জেনারেশন এক্স হতে পারে! জেনারেশন ওয়াই হতে পারে! জেনারেশন এক্স-ওয়াই হতে পারে!
শুক্রবার রাতের ইডেনে উপস্থিত গরিষ্ঠ দর্শকমণ্ডলীকে যে নামেই ডাকা হোক, তারা উনিশশো নব্বইয়ের সেই মারকাটারি দুপুরে অবশ্যই বোধবুদ্ধি আসার মতো বয়সে পৌঁছয়নি। অথবা এই পৃথিবীতেই আসেনি। যে গ্রহে গঙ্গার ধারে অবস্থিত ক্রিকেটের সবচেয়ে বিখ্যাত মাঠে সেদিন রাহুল শরদ দ্রাবিড় নামক এক লাজুক তরুণ প্রতিভা রঞ্জি ট্রফিতে জমকালো সেঞ্চুরি করে বাংলাকে বিপদে ফেলে দিয়েছিল। বাংলার ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা তখনই সেই সেঞ্চুরির মধ্যে সুদূরের সম্ভাবনা দেখেছিলেন। সোজা সোজা খেলা। অনন্ত ধৈর্য। প্রখর টেকনিক। আর বিশ্বনাথ সদৃশ স্কোয়ার কাট।
ইডেনে সেই সেঞ্চুরি রাহুল দ্রাবিড়ের প্রাথমিক জীবনে নিজেকে নজরে পড়ানোর খুব গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বরাবর স্থাপিত থেকেছে। তাঁর ভারতীয় দলে ঢুকতে লেগেছিল আরও ছ’বছর। কিন্তু ক্রিকেটীয় প্রেক্ষিতে ওটাই ছিল কর্নাটকীর যাত্রা হল শুরু। শুরু---দ্রাবিড় আর ইডেনের আবেগঘন সম্পর্কের। যা লক্ষ্মণ বা আজহারের মতো সর্বজনবিদিত আর বহুচর্চিত হয়ে হোর্ডিংয়ে বিজ্ঞাপিত নয়। তা ব’লে নিওন আলোর রোমান্টিসিজম তাকে কখনও ত্যাগ করেনি। অনুচ্চারিত অথচ প্রবল এই যেন তার বরাবরের রিংটোন। ক্লাবহাউসের বাইরে ইডেনের পাঁচ অমর মুহূর্তের অন্যতম সেনানী হিসেবে আছেন বলেই নয়। ইডেন পিচ বরাবর দ্রাবিড়কে সম্পদশালী রেখেছে। এমনকী দিয়েছে একই টেস্টে দুই ইনিংসে লড়ুয়ে সেঞ্চুরি। |
বাইশ বছর পর চৈত্রের শেষ দিনে পৌঁছে সেই সম্পর্ক খসে গেল ঝরা পাতার মতো। কেন? যত দূর জানা যায়, এটাই দ্রাবিড়ের শেষ আইপিএল। জীবনে চমকপ্রদ কিছু আবির্ভূত না হলে পরের মরসুমে কুড়ি ওভারের ফর্ম্যাটে আর তিনি নেই। বাকি ফর্ম্যাটগুলো থেকে তো আগেই বিদায় নেওয়া হয়ে গিয়েছে।
যাঁর টেকনিক ক্রিকেট পুরোহিতের নির্ভুল সংস্কৃত শ্লোক উচ্চারণ সদৃশ। যাঁর ঝোড়ো মাস্তুল সামাল দেওয়াই বরাবরের অহঙ্কার। তিনি ইডেনের সঙ্গে শেষ সাক্ষাতে কোন রূপে আবির্ভূত হলেন? কোন পৃথিবীতেই বা নতুন ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে নেমেছিলেন? প্রথম ওভারে তাঁর একটা স্কোয়ার কাট আছড়ে পড়ল নাইটদের বক্সের কাছাকাছি। প্রেসবক্সে তখনই সহ-সাংবাদিকের কাছে নিউইয়র্ক থেকে তাঁর বোনের বিবিএম এল, দেখে নে, এই স্কোয়ার কাট তো ইডেনে আর দেখতে পাবি না। হয়তো বা ইঙ্গিত পাওয়া গেল ইডেনের শুক্রবারের দর্শক যতই সেন্টিমেন্টহীন আধুনিক প্রজন্ম হোক। দ্রাবিড়ের জন্য ইডেনের বাইরেও আজ প্রচুর ইডেন দর্শক। তারা অন্তত আবেগে ভরপুর হয়ে শেষ বিদায় প্রত্যক্ষ করছে।
