ভিক্ষের টাকায় ভবঘুরেদের নিয়ে ‘সংসার’ চলে রূপালির
প্ল্যাটফর্মের টিকিট কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে কাতর কণ্ঠে ‘দু’টো পয়সা ভিক্ষে’ চাইছিলেন বছর বত্রিশের যুবতী। বলছিলেন, ‘‘ক’দিন খাওয়া হয় না।’’
১ টাকা, ২ টাকা, ৫ টাকার কয়েন জমছিল তাঁর হাতে। মাঝে মাঝে গুণে দেখছিলেন ‘সঞ্চয়ের’ বহর। ঘণ্টা খানেক কাটল এ ভাবেই। তত ক্ষণে রূপালি সরকারের হাতে গোটা কুড়ি টাকা জমে গিয়েছে। হাসি ফুটল মুখে। দুপুরে খাওয়ার একটা হিল্লে হল বুঝি! স্টেশনের পাশেই মুড়ির দোকানে চলে গেলেন রূপালি। দু’টো তিনটে প্যাকেটে মুড়ি নিলেন। তেলেভাজার দোকান থেকে কয়েকটা চপ।
ফের চলে এলেন বাগনান স্টেশনের ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে। এ বার তা হলে খাওয়া-দাওয়ার পালা। তা তো বটেই। তবে নিজের নয়। স্টেশনে কয়েক জন ভবঘুরেকে ডাক দিলেন রূপালি। তাঁদের হাতে তুলে দিলেন মুড়ি-তেলেভাজার প্যাকেট। টিকিট কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন আবার। বলতে শুরু করলেন, “দু’টো পয়সা ভিক্ষে দেবেন, ক’দিন খাওয়া জোটেনি....।”
বাগনান স্টেশনে ভবঘুরেদের ‘সেবায়’ রূপালি। ছবি: রমাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়
প্ল্যাটফর্মে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ভবঘুরেদের খাওয়ানো-দাওয়ানোর ‘দায়িত্ব’ নিয়ে ফেলেছেন রূপালি। পরম মমতায়, আন্তরিকতায় চালচুলোহীন এই মানুষগুলোকে নিয়ে গড়ে উঠেছে রূপালির ‘ভবঘুরে-সংসার।’ কখনও মুড়ি-তেলেভাজা, কখনও ভাত-ডাল-মাছ-তরকারি টানাটানির ‘সংসারে’ চার বেলা মেনুর বহর কম নয়।
প্ল্যাটফর্মে বসে ছিলেন এক ভবঘুরে। নাম বললেন রঞ্জিত সাঁতরা। বছর ষাটের মানুষটি অপেক্ষা করছিলেন রূপালির জন্য। তিনি এসে বৃদ্ধের কোঁচড়ে ঢেলে দিলেন মুড়ি, কলাই সিদ্ধ, গরম আলুর চপ। রঞ্জিত বললেন, “আমি ওকে বোন বলেছি। তাই আমাকে খেতে দিয়েছে। বেশ করেছি খাচ্ছি।” বৃদ্ধা মঞ্জু ধাড়ার কোঁচরেও মুড়ির ঠোঙা রাখলেন রূপালি। জিজ্ঞাসা করলেন, “দুপুরে পেট ভরে খেয়েছিলি তো!” মঞ্জুর উত্তর, “পোস্তর তরকারিটা যা হয়েছিল না!”
রূপালি নিজের অতীত নিয়ে বেশি কিছু বলতে চান না। তবে বাগনান থানার পুলিশ আধিকারিকদের অনেকেই জানেন তাঁর ‘বৃত্তান্ত’। তাঁদেরই এক জন বললেন, “ওঁর বাড়ি শ্যামপুরের কমলপুর পঞ্চায়েত এলাকার দক্ষিণ-দুর্গাপুর গ্রামে। বাবা-মা মারা যাওয়ার পরে পারিবারিক কোনও কারণে মানসিক আঘাত পেয়ে তিনি ঘর ছেড়ে এসে স্টেশনে ঠাঁই নিয়েছেন।” দক্ষিণ-দুর্গাপুর গ্রামে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, স্থানীয় একটি হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেছিলেন রূপালি। এখন গ্রামে রূপালির আত্মীয়েরা কেউই থাকেন না।
রূপালি বলেন, “আমি বড় বংশের মেয়ে। লেখাপড়াও শিখেছি। আমার ঘনিষ্ঠরাই আমাকে বঞ্চিত করেছে। কিন্তু এখন আমি সব ভুলতে চাই। আমার ঠিকানা প্ল্যাটফর্ম। এখানেই কাউন্টারের সামনে ছেঁড়া কাঁথা পেতে শুয়ে থাকি। সঙ্গী শুধু ভবঘুরেরাই। এদের কষ্ট দেখলে থাকতে পারি না। আমি ছাড়া ওদের কে দেখবে? বেচারারা না-খেয়ে মরবে।”
প্ল্যাটফর্মেই মুড়ির দোকান আছে রঞ্জিত গুছাইতের। বললেন, “আমার কাছ থেকে দিনে বেশ কয়েক প্যাকেট মুড়ি কেনেন ওই মহিলা। একটি পয়সাও কখনও কম দেন না।” স্টেশনে কুলিদের নিয়ে সংগঠন করেন আক্তার আলি। তিনি বলেন, “দীর্ঘ দিন ধরে দেখছি। মেয়েটি কত জনকে যে খাওয়াল। এক মিনিট বসে থাকে না। ভিক্ষা করে যা জোগাড় হল তা দিয়ে খাবার কিনে এনে খুঁজতে থাকে কোথায় ভবঘুরে বসে আছে।”
রূপালি জানান, ভিক্ষা করে দিনে দু’তিনশো টাকা পাই। তা থেকেই ‘সংসারে’র অন্নসংস্থান। ভবঘুরেদের জন্য শীতবস্ত্রের ব্যবস্থাও করেন তিনি। যুবতী জানালেন, “আমি গাইতে পারি। নাচ-ও জানি। পীরের মেলায় গজল গাই। ভক্তরা বেশি করে টাকা দেয়। হিন্দু বাড়িতে রবীন্দ্রসঙ্গীতও গাই। নাচি। ভালই ভিক্ষা মেলে।” না চাইলেও কথার ফাঁকে অতীতে ফিরে যান রূপালি। বলেন, “মাকে দেখেছি খাবারের গ্রাস মুখে তুলছেন, এমন সময় হয়তো কেউ এসে খাবার চাইল। উনি নিজের ভাত তাঁকে দিয়ে দিতেন।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.