সেই ‘ঐতিহ্য’ই বজায় রইল!
বাম আমলে পুলিশের বদলি ও পদোন্নতির পিছনে মুখ্য হয়ে দেখা দিত ‘রাজনৈতিক’ কারণ। সেই ধারাই অব্যাহত রয়ে গেল ‘পরিবর্তনে’র জমানাতেও! যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলেন কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ দমন) দময়ন্তী সেন।
পুলিশ এস্টাব্লিশমেন্ট বোর্ড (পিইবি) মঙ্গলবার দময়ন্তী-সহ যে ৬০ জনের বদলি ও পদোন্নতির সুপারিশ করেছিল, বুধবার তাতে সই করেছেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সুপারিশ মতোই দময়ন্তীকে বদলি করা হয়েছে ব্যারাকপুরের ডিআইজি (ট্রেনিং) পদে। বদলির তালিকায় রয়েছেন বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার প্রণব কুমার এবং যাদবপুরের ডিসি বিশ্বরূপ ঘোষের নামও।
পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডে দময়ন্তীর ভূমিকা বহুল প্রচারিত। যেমন বহুল প্রচারিত মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ‘মতপার্থক্যে’র ঘটনাও। দময়ন্তীকে যে তাঁর পদ থেকে সরানো হবে, সে সম্পর্কে কার্যত তখনই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল পুলিশ-প্রশাসনের একাংশ। কিন্তু পার্ক স্ট্রিটের ঘটনার তদন্ত শেষ না-হওয়ার আগেই (ঘটনায় মূল অভিযুক্ত কাদের খান এখনও অধরা। চার্জশিটও পেশ করা হয়নি) যে তাঁকে নেহাতই ‘গুরুত্বহীন’ এক পদে বদলি করে দেওয়া হবে, তা তাঁদের কাছে খানিকটা অপ্রত্যাশিতই ছিল। বস্তুত, দময়ন্তীর বদলির ঘটনায় কলকাতা পুলিশের একাংশের মনোবল যথেষ্ট চিড় খাবে বলেই মনে করছে প্রশাসনিক মহলের বড় অংশ। |
ডিসি (সাউথ সুবার্বন) বিশ্বরূপকে বদলি করা হয়েছে রাজ্য সশস্ত্র পুলিশের দ্বিতীয় ব্যাটালিয়নের কম্যান্ড্যান্ট পদে। মাত্র সাত মাস আগে ডিসি (সাউথ সুবার্বন) হন বিশ্বরূপ। দক্ষিণ শহরতলির বিস্তীর্ণ অংশ কলকাতা পুলিশের এলাকাভুক্ত হওয়ার পরে ‘সাউথ সুবার্বন’ নামে ওই নতুন ডিভিশনটি তৈরি হয়। ফেব্রুয়ারির শেষে বামেদের ডাকা ভারত বন্ধের দিন গাঙ্গুলিবাগানে আনন্দবাজার পত্রিকা ও স্টার আনন্দের সাংবাদিকদের ‘নিগ্রহে’র দায়ে তাঁর রিপোর্টে অভিযুক্ত হয়েছিলেন কলকাতা পুলিশের কনস্টেবল তারক দাস। বিশ্বরূপের রিপোর্টের ভিত্তিতেই ওই কনস্টেবলকে সাসপেন্ড হতে হয়।
ঘটনাচক্রে, পার্ক স্ট্রিট এবং গাঙ্গুলিবাগান দু’টি ঘটনাকেই ‘সাজানো’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা। প্রথম ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের বিপরীত পথে হেঁটে দময়ন্তীর নেতৃত্বে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দারা ওই ঘটনায় তিন জনকে গ্রেফতার করেন। দময়ন্তী বলেন, “এটা সাজানো ঘটনা নয়। অভিযোগকারী মহিলা ধর্ষিত হয়েছিলেন।”
বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার প্রণব কুমারকে রাজ্য সশস্ত্র পুলিশের ষষ্ঠ ব্যাটালিয়নের কম্যান্ড্যান্ট পদে সরানো হয়েছে। ফেব্রুয়ারির শেষে বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এক মূক-বধির মহিলাকে ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত এক হাউসস্টাফকে ধরতে পুলিশ সুপার ‘সক্রিয়’ ভূমিকা নেন। ঘটনাটি নিয়ে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের (ঘটনাচক্রে, স্বাস্থ্য দফতরও মুখ্যমন্ত্রীর হাতেই) শীর্ষকর্তারা গোড়ায় ‘সংশয়’ প্রকাশ করলেও মহিলার অভিযোগ গ্রহণ করে দরকারি তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করেন এসপি। ‘নিরপেক্ষ’ ডাক্তারি পরীক্ষার স্বার্থে অভিযোগকারিণীকে কলকাতায় এসএসকেএম হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। এসপি-র উদ্যোগেই অভিযুক্ত হাউসস্টাফের ডাক্তারি পরীক্ষা হয় বিষ্ণুপুর মহকুমা অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়। অথচ বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজের প্রাথমিক তদন্তে ধর্ষণের ঘটনাটি আদৌ ঘটেনি বলেই বোঝানো হয়েছিল!
