সিনেমা সমালোচনা...
ctrl+s=মরমি
ল্যাপটপ অন.. সুইচ টু উইন্ডোজ....।
ওই ফুটে উঠল আমার স্ক্রিনসেভার! এ বার আমি চলে যাব এমএস অফিস-ওয়ার্ডে...ফাইল সেভ অ্যাজ...অ্যাজ? অ্যাজ?
‘একটি ল্যাপটপ এবং কয়েক জন’।
না। ‘ব্যাকস্পেস’।
‘এক জন ল্যাপটপ এবং আরও কয়েক জন’।
কন্ট্রোল এস, ‘সেভ’।
এই ল্যাপটপটাই আমার আলমারি...আমার ডায়েরি, লাইব্রেরি, খেলনাবাটি.. আমার অফিস, সিনেমা হল, গানের খাতা, ছবির অ্যালবাম, ইন্টারনেটের চাবি...মানে, ল্যাপটপ যেমন হয় আর কী! সেই ল্যাপটপ নিয়ে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবি।
ছবিটা হতেই পারত, আজকের ল্যাপটপ প্রজন্মের চকচকে ফটোশপ। হতেই পারত, ফেসবুক-জি-টকের ভাষায় বলা স্লাইডশো। অথবা কাট-পেস্ট-ডিলিট গতিতে ছুটন্ত শহরের হাতফেরতা ইমোটিকন। কৌশিকের ছবি তার ধার দিয়েই যায়নি।
ল্যাপটপের মতো একটা আধুনিক জীবনসঙ্গীকে মাঝখানে রেখে কৌশিক যে ছবি বানিয়েছেন, তাল-লয়-ছন্দে তা আদ্যন্ত এক ক্লাসিকাল সিম্ফনি। এই দুরন্ত চ্যালেঞ্জটা নেওয়ার জন্য তাঁকে অভিবাদন!! তাঁর ‘ল্যাপটপ’কে ঘিরে দামি চারচাকার পাশে দাঁড়িয়ে আছে রঙ-চটা স্কুটার। নামী পার্লারের শ্যাম্পুর ফেনা ‘গ্রুপ’ করা আছে সেকেন্ড ক্লাস বার্থ-এর সঙ্গে। প্রতি কথায় ‘অ’সাম’ বলে চেঁচিয়ে ওঠা উল্লাস নয়, ‘ল্যাপটপে’র মেজাজ নির্জন বিষাদের। পেশাদারি সাফল্যের নির্ঘোষ নয়, ভাগ্যের মার খাওয়া দীর্ঘশ্বাস। কিন্তু তাই বলে ‘আহা কী মানবিক, আহা কী সমাজসচেতন’ জাতীয় ক্লিশেগুলো মোটেই রিসাইকল বিন থেকে তুলে আনব না। এত মরমি ছবির জন্য এত জীর্ণ সব বাক্যবন্ধ কোনও মতেই লেখা চলে না!
ল্যাপটপ
কৌশিক, অনন্যা, রাজেশ, শাশ্বত, রাহুল, পীযূষ, চূর্ণী
মোবাইল, ল্যাপটপ, পেনড্রাইভ, হার্ড ডিস্ক আসলে দ্রব্যগুণেই খুব অ-যান্ত্রিক! কারণ ওদের প্রত্যেকের ‘মেমরি’ আছে! সেই ‘মেমরি’ জলের মতো। যে পাত্রে রাখা হয়, সেই পাত্রের আকার নেয়। ‘মেমরাইজ’ করার ক্ষমতাটা ওদের নিজস্ব। কিন্তু ‘মেমরি’গুলো আমার, আপনার! ভারী ব্যক্তিগত সব ‘মেমরি’! কখনও কখনও গোপনও। সেগুলো ওই যন্ত্রগুলোর মধ্যে জমা থাকে! জীবনের, সত্তার এক-একটা অংশ আমরা ওদের মধ্যে চালান করে দিই। আর, তখনই ওরা ‘এক-একটি’ থেকে ‘এক-এক জন’ হয়ে ওঠে! কৌশিকের ছবিতে এই নানা রকম ‘হয়ে ওঠা’রই টুকরো টুকরো গল্প বলা আছে!
সে সব গল্পে ভাড়াটের হেঁসেল থেকে মাংস রান্নার সুঘ্রাণ লেগে আছে। সেখানে বৃষ্টিতে ভেজা সালোয়ার-কামিজ ইস্ত্রি করে শুকিয়ে নিচ্ছে এক যুবতী। গায়ে সস্তার ব্রেসিয়ার। আচমকা একটি পুরুষ ঘরে ঢুকতেই যান্ত্রিক অভ্যাসের মতো বুকে কাপড় টেনে নেওয়ার চেষ্টা করে সে! তার পরই খেয়াল হয়, কার কাছে নিজেকে আড়াল করা? মানুষটি তো দৃষ্টি-হীন!
