না মানলে কড়া পদক্ষেপের হুঁশিয়ারি
সুদ মকুবে ১৫ দিন চরমসীমা মমতার
রাজ্যের ঘাড়ে চেপে থাকা ঋণের উপর সুদ মকুব করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য কেন্দ্রকে পনেরো দিন সময় দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তিন বছর সুদ মকুব করার জন্য কেন্দ্রের কাছে আর্জি জানিয়ে আসছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনও ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। এই অবস্থায় আজ রীতিমতো ‘চরমসীমা’ বেঁধে দিয়ে মনমোহন সিংহের সরকারের প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর বার্তা, তাঁর দাবি মানা না হলে ভবিষ্যতে তিনি ‘কড়া পদক্ষেপ’ করবেন।
শনিবার টাউন হলে ডব্লিউবিসিএস (এগ্জিকিউটিভ) অ্যাসোসিয়েশনের ডাকা এক সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “বছরে রাজ্যের আয় ২১ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ঋণ শোধ করতেই ২২ হাজার কোটি টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। অথচ এর দায় আমাদের নয়। আমরা বহু বার কেন্দ্রের কাছে তিন বছর সুদ মকুব করার আর্জি জানিয়েছি। কোনও কাজ হয়নি। আর ১৫ দিন অপেক্ষা করব। ওরা আমাদের দাবি না-মানলে আগামীতে এটা বড় ইস্যু হয়ে যাবে।”
‘বড় ইস্যু’ বলতে তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন, তা অবশ্য আজ খোলসা করেননি মুখ্যমন্ত্রী। তবে তাঁর এই বক্তব্য যে কেন্দ্রের উপরে নতুন করে চাপ তৈরি করবে, বলে নিশ্চিত রাজ্য প্রশাসনের কর্তারা।
রাজ্যের আর্থিক পরিস্থিতি যে উন্নয়নের পথে অন্তরায় হয়ে পড়েছে, সেই প্রসঙ্গ টেনে মমতা আজ বলেন, “রোজ সকালে অমিতদা (রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র) হিসেব কষতে বসেন, আজ কী করে চলবে! তা সত্ত্বেও ১০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা ঘোষণা করেছি। খরচ তো দিনদিন বাড়ছেই।”
আজই মুখ্যমন্ত্রী বিডিও-দের ‘স্পেশাল অ্যালাওয়েন্স’ এক ধাক্কায় বাড়িয়ে চার গুণ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, “বিডিও-রা মাসে আড়াইশো টাকা ‘স্পেশাল অ্যালাওয়েন্স’ পান। এটা বড্ড কম। এক হাজার হলে ভাল হয়।” এর পরে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে বিডিও-দের এক হাজার টাকা করে ‘স্পেশাল অ্যালাওয়েন্স’ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী।
টাউন হলে মুখ্যমন্ত্রী।- নিজস্ব চিত্র
মমতার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে নতুন করে টানাপোড়েন তৈরি হবে কি না, সেই প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই উঠেছে। উত্তরপ্রদেশ ভোটে ধাক্কা খাওয়ার পরে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে মমতার সঙ্গে সম্পর্ক যথাসম্ভব ভাল রাখতে চান কংগ্রেস নেতৃত্ব। সেই কারণে মমতার ‘হুঁশিয়ারি’ সম্পর্কে আজ সতর্ক প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন দলীয় মুখপাত্র মণীশ তিওয়ারি। তিনি বলেন, “একে হুঁশিয়ারি হিসেবে না দেখে পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর দাবি হিসেবেই দেখা উচিত। আমরা মনে করি কেন্দ্র অবশ্যই বিষয়টি বিবেচনা করবে। তবে কোনও একটি রাজ্যকে বিশেষ সাহায্য দেওয়ার নিয়ম আছে কিনা, তা-ও কেন্দ্রকে খতিয়ে দেখতে হবে।”
