বাংলার লৌকিক উৎসবগুলোর মধ্যে অন্যতম গাজন। গ্রামবাংলায় এটিই শিবের গাজন বা আদ্যের গাজন বলে পরিচিত। কোনও কোনও অঞ্চলে একে নীলের গাজনও বলা হয়। নীল বলতে নীলকণ্ঠ বা শিব। উত্তরবঙ্গে বিশেষ করে মালদহ জেলায় এই গাজনই ‘গম্ভীরা’ নামে পরিচিত। গাজন মূলত সূর্যোৎসব। এটি পক্ষকাল স্থায়ী হয়। চৈত্র-সংক্রান্তির দিন সূর্যের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ‘আয়ন’ বা ‘যাত্রা’ শুরু হয়। সূর্য দ্বাদশ রাশির পরিক্রমা শেষ করে আবার পূর্ব পথে নতুন যাত্রার জন্য নতুন রাশিতে প্রবেশ করে। এই উপলক্ষেই গাজন। গাজনের শেষে শুরু হয় চড়ক। গাজনের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে সং। |
অভিনব কসরত দেখানোর খেলা। যেমন, দেহ তির দিয়ে বিদ্ধ করা, জিভ ফোঁড়া, শাল কাঁটার উপর ঝাঁপ দেওয়া অথবা কাঁটা গাছের ডালের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া, ফুল খেলা (জ্বলন্ত অঙ্গার হাতে নিয়ে ছোড়াছুড়ি), গণ্ডদেশ বিদ্ধ করা, আগুনের উপর দোল খাওয়া ইত্যাদি খেলায় দর্শকদের চমকে দেওয়া হয়। এই সব লোকখেলাই উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ। চড়কের সন্ন্যাসীরা তাঁদের পিঠের মেরুদণ্ডে লোহার বড়শি বিঁধিয়ে ফুটো না করে চড়ক গাছের অগ্রভাগে মাটির সঙ্গে সমান ভাবে রাখা একটি লম্বা কাঠের খুঁটি হাত দিয়ে ধরে রাখে। সন্ন্যাসীকে পিঠমোড়া করে তার সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয়। সন্ন্যাসী শূন্যে ঘোরে। এই সব সন্ন্যাসীদের ‘বারনামি’ বলে। চড়কের দিন ভক্ত ডাকিনী, যোগিনী, বুড়া-বুড়ি, হনুমানের মুখোশ পরে নাচ করে। শিব-পার্বতী সেজে নাচ দিনাজপুরের লোক সংস্কৃতির অঙ্গ। অনেকে গায়ে কালি মেখে তার মধ্যে সাদা সাদা ছাপ ফেলে ভূত-পেতনি সাজেন। গ্রাম বাংলার লোক-সংস্কৃতিতে গাজন ও সঙের গুরুত্ব আছে। এরাই নতুন বছরের বার্তা বহন করে আনে।
|
কোচবিহার থেকে বাইশ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে দিনহাটা মহকুমার খলিসা গোঁসানিমারি গ্রামে এখনও ঘুমিয়ে আছে কামতাপুর দুর্গ। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ঢিপি ও টুকরো ইটের কোলাজে সীমাবদ্ধ কামতানগর। এক সময় পশ্চিমে করতোয়া নদী থেকে পুবে ব্রহ্মপুত্র আর উত্তরে ভুটান থেকে দক্ষিণে বগুড়া জেলা পর্যন্ত ছিল এই রাজনগরের সীমানা। এখন দুর্গটি গোঁসানিমারিগড় বা ‘রাজপাট’ নাম নিয়েছে। এখানকার ইতিহাস নিয়ে একটি প্রচলিত উপকথা হল গোঁসানিদেবীর নির্দেশে বিশ্বকর্মা রাতারাতি কান্তেশ্বর রাজের সুরক্ষায় এই গড় গড়ে দেন। দেবীর কৃপায় কান্তেশ্বর রাজা হলেন। মূলত গোঁসানিদেবীর মাহাত্ম্য বর্ণনার জন্যই পুরুষ চরিত্র কান্তেশ্বরের জন্ম। তবে আধুনিক ইতিহাস বলে কামতারাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কামরূপ রাজা সন্ধ্যা রায়। এই রাজপাটের উত্তর-দক্ষিণ ও পশ্চিম ঘিরে দীর্ঘ মাটির প্রাকার এখনও চোখ টানে। বর্তমান প্রাচীর উচ্চতায় প্রায় ৪০ ফুট এবং চওড়ায় ৫৩ ফুট। দুর্গের দক্ষিণ-পূর্বে যে কয়েকটি প্রবেশ দ্বারের অস্তিত্ব পাওয়া যায় সেগুলির বিশেষ কিছু নাম