এর বেশি গল্পগুলোর একটুও এখানে বলব না। মনিটরে শুধু ফুটে উঠুক কয়েকটা মুখ। অন্ধ লেখক (কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়), অনুলিখনের কাজ করা টাইপিস্ট মেয়েটি (অনন্যা চট্টোপাধ্যায়), পাইস হোটেলের ছাপোষা মালিক (পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়), কম্পিউটার সেন্টারে পড়ানোর কাজ নেওয়া যুবক (গৌরব চক্রবর্তী), ট্যাক্সি বেচে শববাহী গাড়ি চালানোর কাজ ধরা ড্রাইভার (রাজেশ শর্মা), নামী ফার্টিলিটি ক্লিনিকের ডাক্তার (অরিন্দম শীল), ডাক্তার-তনয়া (ঋধিমা), তরুণ প্রকাশক (রাহুল বসু) এবং তাঁর বৃদ্ধ কর্মচারী (অরুণ গুহঠাকুরতা), বাতাসিয়া টি এস্টেট-এর প্ল্যান্টার দম্পতি (শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় এবং চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়)... চরিত্র-তালিকা দেখে বুঝতে পারছেন, ‘ল্যাপটপে’র ভ্রমণ-পথে কত বিচিত্র মাইলস্টোন ছড়ানো আছে! ছবিটা দেখলে বুঝবেন, প্রায় প্রত্যেকটা গল্পেই ‘ও হেনরি’-সুলভ এক-একটি মোচড় আছে! কন্ট্রোল সি-কন্ট্রোল ভি জমানায় এমন মৌলিক একটি কাহিনি-ভাবনার জন্য কৌশিক আলাদা করে সেলাম পাবেন। পূর্বসূরিদের কথা মাথায় রেখেই এটা বলছি। পূর্বসূরি বলতে? ধরুন, সলিল চৌধুরীর গল্প ‘ড্রেসিং টেবিল’ বা তপন সিংহের ছবি ‘হারমোনিয়াম’! বা ধরুন, ফ্রাঁসোয়া জিরার্দ-এর ছবি ‘দ্য রেড ভায়োলিন’! কৌশিকের ছবি এই সবার পাশে নিজস্ব আসন দাবি করবে! ‘ল্যাপটপ’ তার মেমরি-সহ একটা আখ্যানের জঠর থেকে বের করে আনবে আর এক আখ্যান!
এই গল্পমালায় কৌশিক-অনন্যার অভিনয়ে (পরিচালক কৌশিককে এই ছবিতে ছাপিয়ে গিয়েছেন অভিনেতা কৌশিক! তাঁর সঙ্গে অবিস্মরণীয় সঙ্গত, অনন্যার), দৃশ্যভাবনায় (শীর্ষ রায়), সংলাপ রচনায়, আবহসঙ্গীতের ব্যবহারে (ময়ূখ ভৌমিক) এই অংশটা নিজেই পূর্ণাঙ্গ কাহিনিচিত্র হয়ে উঠতে পারত!
এর পরেই বলা উচিত পীযূষের কথা। স্ত্রী (অপরাজিতা আঢ্য)-পুত্র (গৌরব) নিয়ে সংসার। মাংস কিনে বাড়ি ফেরা তৃপ্ত পিতা, কুণ্ঠিত ভাড়াটে, অপমান লাঞ্ছিত স্বামী পরতে পরতে দুর্দান্ত পীযূষ। গৌরবও বেশ ভাল। কয়েকটা ছোট্ট আঁচড়েই নজর কাড়েন অপরাজিতা। আর নিজের জাত চেনাতে রাজেশের কাছে তো শুধু গাড়িতে ঘুম দেওয়ার দৃশ্যটাই যথেষ্ট!
তুলনায় দুর্বল দ্বিতীয়ার্ধে উত্তরবঙ্গের অংশটা। শ্লথ, দীর্ঘায়িত। মৈনাক ভৌমিকের সম্পাদনা বোধহয় তার জন্য দায়ী নয়। অভিনয়ে রাহুল-চূর্ণী-বরুণ চন্দ নিজের নিজের মতোই।
শাশ্বত যথারীতি ভাল করেছেন। কিন্তু চূর্ণী আর রাহুল, দু’জনের কাছ থেকেই আরও ভাল অভিনয় আশা করা যায়। এই গল্পাংশটাই অন্য পর্বগুলোর সঙ্গে তেমন জোড় খায়নি। আবার নিজের পায়ে দাঁড়াতেও পারেনি!
তার আগে রাহুল-কৌশিক অংশটা কিন্তু ভাল লাগছিল। রাহুলের বিবাহবিচ্ছিন্নতা, নিঃসঙ্গতার দিকটা বোধগম্য ছিল। বৃদ্ধ কর্মচারীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটাও বেশ লাগছিল। কিন্তু শাশ্বতদের সংসারে হানা দেওয়ার ‘মোটিফ’টা যথেষ্ট জোরালো হয়ে উঠতে পারল না! চূর্ণীও (ক্লিনিকের প্রতি তাঁর যতই কৃতজ্ঞতা থাক) রাহুলের প্রতি অতটা বন্ধুবৎসল হয়ে উঠলেন কেন, বোঝা গেল না! টি এস্টেটের পটভূমিও (আউটডোরের ব্যবহার তো কমই) খুব কোনও নাটকীয় মাত্রা যোগ করল না! শেষ দৃশ্যটা আলাদা করে ব্যঞ্জনাময় হওয়া সত্ত্বেও প্রত্যাশিত অভিঘাতে পৌঁছল না।
কিন্তু ওই যে কৌশিক আর অনন্যা! শেষ পর্যন্ত সব কিছু ছাপিয়ে জেগে থাকে ওই দু’টি মুখ! মস্তিষ্কের মেমরি-কার্ডেও কন্ট্রোল এস, ‘সেভ’ আছে তো! টাইপরাইটারের খটাখট পেরিয়ে আদ্যিকালের রেডিও গেয়ে চলে,
আলোকের এই ঝর্নাধারায় ধুইয়ে দাও...


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.