প্রত্যাশিত ভাবেই প্রশাসনের তরফে সমস্ত বদলিকেই ‘রুটিন’ বলা হয়েছে। কিন্তু ঘটনাপরম্পরা অন্য ‘ইঙ্গিত’ বহন করছে। তিনটি ঘটনাতেই পুলিশ-প্রশাসনের কাজের ‘সদিচ্ছা’ ধাক্কা খাবে বলে অভিমত প্রশাসনিক কর্তাদের একাংশের। তবে সরকারি পদে কর্মরত থাকায় তাঁরা যা বলতে পারেননি, তা খোলাখুলি বলেছেন রাজ্যের কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী। বহরমপুরের সাংসদের কথায়, “এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এই বার্তা দেওয়া হল যে, সরকারের তল্পিবাহক না-হলে মুশকিল আছে!”
প্রশাসনের প্রবীণ অফিসাররা এই ঘটনার সঙ্গে বাম-আমলের “তাৎপর্যপূর্ণ’ মিল লক্ষ করছেন। তথ্য বলছে, নদিয়ার ধানতলায় বিয়েবাড়ির বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনায় সিপিএমের এক নেতাকে গ্রেফতার করার ‘অপরাধে’ সিআইডি-র এক অফিসারকে এই ভাবেই বদলি করা হয়েছিল। বিশ্বভারতী থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পদক চুরির পর সিআইডি এক জনকে আটক করে। তার হাতের ছাপ পরীক্ষা করে আঙুলের ছাপ বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন, পদক যেখান থেকে খোয়া গিয়েছে, সেখানে যে হাতের ছাপ পাওয়া গিয়েছে, তার সঙ্গে ধৃতের হাতের ছাপের খানিকটা মিল থাকলেও থাকতে পারে। যা শুনে তদানীন্তন ডিজি বলেছিলেন, দ্রুত সংবাদমাধ্যমকে জানিয়ে দেওয়া হোক, চোর ধরা পড়েছে! তাতে আপত্তি তোলেন সিআইডি-র তদন্তকারী দলের এক পদস্থ অফিসার। তিনি জানান, অত ‘তাড়াহুড়ো’ না-করে আরও নিশ্চিত হয়ে তবেই ঘোষণা করা উচিত। নোবেল চুরির মতো ‘হাই-প্রোফাইল’ মামলায় রাজ্য সরকারকে তিনি ‘কৃতিত্ব’ দিতে ‘নারাজ’, এই অভিযোগে শাসকদলের ‘রোষানলে’ পড়েন ওই অফিসার। তাঁকে বদলি করা হয় তুলনায় ‘গুরুত্বহীন’ কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থায়।
সেই সূত্রেই বাম-আমলের প্রসঙ্গ আসছে দময়ন্তী-সহ তিন পুলিশ অফিসারের বদলির ঘটনায়। প্রশ্ন উঠছে, মুখ্যমন্ত্রী বা রাজ্য সরকারের অবস্থানের ‘বিরোধিতা’ করার ফলেই কি তাঁদের সরকারের (মুখ্যমন্ত্রীর) রোষানলে পড়তে হল? যেমন পড়তে হত বাম-আমলে? যখন পুলিশকর্তাদের বদলি-পদোন্নতি মূলত নির্ধারিত হত তৎকালীন দুই মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবাবু এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আপ্ত-সহায়কদের মতামতের ভিত্তিতে? সে তাঁরা কাজের ক্ষেত্রে যতই ‘পেশাদার’ হোন না কেন! অধীর যেমন বলেছেন, “বাম আমলে আমরা দেখেছি, কাজের যোগ্যতা নয়, বশ্যতাই ছিল আসল ব্যাপার। সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি দেখছি। কর্মতৎপরতা, যোগ্যতা দিয়ে বাংলার পুলিশ-প্রশাসনের মুখ উজ্জ্বল করে ছিলেন দময়ন্তী সেন। তিনি দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ। তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে বাঙালির মহিলা সমাজকেও অপমান করা হয়েছে।”
