|
|
|
|
বিনোদন |
‘বাঁধা’ দর্শকের ভিড়েই
সুপারহিট জেলার নাটক
জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায় • কলকাতা |
 |
|
কোনওটা হাজার অভিনয় রজনী অতিক্রান্ত, কোনওটা ৫০০ পূর্ণ করার পথে।
বড় বাজেট নয়, মিডিয়ার প্রচার নয়, স্রেফ দর্শক আনুকূল্যের জেরে টিকে থাকা কিছু নাটক। জেলায় জেলায় বহু বছর ধরে অভিনীত হয়ে আসা, মফস্সলের বহু নাট্যদলের কাছে আইকন হয়ে ওঠা কিছু নাটক আবার
নতুন করে। শহরের দলগুলি যেমন বিভিন্ন সময়ে ফিরিয়ে আনে নিজেদের সাড়া জাগানো প্রযোজনা, সেই ধারায় সামিল এ বার জেলাও। ২৮ এপ্রিল থেকে বারাসতের এক মঞ্চে ৬টি নাটকের রিমেক নিয়ে শুরু হয়েছে সপ্তাহব্যাপী অভিনব নাট্যোৎসব।
উদ্বোধনী নাটক ছিল, গোবরডাঙা শিল্পায়নের ২০০৩ সালের পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রযোজনা, ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’। বাংলা রঙ্গমঞ্চে মার্কেজকে হাজির করেছিল আশিস চট্টোপাধ্যায়ের দলই। সাড়া জাগিয়েও খুব বেশি অভিনয় হয়নি অবশ্য। সেই আফশোস এ বার পুষিয়ে নিতে চান তাঁরা। এ ছাড়া আছে অভিনেয় বালী-র ‘দুধের দাম’, ইউনিটি মালঞ্চ হালিশহরের ‘হনুয়া কা বেটা’, শৌভিক সাংস্কৃতিক চক্র দক্ষিণেশ্বরের ‘কেননা মানুষ’, সারথি চুঁচুড়ার ‘খেলাঘর’, এবং কোমল গান্ধার দক্ষিণেশ্বরের ‘পনেরোই অগস্টের গপ্পো’। ২০-২৫-৩০ বছরের পুরনো এক-একটি প্রযোজনা। ‘কেননা মানুষে’র শো হাজার ছাড়িয়েছে, ‘হনুয়া কা বেটা’ ৫০০ পূর্ণ করতে চলেছে। অন্যগুলোও ৪০০-৬০০র কোঠায়। নবীনদের কাছে এই নাটকগুলো পৌঁছে দেওয়াটাই লক্ষ্য, বললেন আয়োজক পবিত্র মুখোপাধ্যায়। সেই সঙ্গে উদ্যাপন করা জেলার নাট্যচর্চার
জোরের জায়গাটাকে। |
 |
‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’ নাটকের একটি দৃশ্য |
কলকাতার নামীদামি দলগুলোকে আজও দর্শক টানার পরেও প্রযোজনা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার খরচ সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। অথচ জেলা-পিছু গড়ে প্রায় শ’খানেক ছোট-বড় নাট্যদল কী ভাবে নাটক করে চলেছে বছরের পর বছর? কী ভাবে একের পর এক হিট নাটক উপহার দিয়ে যাচ্ছে বহরমপুর ঋ
ত্বিক, আগরপাড়া কালপুরুষ, কাঁচড়াপাড়া ফিনিক, শিলিগুড়ি দামামা, ব্যান্ডেল আরোহী-র মতো বহু দল? কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদান-অর্থ আসতে শুরু করেছে হালে। সব দল তা পায়ও না। অর্থনীতির কোন মন্ত্র টিকিয়ে রেখেছে তাদের?
জনসংযোগই যে তাঁদের প্রধান জোর, এক বাক্যে মানছেন জেলার নাট্য-কর্মীরা। ‘ভিড়’ টানতে তাঁদের বড় মিডিয়ার প্রচারের উপরে নির্ভর করতে হয় না। আঞ্চলিক পত্রিকা, কেবল টিভি, কিছু ব্যানার-পোস্টার অবশ্যই আছে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি করে আছে ‘বাঁধা’ দর্শকের ভরসা। সুখচর পঞ্চম রেপার্টরি-র মলয় মিত্র যেমন বলছিলেন, মফস্সলের দর্শক টানার রীতিটা অনেকটা কিছু পণ্যসংস্থার মার্কেটিং কৌশলের মতো। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ওই সব পণ্যের পসরা নেই। আছে তাদের নিজস্ব ‘কাস্টমার চেন’ হাতে হাতে পণ্য পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা। মফস্সলে ছোট-বড় প্রায় সব নাট্যদলেরই আছে পুশ-সেলের মজুত। উপরন্তু এলাকার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহ-উদ্দীপনাও একটা বিরাট ভরসা। তাঁরা শুধু নাটক দেখতেই আসেন না, দলগুলিকে নানা ভাবে সাহায্যও করেন।
শান্তিপুর সাংস্কৃতিকী-র কৌশিক চট্টোপাধ্যায়রা যেমন দলের পক্ষ থেকে বাড়ি বাড়ি ভাঁড় পাঠান। সেই ভাঁড়ে যার যেমন সাধ্য পয়সা জমিয়ে সেটা আবার দলকে ফেরত দেন। দলের প্রচার এবং আর্থিক অনুদান সংগ্রহ, দুইই হয়। এখনও সরকারি অনুদান নেওয়ার রাস্তায় হাঁটেননি তাঁরা। এই ভাবেই ১৫-১৬ হাজার টাকা বাজেটে বানানো ‘অচলায়তন’ ইতিমধ্যেই পুরস্কার এবং আমন্ত্রিত অভিনয় মিলিয়ে লাখ টাকার উপরে তুলে ফেলেছে। লখনউয়ে বহির্বঙ্গ নাট্যোৎসবে এ রাজ্যের অন্যতম প্রতিনিধি এই নাটক। মিনার্ভা রেপার্টরির পরবর্তী প্রযোজনা ‘চন্দ্রগুপ্ত’-র পরিচালক কৌশিকই।
কম বাজেটে জমাট নাটক মফস্সলের নাট্যচর্চায় এটাই গোড়ার কথা। দলের ছেলেমেয়েরাই সেট সাজাবে, পোশাক বানাবে, আলো করবে, মেক আপ করবে! অর্থাৎ? পেশাদার টেকনিশিয়ান আনার খরচ নেই! হল ভাড়া করার খরচ হয় নেই, নতুবা থাকলেও সামান্য। বিজ্ঞাপনের খরচও প্রায় নেই! দারুণ ক্ষিপ্রতায় কয়েক মিনিটের মধ্যে মঞ্চ সাজিয়ে নাটক করে আবার নিজেরাই জিনিসপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পড়া! ইউনিটি মালঞ্চ-র দেবাশিস সরকাররা এই ভাবে বছরে ২১০ দিন শো করেছেন, এমনও হয়েছে!
