রয়্যাল বেঙ্গল ফ্যাশন
জ আবার অনেকগুলো দিন পর। ওর আয়নাটাও যেন মৃদু অনুযোগ জানাল, এমনটা মাঝেমধ্যেই সাজো না কেন? ও ভাবল, দেখো তো। ‘ফ্যাশন’, ‘কমফর্ট’ ইত্যাদি ইংরেজি শব্দকে অজুহাত বানিয়ে ভিনদেশি পোশাক পরে দিনরাত কাটাই। আর বিশেষ বিশেষ দিনে, যখনই শখ করে বাঙালি সাজি, তখনই! কী জাদু আছে এই বাংলা সাজে? উত্তর এল না। তবে ভাবনার সুতো ধরে, অতীত থেকে উড়ে এল অনেক অনেক ছবি। বঙ্গজ তন্তুজালের আলোয় চারধারে রোশনাই, তখনকার সব সাবেকি বাংলা পোশাক। জোব্বা, উত্তরীয় বা উড়ানি, চায়নাকোট, কুসুমকবরী, মুঠোর মধ্যে ধরে যাওয়া একটা আস্ত ঢাকাই মসলিন শাড়ি, জ্ঞানদানন্দিনীর শাড়ি বিপ্লব এবং আরও আরও।
পোশাক: সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়
অনেক কিছু হয়তো একেবারেই হারিয়ে গেছে। যেমন নয়ানসুখ, সূক্ষ্ম ‘পায়নাপল’ কাপড়ের শাড়ি। ধূপছায়া, মরচেনীল, এমনই আশ্চর্য রং হত তাদের। তবে বুটিক বা ডিজাইনার স্টুডিয়োগুলোয় এখনও রেশম আর তাঁতের ঐতিহ্যবাহী শাড়িগুলি সহজেই মেলে, কোনওটায় প্রাচীন গরিমা অক্ষুণ্ণ, কোনওটায় মূল কাপড়টির ওপর নতুন সময়ের বর্ণিল নকশা মুদ্রিত। সে সময় তো নাকি অবস্থাপন্ন ঘরে কয়েক দিন অন্তরই শাড়িজামার পসরা নিয়ে হাজির হতেন তাঁতিনি। তাতে থাকত ঘরে পরার ফরাসডাঙা, বেগমবাহার, বাগেরহাট, মিহি তাঁতের নীলাম্বরী ইত্যাদি শাড়ি। যাঁদের স্বামী-সন্তান সু-উপার্জক তাঁরা কিনতেন গঙ্গাসাগর, লক্ষ্মীভিলা, সিলেটি বা গাঙ্গোরী। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পোশাকের নামজুড়ে থাকত উৎস গ্রামের পরিচয়। বৃষ্টির দিনে পরার জন্য থাকত মুগা, মেঘডুমুর, বিষ্ণুপুরী সিল্ক। বাঙালিনীরা বসন্তসন্ধ্যায় পরতেন কালো পাড় আসমানি রং মিহি শাড়ি। খোঁপায় আশ্চর্য ভঙ্গিতে জড়াতেন বেলফুলের মালা, তাতে পিন করে আটকাতেন জর্জেটের চেলি বা ওড়না। কুসুমনন্দিতার হাতে থাকত মাধবীলতা ফুল গেঁথে তৈরি কাঁকন, গলায় মাধবীমালা। আর কানে কানপাশা বা ঝুমকোর মতো করে পরতেন এক গুচ্ছ মাধবীফুল। অন্তঃপুরিকারা পরতেন লাল পাড় সাদা ঢাকাই বা স্বচ্ছ মসলিন কাপড়। কিংবা সোনালি পাড়ের অতি সূক্ষ্ম বেনারসি। এ সব শাড়ি এতই মিহি যে এই আর্যনারীদের চন্দনগাত্রবর্ণের সঙ্গে একেবারে মিশে যেত। ফলে পোশাক পরা না পরা সমান। সে ভাবে বাইরের লোকের সামনে বেরোনো যায় না। এই কারণেই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উৎসাহে তাঁর স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ও বোন স্বর্ণকুমারী বোম্বাই-দস্তুর শাড়ি পরা শুরু করেন। সঙ্গে কাপড় টুকরো জুড়ে তৈরি জ্যাকেট ও পাতলা সেমিজ। মেমেদের মতো ভারী নয়। তবে বেশ নকশাদার লেস বসানো, পার্সি পাড় সাজানো বারো আনা হাতের (থ্রি কোয়ার্টার্স স্লিভস) জ্যাকেট। তার সঙ্গে শাড়িটিও কায়দা করে পরা। কোমরে কুঁচি করে, পিছন দিয়ে ঘুরিয়ে এনে, আঁচল অংশ সুন্দর করে ভাঁজ করা বাঁ কাঁধের ওপর ফেলে রাখা। সেটা যাতে খসে না যায়, তার জন্য কাঁধের কাছে সুদৃশ্য ব্রোচ আটকানো। সঙ্গে পায়ে জুতোমোজা, ঘোমটার ওপরেই ছোট্ট টুপি, কপালের মুক্তোর টায়রা। পরে জ্যাকেটের বদলে পরা হত ফ্রিল বসানো ব্লাউজ।