দময়ন্তীর বদলি জনমানসে ‘বিরূপ বার্তা’ দেবে বলে জানিয়েছেন সরকারের জোট শরিক কংগ্রেসের প্রদেশ সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যও। তাঁর কথায়, “সরকারি কর্মী বা পুলিশকর্মীদের বদলি করা হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডের তদন্তে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছিলেন দময়ন্তী। সেই তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই তাঁকে অন্যত্র বদলি করা হল। এই সিদ্ধান্তে অস্বাভাবিকতা রয়েছে। এতে মানুষের কাছে বিরূপ বার্তা পৌঁছবে।”
রাজ্যের বিজেপি নেতা তথাগত রায়ের কথায়, “মমতা আবার প্রমাণ করলেন, তিনি বাম-বিরোধী। বামফ্রন্ট-বিরোধী নন! যে কারণে এখনও বামফ্রন্ট সরকারের ঐতিহ্য সযত্নে রক্ষা করে চলছেন!”
প্রশাসনিক মহলের একাংশের অবশ্য বক্তব্য, দময়ন্তী ১৯৯৬ ব্যাচের আইপিএস অফিসার। তিনি দীর্ঘ ছ’বছর কলকাতা পুলিশে রয়েছেন। সে-দিক দিয়ে তাঁর বদলি ‘রুটিনমাফিক’ বলা যায়। তবে অন্য অংশের বক্তব্য, কলকাতা পুলিশে এক টানা বহু বছর থাকার দৃষ্টান্ত রয়েছে। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত পুলিশকর্তা সুজিত সরকার আশির দশকে আট-ন’বছরের বেশি এক টানা কলকাতা পুলিশে ছিলেন। অধুনা যুগ্ম কমিশনার (সদর) জাভেদ শামিম দময়ন্তীরও আগে থেকে লালবাজারে রয়েছেন। পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ডে জাভেদের ভূমিকা নিয়েও মুখ্যমন্ত্রী ‘সন্তুষ্ট’ নন। কিন্তু ইডেনে আইপিএল-এর জন্য তাঁকে সরানো হল না বলেই পুলিশের একাংশের ধারণা। তার পর জাভেদের উপরেও বদলির খাঁড়া নামবে বলেই খবর।
মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর মহাকরণের রোটান্ডায় কলকাতা ও রাজ্য পুলিশের পদস্থ অফিসারদের সঙ্গে প্রথম বৈঠকে মমতা বলেছিলেন, তিনি ‘প্রতিহিংসাপরায়ণ’ নন। বিরোধী থাকাকালীন যে সব পুলিশ অফিসার তাঁদের সঙ্গে ‘দুর্ব্যবহার’ করেছেন, তাঁদের প্রতি কোনও ‘প্রতিশোধ প্রবণতা’ নিয়ে তিনি রাজ্যের প্রধান প্রশাসকের চেয়ারে বসেননি। তাঁর সরকার ‘বদলা নয়, বদল চায়’। দশ মাস পর দময়ন্তীদের বদলির নির্দেশে প্রধান প্রশাসকের সিলমোহর দিয়ে মমতা প্রমাণ করলেন ‘ঐতিহ্য’ চিরকালীন। |