নিত্য-ব্যবহার্য ওষুধের মান পরীক্ষা করানো হয়নি বছরের পর বছর। ‘কোল্ড চেন’ বজায় রাখার বাধ্যতামূলক শর্ত না-মেনে খারাপ হয়ে থাকা কুলারেই দিনের পর দিন রাখা হয়েছে জীবনদায়ী ওষুধ ও ইঞ্জেকশন। কোনও জরুরি ওষুধ মাসের পর মাস কেনাই হয়নি, আবার কোনও ওষুধ প্রচুর কিনে ফেলে রাখা হয়েছে। জেলার হাসপাতালের ‘রোগী কল্যাণ সমিতি’ থেকে ওষুধ কেনার জন্য লক্ষাধিক টাকার চেক পাঠানো হয়েছে। সেই চেক বেপাত্তা। সরবরাহ হয়নি ওষুধও।
ওষুধ নিয়ে দুর্নীতির এই গুরুতর অভিযোগ উঠেছে হাওড়া জেলায়। হাওড়ার ‘ডিস্ট্রিক্ট রিসার্ভ স্টোর’ (ডিআরএস)-এ ওষুধ কেনা ও সরবরাহের প্রক্রিয়ায় ‘অস্বচ্ছতা’ রয়েছে বলে খবর আসে স্বাস্থ্য দফতরে। এর পরেই ২০১১-র সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত হাওড়া ডিআরএস-এর কাজকর্ম নিয়ে স্বাস্থ্য দফতর অন্তর্বর্তী অডিটের নির্দেশ দেয়। ২০১২-র ৬ ফেব্রুয়ারি অডিট শুরু হয়। চূড়ান্ত রিপোর্ট তৈরি। তাতেই তদন্তকারীরা অভিযোগ করেছেন, ওষুধ নিয়ে ওই কয়েক মাসেই প্রায় ৫০ লক্ষ টাকার বেশি নয়ছয় হয়েছে হাওড়ায়।
স্বাস্থ্য দফতরের মুখপাত্র অসিত বিশ্বাস বলেন, “হাওড়ার জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তা স্বাতী দত্তের হাতে রিপোর্ট পৌঁছেছে। দুর্নীতির জায়গাগুলি আবার খতিয়ে দেখছি। দোষী প্রমাণিত হলে শাস্তি অবধারিত। আর তদন্তকারীরা যা যা সুপারিশ করেছেন, সেগুলি যাতে অবিলম্বে করা যায়, সে নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।” গত বছরই জলপাইগুড়ি ও হুগলি জেলায় ওষুধ-কেলেঙ্কারি নিয়ে আলোড়ন হয় স্বাস্থ্য দফতরে। স্বাস্থ্য দফতর ও প্রশাসনের একাধিক লোক সাসপেন্ড হয়েছিলেন।
যে কোনও জেলার ডিআরএস-এ সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোর থেকে ওষুধ ও ইঞ্জেকশন এনে রাখা হয়। তার পর সেখান থেকে জেলার হাসপাতাল ওষুধ নিয়ে যায়। হাওড়ার ডিআরএস-এর কাজে কী কী ‘অনিয়ম’ বা ‘দুর্নীতি’ দেখছেন তদন্তকারীরা?
রিপোর্ট বলছে, সঞ্চিত ওষুধ ও ইঞ্জেকশনের নমুনা নিয়মিত ব্যবধানে ড্রাগ কন্ট্রোলে পরীক্ষা করতে পাঠানো বাধ্যতামূলক। কিন্তু হাওড়া ডিআরএস-এ ২০০৮-এর জুলাইয়ের পরে কোনও ওষুধের নমুনা পাঠানো হয়নি। অথচ, মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তার অফিস থেকে ওষুধ পরীক্ষার নামে নিয়মিত টাকা নেওয়া হয়েছে।
২০১১-র সেপ্টেম্বরে জগৎবল্লভপুর হাসপাতাল ৫০০ ফাইল সর্দিকাশির ওষুধ হাওড়া ডিআরএস-এ ফেরত পাঠায়। অভিযোগ ছিল, ওষুধ খারাপ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেই ওষুধ না ফেলে চারটি বাক্সে অন্য ওষুধের সঙ্গেই রেখে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য দফতরকে কিছু জানানোও হয়নি। আবার ২০১১-র ফেব্রুয়ারিতে একটি সংস্থা থেকে এক সঙ্গে পাঁচ হাজার ফাইল কাশির ওষুধ কেনা হয়। তদন্তকারীরা দেখেন, তার মধ্যে প্রায় ১৯০০ ফাইল ওষুধ ছানা কাটার মতো কেটে গিয়েছে। সেগুলিও ডিআরএস-এ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে সেগুলি বদলে দিতেও বলা হয়নি, উল্টে পুরো টাকাই দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
২০১১-র সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যেই গাববেড়িয়া হাসপাতাল, উদয়নারায়ণপুর হাসপাতাল, দক্ষিণ হাওড়া হাসপাতাল ও টি এল জয়সোয়াল হাসপাতালের ‘রোগী কল্যাণ সমিতি’ থেকে সব মিলিয়ে এক লক্ষ ৬৭ হাজার ৯৩০ টাকার চেক হাওড়া ডিআরএস-এ পাঠানো হয় ওষুধ কিনতে। অভিযোগ, সেই চেকগুলি বেপাত্তা। কোনও ওষুধও আসেনি।
তদন্তকারীরা আরও জানিয়েছেন, ডিআরএস-এর কুলারটি দীর্ঘদিন খারাপ ছিল। তাঁরা দেখেন, খারাপ কুলারের মধ্যেই টিটেনাস টিকা, র্যাবিস ভ্যাকসিন, সাপে কামড়ানোর ওষুধ ডাঁই করে রাখা। অভিযোগ, জাপানি এনসেফেলাইটিজের ৫৭৪টি মেয়াদ-উত্তীর্ণ টিকাও মিলেছে কুলারে। এ ব্যাপারে ডিআরএস-এর দায়িত্বে থাকা হাওড়া জেলার উপ মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তা (২) কিশলয় দত্তের বক্তব্য, “কুলারের স্টেবিলাইজারটা খারাপ ছিল কিছু দিন। তাতে ওখানে রাখা ওষুধের ক্ষতি হয়নি।” তিনি আরও বলেন, “এত ছোট জায়গায় গুছিয়ে ওষুধ রাখা সম্ভব নয়। কিছু গোলমাল হবেই।”
তদন্তকারীরা জানান, অন্তত ৪৫ ধরনের ওষুধের ক্ষেত্রে লিখিত স্টকের সঙ্গে প্রকৃত স্টকের প্রচুর পার্থক্য রয়েছে। যেমন, একটি প্রেসারের ওষুধ ১০ হাজার রয়েছে বলে লেখা আছে। কিন্তু আদতে একটিও পাওয়া যায়নি। আবার একটি পেট খারাপের ওষুধ একটিও নেই বলে লেখা থাকলেও তদন্তকারীরা সেই ওষুধ পেয়েছেন ১৬ লাখ ৩০ হাজার। অন্তত ১৫ ধরনের অতি প্রয়োজনীয় ওষুধের কোনও স্টক মেলেনি। আবার এমন অন্তত চার ধরনের ওষুধ মিলেছে, যা মাসের পর মাস পড়েই রয়েছে। কোনও চাহিদা নেই। চার-পাঁচ মাস আগে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলি টাকা দিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও অন্তত ১৬ ধরনের ট্যাবলেট ও সিরাপ হাওড়া ডিআরএস-এ আসেনি বলেও অভিযোগ উঠেছে। |