চিত্রকলা ও ভাস্কর্য...
প্রকৃতিসত্তায় দেবী কখনও মানবীও হয়ে ওঠে
সিমা গ্যালারিতে ‘অ্যান অলটারনেটিভ পার্সপেক্টিভ’ বা ‘বিকল্প প্রেক্ষাপট’ শিরোনামে এখন যে প্রদর্শনী চলছে তাতে অংশগ্রহণ করেছেন পাঁচ জন মহিলা শিল্পী অঞ্জু চৌধুরী, রিনি ধূমল, জয়শ্রী বর্মন, রশমি বাগচি সরকার ও শাকিলা। তাঁদের প্রত্যেকের ছবিতে নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি ও ভাবনার মধ্যেও একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য কাজ করেছে। তা হল প্রকৃতির অনুরণন। এবং সেটাই প্রদর্শনীটিকে এক সুরে বাঁধার চেষ্টা করেছে। প্রত্যেকেই যে প্রত্যক্ষত নিসর্গদৃশ্য এঁকেছেন তা নয়। প্রকৃতি ও জীবন মিশে আছে সকলের কাজেই। জীবন ও প্রকৃতির পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বা দ্বান্দ্বিক সম্পর্কই বলা যেতে পারে এই প্রদর্শনীর মুখ্য উপজীব্য। এই দ্বান্দ্বিকতার যে জীবনসম্পৃক্ত প্রেক্ষাপট, সেটা পুরুষশিল্পীর প্রকাশভঙ্গিতে এক ভাবে অভিব্যক্ত হয়। নারীর ক্ষেত্রে ঠিক সে রকম না হওয়াই স্বাভাবিক। বিকল্পের সম্ভাবনা থাকে সেখানে। দেখার ও প্রকাশের পাঁচটি বিকল্প ধরন আমরা পাই এখানে। সেটা কারোও ক্ষেত্রে জীবনকে নন্দিত করেছে। কেউ বা প্রশ্ন তুলেছেন। বিপন্ন ট্র্যাজিক চেতনাকে তুলে আনতে চেষ্টা করেছেন।
অঞ্জু, রিনি ও জয়শ্রীর ছবিকে বলা যায় প্রথম পর্যায়ের অন্তর্গত। ছবি ছাড়া জয়শ্রীর ভাস্কর্যও রয়েছে। বাকি দু’জন, রশমি ও শাকিলার ছবিতে প্রকৃতি প্রত্যক্ষ ভাবে উপস্থিত হলেও মানবিক সম্পর্কের দ্বান্দ্বিকতায় তা নিঃসীম তমসার আভাস আনে।
প্রদর্শনীর একটি ছবি
এই প্রদর্শনীর প্রবীণতমা শিল্পী অঞ্জু চৌধুরী। তেলরং ও অ্যাক্রিলিকে আঁকা তাঁর ১৮টি ক্যানভাসেরই মূল বিষয় নিসর্গ। কিন্তু সেই নিসর্গ স্বাভাবিকতায় উপস্থাপিত নয়। তার অনুরণনটুকু মাত্র আছে। সেই অনুরণনকে বিমূর্ত অনুভব ও দৃশ্যমানতার দিকে নিয়ে গেছেন শিল্পী। ছাপচিত্রে তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা প্রতিটি ছবিতে সুরেলা বর্ণ-স্পন্দনের মধ্য দিয়ে অত্যন্ত সমৃদ্ধ ‘গ্র্যাফিক-কোয়ালিটি’ বৈশিষ্ট্য এনেছে, যা নৈর্ব্যক্তিক ভাবে হলেও প্রকৃতির আনন্দিত উদ্ভাসকে উন্মীলিত করে।
