলের আতঙ্ক
রাজ্য ছেড়ে শিল্পের বিদায়
জমি জটে নয়া শিল্প অনিশ্চিত
এসইজেডে আপত্তি
বাড়ছে না কাজের সুযোগ
দাওয়াই
ইস্তাহারকে বেদবাক্য না ধরে
উন্নয়নের স্বার্থে অবস্থান বদল।
রাজনীতির আগে ভাবতে
হবে অর্থনীতির কথা।
দেশকে বাঁচানোর লক্ষ্যেই ১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লবের পরে নয়া অর্থনৈতিক নীতি (এনইপি) ঘোষণা করেছিলেন লেনিন। কারণ, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন জার হত্যার বিপ্লবী রাজনীতি দিয়ে নতুন সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠন অসম্ভব। এবং সেই নয়া নীতিতে ‘বাজার’-কে অস্বীকার করা হয়নি। ১৯৪৯ সালে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হয়েছিল চিনে। সেখানেও কমিউনিস্ট শাসনকে দীর্ঘজীবী করার জন্য দেং জিয়াও পিং-কে সমাজতান্ত্রিক ‘বাজার অর্থনীতি’-র পথে হাঁটতে হয়েছিল। নরসিংহ রাও ও মনমোহন সিংহ এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে পুরনো সমাজতান্ত্রিক নেহরু-ইন্দিরা মডেল পরিবর্তন করে আর্থিক উদারনীতির পথে হেঁটেছিলেন। ’৭৭ সালে বামফ্রন্ট পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার পরে বেকার-বিধবা ভাতা চালু করেছিল, তুলে দিয়েছিল প্রাথমিকে ইংরেজি শিক্ষা। কিন্তু তারাও অচিরে বুঝতে পারে, ভাতা দিয়ে বেকার সমস্যার সমাধান হবে না। হরতাল দিয়ে বিরোধী রাজনীতি হয়, কিন্তু মানুষের চাকরির জন্য চাই শিল্পায়ন। একই ভাবে ভুল বুঝতে পেরে ইংরেজি শিক্ষাও ফিরিয়ে এনেছিল বামফ্রন্ট।
ইতিহাসের রথের চাকা এ বার এক মুহূর্তের জন্য এসে থমকে দাঁড়িয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। এক দিকে ভোট-রাজনীতি, ইস্তাহারের জনপ্রিয় ঘোষণার প্রতি প্রকাশ্য দায়বদ্ধতা, আর অন্য দিকে রাজ্যের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন, দলীয় রাজনীতি মুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা, বেকারি দূরীকরণ। কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজন ভারী শিল্প। আর ভারী শিল্পের জন্য প্রয়োজন জমির অধিগ্রহণ। এমনই এক কঠিন পরিস্থিতির সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বর্ষপূর্তি হতে চলেছে মমতার সরকারের। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “৩৪ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থায় দলবাজি হয়েছে। স্কুল থেকে কলেজ, কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সর্বস্তরে ক্যাডার-রাজ তৈরি করা হয়েছে। এই দলতন্ত্রের বিষময় প্রভাব কতটা, তা নিরপেক্ষ কোনও ব্যক্তিকে দিয়ে তদন্ত করে দেখার কথা ভাবছি। ঠিক যে ভাবে এই ৩৪ বছরের আর্থিক অনিয়মও অডিট করার কথা ভেবেছি।”
তৃণমূলের ছাত্র নেতা শঙ্কুদেব পণ্ডাকে ডেকে মুখ্যমন্ত্রী গত কালই বলেছেন, “শিক্ষা ক্ষেত্রে রাজনীতিকে আমরা প্রশ্রয় দেব না। কিন্তু দলের সঙ্গে কথা না-বলে যেখানে সেখানে তুমি কথা বোলো না।” দলের অন্য নেতাদেরও বাক্সংযমের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
এটা খুব স্পষ্ট যে, মমতা বিভিন্ন স্তরে এ বার বার্তা দিচ্ছেন, তিনি রাজধর্মের দিকে এগোতে চান। যার উদাহরণ হল, জনমতের চাপে ভাঙড় কলেজের ঘটনায় তৃণমূল নেতা আরাবুল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা এবং অম্বিকেশ মহাপাত্রের নিগ্রহকারীদের গ্রেফতার করা।
