তাঁর কবিতার মধ্যে জেগে আছে নিজস্ব আলো-আঁধার। আলো বলতে ভালবাসা। অন্ধকার?
স্পষ্ট জানান,
‘জীবনটাকে নানান জুয়ায় লগ্নি করে
জমার ঘরে শূন্য, কেবল চারদিকে ধার’।
কী করে বাঁচেন?
‘দিন কেটে যায় ‘কবিসুলভ’! রাত
দাঁতের ফাঁকে মাংস খুঁটে খায়,
পাড়ার মোড়ে অজানা সংঘাত
চপার, চাকু মেশিনে চমকায়!’
কালবেলায় বেঁচে থাকার বিচিত্র সন্ত্রাস সহ্য করেন তিনি, কারণ কোথাও সান্ত্বনা থাকে কিছু।
‘কাঁচের ও পারে বৃষ্টি। ওই, ওই যে শোনো
এখনও বাঁচার শব্দ কুষ্ঠরোগীদের হাসি, গান!’
এই কবি, পিনাকী ঠাকুর, বাংলা কবিতায় নিয়ে এসেছেন নিজস্ব একটি মফস্সলি বৃত্তান্ত। তার সঙ্গে টুকরো টুকরো মিশেছে মেট্রোপোলিস। সমকালের সঙ্গে মিশেছে ইতিহাস। ঐতিহ্য আর কৌতুক হাত ধরেছে পরস্পরের। কাব্যভাষায় স্থান, কাল ও পাত্রের এই আশ্চর্য রসায়নের উদ্দেশেই নিবেদিত হল বঙ্গাব্দ ১৪১৮-র আনন্দ পুরস্কার। পুরস্কৃত কাব্যগ্রন্থের নাম ‘চুম্বনের ক্ষত’।
স্বল্পায়তন, কিন্তু গভীরসঞ্চারী এই গ্রন্থের শীর্ষনাম থেকেই স্পষ্ট, একটি বিপরীতের ভিতরে বাস করেন কবি। সেই বসবাসের গায়ে লেগে আছে লোকাল ট্রেনের শিস, ভিড়ের জমাট ঘাম, প্রেমহীনতার শোক এবং গভীর কিছু প্রত্যয়।
পিনাকী ঠাকুর |
‘আজ মন খারাপ খুলে রেখে, মেঘ খুলে রেখে আমরাও
জন্মদিনের জামা পরব! তুমি এসো...’
কে আসবে? এমন নিবিড় সর্বনামে কাকে আহ্বান করেন কবি?
পিনাকী ঠাকুরের চশমার কাচে গড়িয়াহাটের উড়ালপুলের ছায়া। নিবাস হুগলি জেলার বাঁশবেড়িয়া, কিন্তু নিয়মিতই মহানগরে আগমন। ফিরে যাওয়া রাতের নিঝুম ট্রেনে। সেই আসা-যাওয়ার পথের ধারেই তাঁর জেগে থাকা। কবিতা নিয়ে। ‘কখনও ভাবিনি, কবিতা লিখে এ রকম কোনও পুরস্কার পাব। পেয়ে ভাল লাগছে, বিস্মিতও লাগছে। স্মৃতিরা ফিরে আসছে, ক্রমাগত।’ প্রাথমিক প্রতিক্রিয়াটুকু এমনই। অতঃপর, সেই সব স্মৃতিই পরতে পরতে খুলে আসে। বাড়ির ছাদে ঘাতকের দল খুন করছে তাঁর বাবাকে। আদর্শবাদী ভদ্রলোকের চাকরি ছিল সাহাগঞ্জের ডানলপ কারখানায়, রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন, কিশোর পুত্রের জন্য রেখে গেলেন অস্থির সময় আর কবিতার প্রতি ভালবাসা। সংসার বিশেষ সচ্ছল ছিল না, কিন্তু সেই কিশোরের মুক্তি ছিল ভাষায়। মুদ্রিত অক্ষরে।
পিনাকী হাসলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ তো ছিলেনই, শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো। ছোটবেলায় এক বার কবিতা বলতে গিয়ে তৃতীয় পুরস্কার পেলাম ‘বনলতা সেন’। কতটুকু বুঝেছিলাম বলা কঠিন, কিন্তু কবিতা আমার সামনে একেবারে অন্য শরীর নিয়ে দাঁড়াল।’
আবার, যৌবনের প্রারম্ভে যখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতাসমগ্র হাতে এল, তখন পিনাকী ঠাকুরের সামনে আচমকা জ্যান্ত হয়ে উঠল সমকাল, জেগে উঠল সময়ের দাহ এবং সংরাগ। ‘তারপর ‘দেশ’ পত্রিকায় কবিতা পাঠালাম, উনিশশো উনআশি, ছাপাও হল। ডাকেই পাঠাতাম। কিছুকাল পরে একবার সুনীলদার একটা চিঠি পেয়ে বুক ঠুকে চলেও গেলাম দেশ-এর দফতরে। কিন্তু, সুনীলদার ঘরের দরজা পর্যন্ত গিয়েও আর ঢুকিনি। সত্যিই তো, দেখা করে কী বলব ওঁকে!’