রিনি ধূমলের ১৮টি ছবির কেন্দ্রীয় বিষয় নারী। সেই মানবী প্রকৃতি-সম্পৃক্ত। কিন্তু সাম্প্রতিকের কোনও চরিত্র নয়। সে উঠে এসেছে পুরাণকল্প থেকে। প্রাক-ইতিহাসের ও আদিমতার অভিব্যক্তিকে আত্মস্থ করেছে। ঐতিহ্য-সম্পৃক্ত দেশজ রূপরীতির সঙ্গে সাযুজ্য রচনা করেছে। আদিমতার আঁধারলীন সংক্ষুব্ধতার সঙ্গে মানবিক উজ্জীবনের যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করেছে। এ ছাড়া বাকি ছবিতেও ছাপচিত্রীয় বুনোট ও অলঙ্করণের ঝংকারে প্রকৃতি-সম্পৃক্ত নারীর মগ্ন রহস্যের সন্ধান করেছেন।
ঐতিহ্য ও পুরাণকল্পের আলোকিত বর্ণময় বিস্তার থেকে প্রকৃতি-সম্পৃক্ত চিরন্তন নারীকে তুলে এনেছেন জয়শ্রী বর্মনও। তাঁর রচনায় রয়েছে এক সুরেলা আনন্দিত রূপকথার জগৎ। নব্য-ভারতীয় ঘরানার ঐতিহ্য সন্ধানের অত্যন্ত সফল এক উত্তরাধিকার অনুভব করা যায় তাঁর ছবিতে। ১৩টি জলরঙের ছবি ছাড়াও তাঁর ছিল চারটি বড় মাপের ব্রোঞ্জ-ভাস্কর্য। দেবী কেমন করে মানবী হয়ে ওঠে এবং মানবী বিস্তীর্ণ হয়ে যায় সমগ্র প্রকৃতির সত্তায় এই একাত্মতার আলেখ্য নির্মাণে অসামান্য প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন শিল্পী ছবি এবং ভাস্কর্যেও।
রশমির চারটি বড় মাপের চিত্রপটে যে প্রকৃতিকে আমরা দেখি, তা বিশ্বায়িত উত্তর-আধুনিক যুগের বিস্ফোরণোন্মুখ প্রকৃতি। তাঁর প্রকরণে অবশ্য রয়েছে প্রাচ্য-ঐতিহ্যকে ব্যবহারের প্রয়াস। জাপান থেকে শিখে আসা নিজ হাতে তৈরি প্রাকৃতিক বর্ণে তিনি এঁকেছেন এই ছবি। প্রকরণের ঐতিহ্য দিয়ে তিনি অভিব্যক্তির আধুনিকতাকে আঘাত করেছেন। যে ভয়ঙ্কর সর্বনাশের পথে যাচ্ছে আজকের সভ্যতা তারই আভাস ধরা থাকে ‘আরবান এক্সপ্লোশন’ ছবিতে। এর মধ্যেই উজ্জীবনের সম্ভাবনার ইঙ্গিত খোঁজেন ‘আ প্রেয়ার ফর হোপ’ ছবিতে। তবু ‘আই সি আ ল্যান্ডস্কেপ’ মানবীর মুখে ছেয়ে থাকা তীব্র অন্ধকার নিরাকৃত হয় না।
চেতনা সন্তর্পণে ছেয়ে থাকে শাকিলার আপাত-রম্য ১৫টি কোলাজে। বর্ণের মাধুর্যে মোহময়। এর মধ্যেই কোথা থেকে এসে মৃত্যু হানা দেয়। হিংসা আর সন্ত্রাস গ্রামীণ জীবনের বর্ণিল লাবণ্যকে ছারখার করে দিচ্ছে। এই গ্রামীণ মানবী শিল্পী তাঁর নিষ্কলুষ সারল্য দিয়ে আজকের পরিবৃত সর্বনাশকে যে ভাবে অনুভব করেছেন, তারই অনুরণন এসেছে তাঁর প্রতিটি ছবিতে। হলুদ জমির প্রেক্ষাপটে নীল পাখিগুলি। হঠাৎ কোথা থেকে তির এসে বিদ্ধ করে তাদের। সূর্যাস্তের লালিমায় রাঙা ছড়ানো পাতার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে অজস্র হিংস্র সাপ। প্রকৃতি ও মানবীর দ্বন্দ্বাত্মক সহাবস্থানের এ রকমই পাঁচটি বিকল্প প্রেক্ষাপট সমৃদ্ধ করেছে প্রদর্শনীটিকে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.