যদিও সিপিএম নেতাদের বক্তব্য, এটা যথেষ্ট নয়। দলীয় নেতা নীলোৎপল বসুর কথায়, “গোটা রাজ্য জুড়ে নৈরাজ্যের আবহ তৈরি হয়েছে। শিল্পপতিরা অনেকেই পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে চলে যেতে চাইছেন। এবং শুধু শিল্পপতিরাই নয় এই রাজ্যে ভিন্ রাজ্যের যে সব সাধারণ মানুষ রয়েছেন, তাঁরাও নিরাপত্তার অভাবে ভুগছেন। সিঙ্গুরে টাটাদের প্রকল্প বাতিল হওয়ার পরে সেখানে কী হবে, কেউ জানে না। সিঙ্গুরের ভূত এই সরকারকে তাড়া করে ফিরছে।” নীলোৎপলের মতে, এই অবস্থায় বিড়লার বাড়িতে মুখ্যমন্ত্রীর যাওয়ার ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনবে, এমন কথা জোর গলায় বলা যায় না। তাঁর কথায়, “এই সরকার যদি সত্যিই শিল্প স্থাপনে উদ্যোগী হয়, তা হলে খুশি হব। কিন্তু এই উদ্যোগটা সাপে-কাটা মানুষের ক্ষতস্থানে ডেটল লাগানো ছাড়া কিছু নয়।” তৃণমূল সূত্রের অবশ্য বক্তব্য, যতই কম হোক, এগুলি এক ধরনের ‘ইতিবাচক’ পদক্ষেপ তো বটে।
তবে এখনও পর্যন্ত যা ‘পরিবর্তন’, তা প্রতীকী বলেই অভিমত রাজনীতিক থেকে শুরু করে শিল্প মহলের কর্তাদের। এবং তাঁদের বক্তব্য, তাতে কাজের কাজ কিছু হবে না। উদাহরণ দিয়ে তাঁরা বলছেন, তৃণমূলের ইস্তাহারে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) না-করার কথা বলা আছে। যার জেরে এ রাজ্য থেকে ইনফোসিস-উইপ্রো চলে যেতে বসেছে। ফলে এই সমস্যা কাটাতে হলে তৃণমূলকে এসইজেড নিয়ে তাদের ঘোষিত অবস্থান থেকে সরে আসতে হবে।
তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে আঘাত এলে পশ্চিমবঙ্গের বেকার যুবক-যুবতীরা যে সঙ্কটে পড়বে, তা মুখ্যমন্ত্রী জানেন। আর তাই তিনি ইনফোসিস-উইপ্রোকে যাতে চলে যেতে না হয়, তার জন্য উদ্যোগী হয়েছেন। দিল্লিতে ৪ মে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে তিনি বলবেন, ইনফোসিস প্রকল্পের ছাড়পত্র আগের সরকারের আমলেই কেন্দ্র দিয়ে দিয়েছিল। তা হলে তাঁর সরকারকে নতুন করে চিঠি দিতে বলা হচ্ছে কেন? মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “এসইজেড নিয়ে আমাদের দলের একটি অবস্থান আছে। আমরা তা আচমকা বদলে দিতে পারি না। কিন্তু সরকার যখন আগে থেকেই ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছে, তখন তা বন্ধ করাটাও আমাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নয়।”
সমস্যা হচ্ছে দলীয় ইস্তাহারের রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার জন্য যদি শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ, শহরে জমির ঊর্ধ্বসীমা আইনের বদল, খুচরো বিক্রয়ে বিদেশি বিনিয়োগ বা এসইজেড সবই আটকে যায়, তা হলে প্রশাসনের পক্ষে রাজ্যের উন্নয়নের পথে এগোনোই দুষ্কর হয়ে পড়বে। তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা বলেন, “ইস্তাহার বা রাজনৈতিক দলীয় অবস্থান কোনও অপরিবর্তনীয় ধারণা নয়। সময়ের সঙ্গেই সব কিছুকে প্রশাসনের উপযোগী করে তোলাটা মা-মাটি-মানুষের স্বার্থেই প্রয়োজন। যেখানে পরিবর্তন না-হলে রাজ্যের উন্নয়ন আটকে যাবে, সেই ক্ষেত্রগুলি মমতা অবশ্যই ধীরে ধীরে বিচার-বিবেচনা করবেন।” উদাহরণ হিসেবে ওই নেতা জানান, এ বার দিল্লিতে যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারপার্সন মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিমকে শহরে জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন বদলানোর জন্য চাপ দিলে তিনি আপত্তি জানিয়েছেন। কিন্তু মমতার নির্দেশে ববি এটাও জানিয়ে দিয়েছেন যে, বিষয়টি ‘কেস টু কেস’ বিবেচনা করা হবে। ইতিমধ্যেই ঊর্ধ্বসীমা আইনে ছাড়ের তালিকায় বহু শিল্প প্রকল্পকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন মমতা। তবে এই বিষয়টি রাজ্য সরকার এখনও নিজেদের হাতে রাখতে আগ্রহী। যাতে গরিব মানুষের স্বার্থ ব্যাহত না হয়।
রাজধর্মের যে বার্তা বর্ষপূর্তির সন্ধিক্ষণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিচ্ছেন, তাকে শিল্প মহল স্বাগত জানাচ্ছে ঠিকই, তবে তারা ঘর পোড়া ব্যবসায়ী। তাদের প্রশ্ন, ‘প্রতীকী বার্তা’ শেষ পর্যন্ত একটা অবভাস তৈরি না করে বাংলাকে সত্যি সত্যি রাজধর্মের বাস্তবতায় পৌঁছে দেবে তো?



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.