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় এখন বিশ্ব ব্যাঙ্ক ও আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের বৈঠকের জন্য আমেরিকায়। তাঁর অনুপস্থিতিতে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের কোনও কর্তাই এ প্রসঙ্গে মুখ খুলতে নারাজ। কিন্তু ঠারেঠোরে তাঁরা এটাই বোঝাতে চাইছেন, সরকারি নিয়ম মেনে চলতে গেলে মমতার এই দাবি মেনে নেওয়া খুবই কঠিন। ১৫ দিনের ‘চরমসীমা’-র মধ্যে এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়াও যায় না। তা ছাড়া, পশ্চিমবঙ্গের মতো কেরল, পঞ্জাবও আর্থিক সমস্যার মধ্যে রয়েছে। (এই দুই রাজ্যের সমস্যার কথা আজ মমতাও বলেছেন) পশ্চিমবঙ্গকে আলাদা করে আর্থিক সাহায্য দেওয়া হলে শুধু তারা নয়, অন্য রাজ্যগুলিও সরব হবে।
মমতা আজ ফের বলেছেন, রাজ্যের মাথার উপরে যে দু’লক্ষ কোটি টাকা ঋণের বোঝা রয়েছে, সেটা বামফ্রন্ট সরকারের চাপিয়ে যাওয়া। সেই দায় কেন তিনি নেবেন। এটা কেন্দ্রকে বুঝতে হবে। রাজ্যের অর্থ দফতরের হিসেবে, ক্ষমতা হাত বদলের সময়ই রাজ্যের ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লক্ষ ৯২ হাজার কোটি টাকা। এখন তা বেড়ে ২ লক্ষ কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছেছে। এ জন্য বছরে ১৫ হাজার কোটি টাকা সুদ মেটাতে হয়। সুদ-আসল মিলিয়ে দিতে হয় প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। তিন বছর সুদ দিতে না হলে ঘর অনেকটাই গুছিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।
মমতা আজ বলেন, “ওই ঋণ আমরা নিইনি। তাই শোধের দায়িত্বও আমাদের নয়। এক বছর অপেক্ষা করেছি। কেউ যদি মনে করে ভাতে মারবে, সহ্য করব না। কেন্দ্রকে ঋণ মকুব করতেই হবে।” দিল্লিকে বারবার জানিয়েও যে এখনও কোনও ফল মেলেনি, সে কথা জানিয়ে মমতা বলেন, “আমি নিজে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছি। অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে তো এই নিয়ে ৫০ বার কথা হয়েছে। কিন্তু ঋণ মকুব তো করেইনি, উল্টে কেন্দ্রীয় বিক্রয় কর বন্ধ করে দিয়েছে।”
অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা বলছেন, মূলত দু’টি সূত্র থেকে ঋণ নিয়েছে রাজ্য। এক, বাজার থেকে। দুই, স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্প থেকে। বাজার থেকে নেওয়া ঋণের সুদ মকুব করার ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের নেই। স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্প থেকে নেওয়া ঋণের ব্যাপারে কী করা সম্ভব তা খতিয়ে দেখতে অর্থ মন্ত্রকের ব্যয়সচিবের অধীনে একটি কমিটি তৈরি হয়েছে। তবে অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা একই সঙ্গে জানাচ্ছেন, সরকারি নিয়ম ও সাংবিধানিক গণ্ডির মধ্যে থেকে সুদ মকুব করা সম্ভব নয়। অন্য কোনও ভাবে রাজ্যকে সুরাহা দেওয়া যায় কিনা, সেটাই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আর সুরাহা দেওয়া হলে শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, দেওয়া হবে কেরল, পঞ্জাবকেও।