স্কোয়ার কাটটা যদি পুরনো পৃথিবী হয়। জেনারেশন এক্স-ওয়াই আবির্ভূত হল খুব দ্রুত। যখন ওই ওভারেই অফ স্টাম্পের বাইরের বলকে আড়াআড়ি মিড-অন দিয়ে খেললেন দ্রাবিড়। চরম দুর্দিন এবং দুঃস্বপ্নেও প্রথম ওভারে আড়াআড়ি খেলবেন না। কিন্তু এটা যে আদৌ দ্রাবিড় সভ্যতাই নয়। দ্রাবিড় সংস্কৃতিও নয়। যেখানে কালিসকে তাঁর স্টেপ আউট করে মারা তীব্র চারের পর ‘হাল্লাবোল, হাল্লাবোল’ বলে চিৎকার শুরু হল। যাঁর ক্রিকেটের মূলমন্ত্র হল নিরুচ্চার স্থিতিপ্রদান, তাঁর বাকি তিনটে বাউন্ডারি সংবর্ধিত হল কখনও ‘উ লা লা’, কখনও ‘ছম্মকছাল্লো’ দিয়ে। টসের সময় সুনীল গাওস্করের কাছে দ্রাবিড় স্বীকারও করলেন নিজের টি-টোয়েন্টি ইনিংসের হাইলাইট টিভিতে দেখার অভ্যেস তাঁর নেই। |
ভাগ্যিস নেই। কারণ, রাজস্থান রয়্যালসের ওপেনার হিসেবে অনভিজ্ঞ দল নিয়ে তাঁর গোটা প্রজেক্টই হল নিজের পুরনো পৃথিবীকে ধ্বংস করে নতুন পৃথিবীর যোগ্য হওয়ার চেষ্টা করা। ২৮ বলে ২৭ করে ফিরে গেলেন যার মধ্যে পাঁচটা বাউন্ডারি। পারফরম্যান্সের মাপে বৈশাখীর উচ্ছ্বাস নেই, বরঞ্চ চৈত্রের বিষণ্ণতা। সাকিবকে ইনসাইড-আউট মারার জন্য জায়গা করতে গিয়ে প্রায় নিজেকে টিপ করে এক্সট্রা কভারের হাতে তুলে দিলেন দ্রাবিড়। শট নেওয়ার ধরনে সেই অধৈর্য তাড়াহুড়ো, যা থেকে জীবনভর নিজের ক্রিকেটকে বিচ্ছিন্ন রাখতে পেরেছেন। চৈত্র শেষের সেলের মতো বাজারি ড্রাইভে দ্রাবিড় যখন নাইটদের উল্লসিত করে দিয়েছেন। আর নিজে প্রবল অশান্তিতে প্রায় মাথা খুঁড়ছেন, তখন ইডেনের আধুনিক দর্শকেরাও নাইটদের উইকেটপ্রাপ্তিতে ব্যস্ত। বয়েই গেছে তাদের উঠে দাঁড়িয়ে রাহুল দ্রাবিড় নামক এক মহীরুহকে বিদায় অভিবাদন জানাতে।
দ্রাবিড় অবশ্য মনেও হল না অভিবাদনের কোনও প্রত্যাশা করেছিলেন বলে। মর্মান্তিক একটা হতাশায় যে তখন তিনি আক্রান্ত। অধিনায়ক হিসেবে যেখানে দল তাঁর উপর সবচেয়ে বেশি ভরসা করে রয়েছে, সেখানে স্ট্রোক খেলায় এমন মারাত্মক বিচ্যুতি হবে কেন তাঁর? উইকেট থেকে প্যাভিলিয়নের সামনে অবধি চল্লিশ গজী রাস্তা নিজেকে অভিসম্পাত দিতে দিতে ফিরলেন। ইডেন আর শেষ বিদায় তখন আর মাথায় খেলছিল বলে মনে হয়নি।
কাহিনির সারমর্ম: পৃথিবী বদলায়। দর্শক বদলায়। মহীরুহের মনোভাব থেকে যায় সেই একই রকম! |