রয়েছে। যেমন, শিলদুয়ার, সন্ন্যাসীদুয়ার, বাঘদুয়ার, জয়দুয়ার, নিমাইদুয়ার ও হেঁকোদুয়ার। মনে করা হয়, প্রস্তরনির্মিত হওয়ায় প্রবেশপথের নাম শিলদুয়ার, আবার প্রবেশপথের উপরে বাঘের মূর্তি খোদিত থাকায় নাম বাঘদুয়ার, যুদ্ধজয়ের পর রণজয়ীরা প্রত্যাবর্তন করতেন, জয়দুয়ার নামের প্রবেশ পথে। কোচবিহারে ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে নিমাই এসেছিলেন। তিনি যে পথে এই দুর্গে প্রবেশ করেছিলেন সেটি নিমাইদুয়ার নামে পরিচিত। কিন্তু গোঁসানিমঙ্গল কাব্যে হেঁকোদুয়ার ও নিমাইদুয়ারের উল্লেখ নেই। রয়েছে ধর্মদুয়ার ও অক্ষয়দুয়ার নামের দু’টো আলাদা প্রবেশ পথের কথা। শিলদুয়ার ছাড়া রাজপাটের অন্যান্য দুয়ারগুলি লোহা বা কাঠের তৈরি ছিল। প্রাকৃতিক দুর্যোগে অনেক কাল আগে সে সব সিঙ্গিমারি নদীতে ভেসে যায়। ১৮০৮-০৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সিস বুকানন প্রথম এ দুর্গ পরিদর্শন করলে ইতিহাসের ঘুম ভাঙে। তাঁর বিবরণ অনুযায়ী, এই পরিদর্শনের কিছু দিন আগেও এই গড়ের বুকে কয়েকটি বেলেপাথরের মূর্তি দেখা যেত। পরবর্তীতে সেগুলো কোচবিহার রাজবাড়িতে সরিয়ে আনা হয়। বুকাননের দেখা নিদর্শনের অধিকাংশই আজ অন্তর্হিত। বর্তমানে শুধুই এক ঢিবির দেখা মেলে। |
সম্প্রতি জলপাইগুড়ির ‘সুভাষ ভবন মঞ্চ’-এ অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ‘সৃষ্টি মাইম’-এর বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান। এই উপলক্ষে ফেসবুক-টুইটারের দুনিয়ায় অবলীলায় বিচরণ করা কিছু কলেজ পড়ুয়া মূকাভিনয়ের মাধ্যমে তুলে ধরল ছোট ছোট ভিন্ন স্বাদের বেশ কিছু গল্প। পরিবেশিত হল ‘দুষ্টু বালক ২’, ‘প্রজাপতির কথা’, ‘বেকার স্বপ্ন’, ‘চোর-পুলিশ ও মুক্তি’। দুষ্টু বালক ২ গল্পটিতে তারা কখনও দুষ্টু বালক হয়ে পাঁচিল টপকে ঢুকে ফল চুরি করল, আবার কখনও বা মালি সেজে বালকটিকে লাঠি নিয়ে তাড়া করল। এর পুরোটাই উপস্থাপিত করা হল মূকাভিনয়ের মাধ্যমে। এক কথায় এই প্রজন্মের আধুনিক ছেলেমেয়েরা পরিবেশন করল ভিন্ন স্বাদের অনুষ্ঠান। সঞ্চালনা করেন বাচিক শিল্পী আকাশ পালচৌধুরী।
|
শখের কারিগর। আসলে উনি ঘড়ি তৈরি করেন। তবে মোবাইলের সৌজন্যে ছোট ঘড়ির কারিগরদের তো এখন মাছি তাড়ানোর অবস্থা। ফালাকাটার নেতাজি রোডের ঘড়ির দোকানদার দীনবন্ধুর কাছেও অনেক অলস ফাঁকা সময়। অন্য কোন পথে উপার্জন করা যায় সে চিন্তায় তিনিও এক সময় দিশেহারা ছিলেন। হঠাৎ এক দিন চোখের সামনে পাতাবাহারের গাছ ছেঁটে নেওয়ার পর পড়ে থাকা ডালপালা দেখে মনে হয়েছিল, এ যেন রোগগ্রস্ত, জরাজীর্ণ মানুষের শরীর। পরিত্যক্ত ডালটিকে ঘড়ি সারাইয়ের ব্লেড, বাটালি, ছোট হাতুড়ি দিয়ে কেটেকুটে, ঘষেমেজে মানব দেহের রূপ দিলেন। চেপে বসল কাটুম-কুটুমের নেশা। নতুন আঙ্গিকে তৈরি করতে লাগলেন বন্ধ চা বাগানের অনাহার ক্লিষ্ট শ্রমিকের মুখ, বিলুপ্ত পশু-পাখি, ক্রিকেটার, গ্রামবাংলার ঢেঁকিতে কর্মরতা মেয়ে। কোনওটা শেকড় আবার কোনওটা গাছের ডাল দিয়ে তৈরি। এ সব দিয়েই যত্ন করে সাজিয়ে তুলছেন দোকান ঘরের মধ্যের সাত ফুট বাই পাঁচ ফুটের সাদা রঙের কাটুম-কুটুমের রঙিন গ্যালারি।
|