অর্থ মন্ত্রক সূত্রে আরও বলা হচ্ছে, কেন্দ্রীয় বিক্রয় করের হার কমানো বাবদ ক্ষতিপূরণ নিয়ে মমতার দাবিতে ইতিমধ্যেই সাড়া দিয়েছে কেন্দ্র। পণ্য-পরিষেবা কর চালু করার জন্য রাজ্যগুলিকে বিক্রয় করের হার ধাপে ধাপে কমাতে বলা হয়েছিল। আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, এ জন্য যে রাজস্ব ক্ষতি হবে, কেন্দ্র তা মিটিয়ে দেবে। কিন্তু কিছু রাজ্যের ‘অসহযোগিতা’-র ফলে পণ্য-পরিষেবা কর চালু ক্রমশ পিছিয়ে যাওয়ায় আর ক্ষতিপূরণ মেটানো হবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্র। এতেই আপত্তি তুলে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লেখেন মমতা। অভিযোগ করেন, এর ফলে রাজ্যের ১৮০০ কোটি টাকা ক্ষতি হবে। মমতার আপত্তিকে গুরুত্ব দিয়ে কেন্দ্র সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বিষয়টি খতিয়ে দেখতে কেন্দ্র ও রাজ্যের আমলাদের নিয়ে শীঘ্রই একটি কমিটি তৈরি হবে।
‘‘রোজ সকালে অমিতদা হিসেব কষতে বসেন, আজ কী করে চলবে! তা সত্ত্বেও ১০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা ঘোষণা করেছি। খরচ তো দিনদিন বাড়ছেই।’’
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
এর পাশাপাশি, রাজ্যের ১১টি জেলাকে ‘অনগ্রসর’ বলে ঘোষণা করে ৮৭৫০ কোটি টাকার প্রকল্প মঞ্জুর করা হয়েছে। দার্জিলিং ও কোচবিহারকেও অনগ্রসর জেলা হিসেবে ঘোষণা করে অর্থ সাহায্য দেওয়ার দাবি তুলেছেন মমতা। সেই দাবিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। রাজ্যকে অতিরিক্ত ঋণ পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মমতার দাবি মেনে গত বছরের তুলনায় যোজনা আয়তন ১৬.৫% বৃদ্ধি হয়েছে। এর মধ্যে ৯৬০০ কোটি টাকা কেন্দ্রীয় সাহায্য। মমতাকে সন্তুষ্ট করতে সেই সাহায্যের পরিমাণ বাড়ানো হতে পারে।
কিন্তু এতেও তৃণমূলনেত্রীকে সন্তুষ্ট করা যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় থাকছে। কারণ, কেন্দ্রীয় বাজেটের প্রস্তুতি-পর্বে রাজ্যের অর্থমন্ত্রীেদর সঙ্গে প্রণববাবুর বৈঠকে অমিত মিত্র যুক্তি দিয়েছিলেন, কেন্দ্র যা অর্থ দিয়েছে, তা সুনির্দিষ্ট প্রকল্পের জন্য। সরকারি কর্মচারীদের বেতন দিতে বা সুদ মেটাতে সেই অর্থ ব্যয় করা যাবে না। যা রাজ্যের আশু দরকার। সেই কারণেই সুদ মকুব আর বিশেষ আর্থিক সাহায্যের দাবি তোলে রাজ্য।
প্রণববাবু বাজেটে তেমন কোনও ঘোষণা করেননি। বাজেটের পরে কলকাতায় অ্যাসোচ্যামের বৈঠকে গিয়েও আর্থিক প্যাকেজ বা সুদ মকুব নিয়ে কোনও প্রতিশ্রুতি দেননি। যদিও ওই বৈঠকে পার্থ চট্টোপাধ্যায় প্রসঙ্গটি তুলেছিলেন। প্রণববাবু এমনিতেই নিয়ম ভেঙে কিছু করার পক্ষে নন। তা ছাড়া পশ্চিমবঙ্গকে আলাদা ভাবে সাহায্য করতে গেলে কেন্দ্রকে যে অন্য রাজ্যের প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে, তার প্রমাণ আগেই মিলেছে। গত অক্টোবরে জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের বৈঠকে মমতা বিশেষ প্যাকেজের দাবি তোলেন। সঙ্গে সঙ্গে আপত্তি তুলে জয়ললিতা বলেন, কেন্দ্র ‘একচোখমি’ করলে তা তিনি মানবেন না।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.