মধ্যিখানের একটি প্রসঙ্গ বাদ গেল। মধ্যযুগের ইলিয়াস শাহী, হোসেন শাহী আমলে বঙ্গভূমিতে, বিশেষত মুসলমানিনীদের মধ্যে ফুলকাটা কামিজ, পেশোয়াজ ঘাগরা ও সেলাই করা চাপা পাজামা পরার একটা রীতি ছিল। কালক্রমে বঙ্গনর্তকীদের মধ্যেই এই পোশাক সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। পরে মেশে মুঘল প্রভাবও। সঙ্গে কেয়ূর, কঙ্কণ, কিঙ্কিণী, রুপোর প্যাঁয়জোর প্রভৃতি রিনিঝিনি অলঙ্কার। উত্তরীয় পরবার একটা বাঙালি অভ্যাস তো ছিলই, তাই দোপাট্টা বা ওড়নাকে সহজেই আপন করে নেওয়া গিয়েছিল। এ সবই শাড়ির দাপট ও মাহাত্ম্যের সঙ্গে তুলনায় কিঞ্চিৎ প্রান্তিক, কিন্তু অতি মনোহর।
পোশাক: শর্বরী দত্ত
পুরুষ পোশাকেই এই মুঘল সাজ বেশি প্রভাব ফেলেছিল। আংরাখা, পাঞ্জাবি বা বাঙালি ফতুয়ার সঙ্গে কোঁচানো ধুতির বদলে অনেকেই পরতেন পাতলা সুতির পাজামা। কোনওটা চুড়ি পা, কোনওটা বেশি ঢলা। এ সব পোশাক বুনে দিতেন বাড়ির মেয়েরাই। পাঞ্জাবি শালওয়ালা আনত রেশমি ছিট কাপড়, জরি, কিংখাব, মলমল, লখনউ চিকন। সে সব সেলাই করে তৈরি হত জমিদারি চোগা, চাপকান, পাগড়ি। কাঁধে পাটপাট করে রাখার উত্তরীয়। বিলাসী বাবু সম্প্রদায়ের একচেটিয়া ছিল কালোপেড়ে ধুতি, মসলিনের গিলে করা আদ্দির পাঞ্জাবি। গলায় বিনুনি করা কাপড়ের উড়ানি বা গলবস্ত্র। পায়ে চিনে জুতো। অনেক সময় ধুতির পাড়ে লেখা থাকত কবিতার পংক্তি বা বিশেষ কোনও ব্যক্তির উদ্দেশ্যে প্রশস্তি। বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়ার পর লেখা হয়েছিল ‘বেঁচে থাকুন বিদ্যেসাগর চিরজীবী হয়ে’।
এই সব পোশাক ‘ফিউশন’ করে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালির একটি সর্বজনীন পোশাক তৈরির পরিকল্পনা করেছিলেন। পাজামার ওপরই এক টুকরো কাপড় ধুতির মতো কুঁচি করে পরেছিলেন। মাথায় চাপিয়েছিলেন পাগড়ি আর টুপির মাঝামাঝি একটি বস্তু। তাঁকে দেখতে রাস্তায় ভিড় জমে গিয়েছিল। কিন্তু সমাজের এক জনও তাঁকে অনুকরণ করতে সাহস করেননি।
জ্যোতি ঠাকুরের সেই বঙ্গপোশাক লুপ্ত। বাকিরা কিন্তু আজও আছে। তাদের নিয়েই তো র্যাম্পদুনিয়ায় হইচই। দুষ্প্রাপ্য নয় তবে। শুধু পয়লা বৈশাখেই ওদের স্বপ্নে দেখে লাভ? কালই আবার ১৫ এপ্রিল, কিন্তু বিশেষ দিন তো বিরল নয়। পরশু হয়তো দাদার বিয়ে, কয়েক মাস পর বাড়িতে ছোট্ট গেট টুগেদার, আর পুজো। তখনও কি এমন ইতিহাস-সুন্দর হয়ে ওঠা খুব শক্ত?



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.