এ রকমই পিনাকী ঠাকুর। ভালবাসেন আড়াল, চূড়ান্ত মৃদুভাষী, যদিও একটি বিষয়ে তাঁর খুব দৃঢ় আপত্তি আছে।
যে কাজে মনের সায় নেই, সে কাজ তাঁর নয়। মাঝে বেশ কিছু বছর কবিতা থেকে সরে ছিলেন। ফিরে এলেন, নব্বইয়ের দশকে, মনের টানেই।
ডানলপ-এ চাকরি করতে করতে কর্তৃপক্ষের সৌজন্যে ইঞ্জিনিয়ারিং-এর একটি উচ্চতর কোর্স করার সুযোগ এসেছিল। প্রচুর পড়াশোনা করে তার প্রথম ধাপটি পেরোলেন।
আর মাত্র একটিই ধাপ ছিল, কর্পোরেট-এর হাতছানি ছিল, কিন্তু তিনি বেছে নিলেন কবিতা। পিনাকী লাজুক ভাবে হাসেন, ঊননব্বই-নব্বই নাগাদ চাকরি ছেড়ে দিলাম, পরিপূর্ণ বেকার। জীবন ফের একটা বাঁকের মুখে এসে পড়ল।’
শুরু হল তাঁর কবিতাযাপন। সেই ধারাটি এখনও চলেছে। সুতরাং, মাইকেল মধুসূদন থেকে শুরু করে হালের তরুণতম কবিটিও তাঁর বেঁচে থাকার সঙ্গী। প্রথম কবিতা ছাপা হয়েছিল উশীনর পত্রিকায়, ১৯৭৪-এ, এলোমেলো দিনলিপি থেকে বেছে নিয়ে বন্ধুরাই প্রকাশ করেছিলেন। আজও, কবিতার কাছে, বন্ধুত্বের কাছে নতজানু এই কবি। স্মৃতি অবিন্যস্ত হয়নি। জীবনের নানা ওঠাপড়া সত্ত্বেও তিনি বজায় রেখেছেন বিচিত্র এক মিশেল সংরক্ত গীতিকবিতা এবং দ্যুতিমান শ্লেষ। সেই যুগল আলোই জেগে থাকে তাঁর কবিতায়।
মেধা এবং হৃদয়ের পদচিহ্নকে একই অঙ্গে ধারণ করা কবির বিচিত্র পরীক্ষা। কঠিনতমও বটে। সেই ছক-ভাঙা আগুনে বারংবার হাত রাখেন তিনি। নিজেকেই দেখেন হয়তো, কবিতার ও পার থেকে। নিজের মধ্যে ভেসে ওঠে সময় আর সমাজ। জেগে ওঠে খালপাড়ে রাত, উচ্ছেদের হুমকি, সর্বস্বান্ত শ্রমিক, বৃদ্ধ বাস্তুসাপ, সম্মোহন, মাসাজ পার্লার, অপহরণ, অর্কুট, নেট-ব্যাংকিং... ‘আমাকে এদের যে কোনও একটা নাম ধরে ডাকো আজ’, জানিয়ে দেন কবি।
এই বহুকৌণিক অস্তিত্বই পিনাকী ঠাকুরের কাব্য-অভিজ্ঞান। তারই স্বীকৃতি রইল বঙ্গাব্দ ১৪১৮-র আনন্দ সম্মানে। |