কোথায় হয় এত শো? শহরের দলগুলো যেমন নিজেরা হল নিয়ে নিয়মিত শো করে, জেলায় শো মানে মূলত নাট্যপ্রতিযোগিতার মঞ্চ নতুবা আমন্ত্রিত অভিনয়। পুরস্কার অর্থ আর কল শো-ই দীর্ঘদিন অবধি জেলার দলগুলির আয়ের প্রধান উৎস ছিল। নিজস্ব পরিচিতি আর মজবুত দর্শক-ভাণ্ডার তৈরি হওয়ার পরে অনেক দল প্রতিযোগিতা-মঞ্চ ছেড়েছে। কৌশিক, দেবাশিস কেউই এখন আর প্রতিযোগিতার নাটক করেন না। প্রতিযোগিতা কমে গিয়ে ইদানীং জেলাতেও নাট্যোৎসবেরই রমরমা। হালিশহরে বিনোদিনী মঞ্চে দেবাশিসরা নিজেরা শো করলে এখন গড়ে ২০ হাজার টাকার বিক্রি আছে। সোনারপুরে কৃষ্টি সংসদ, হাওড়ায় নটধা-ও নিজেরা স্থায়ী মঞ্চ তৈরি করেছে। এই দু’টি দল কলকাতাতেও নিয়মিত অভিনয় করে।
‘মালাডাক’ নাটকের বিপুল সাফল্যের (হাজার রজনী অতিক্রান্ত) পর থেকেই কলকাতায় নিয়মিত অভিনয় করে গোবরডাঙা শিল্পায়ন। এই দল থেকেই এক সময় উঠে এসেছিলেন বর্তমানে কলকাতার প্রথম সারির পরিচালক দেবেশ চট্টোপাধ্যায়। এ ছাড়া জেলা থেকে এসে কলকাতায় নিয়মিত অভিনয় করার পথে এগিয়েছে গোবরডাঙা নকশা, কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্র, হাওড়া দক্ষিণায়ন। শহরের কাছাকাছি থাকায় এই দলগুলির পক্ষে সেটা সম্ভব হয়েছে। বাকিদের জন্য মূলত নাট্যমেলা বা নাট্যেৎসবের আমন্ত্রণই ভরসা। দূরের দলগুলির মধ্যে বালুরঘাট ত্রিতীর্থের ‘দেবাংশী’-র কলকাতায় কিছু শো হয়েছে। কর্ণধার হরিমাধব মুখোপাধ্যায় এখানে এসে ‘প্রফুল্ল’ নাটকে অভিনয় করে গিয়েছেন। দেবশংকর হালদার অভিনীত ‘আওরঙ্গজেব’ নাটকের নির্দেশনাও করেছেন।
তবু কলকাতা আর জেলা, একটা ‘অভিমানে’র
সম্পর্ক রয়েই গিয়েছে। কৌশিক বলছিলেন, দু’পক্ষকেই পরস্পরের প্রতি আরও বেশি করে হাত বাড়াতে হবে। ‘মফস্সলি’ নাটকের গণ্ডিকে আরও প্রসারিত করার
দিকে জোর দিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ নাট্য অ্যাকাডেমিও।
দেবেশ জানাচ্ছেন, জেলায় শুধু কর্মশালা না করে এ বার পূর্ণাঙ্গ প্রযোজনায় নজর দেওয়া হচ্ছে। দেবাশিসরাও চাইছেন বড় প্রযোজনার দিকে যেতে, কলকাতায় উপস্থিতি বাড়াতে। কত বছর আগেই মোবাইল সংস্থার অনুদানে ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ করেছিলেন আশিস, শহরতলি থেকে প্রথম দল যারা ওই অনুদানের জন্য মনোনীত হয়েছিল! আশিস নিজে বিশ্বাস করেন, জেলা-শহরের ভৌগোলিক বিভাজন নয়। গুণমানে আপস না করে নাটক করে যাওয়াটাই বড় কথা! |
|
|
 |
|
|