পুস্তক পরিচয় ২...
সিনেমাকে সঙ্গী করেই হেঁটেছেন তিনি
চলচ্চিত্রযাত্রা, তারেক মাসুদ। প্রথমা (ঢাকা), ২৭৫.০০
মেরিকায় গিয়ে সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা করবেন বলে বাড়ি থেকে টাকাও জোগাড় করে ফেলেছিলেন তারেক মাসুদ। বাইরে যাওয়ার সব বন্দোবস্ত সেরে একদিন জিগাতলা বাসস্ট্যান্ডে বাসের জন্যে দাঁড়িয়ে আছেন। কোনও কারণে বাসটা আসতে সে দিন অনেকটা দেরি করায় একটা উল্টো বুদ্ধি খেলে গেল তাঁর মাথায়... ‘সেখানে দাঁড়িয়েই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, বিদেশে যাব না, ওই টাকা দিয়েই সুলতানের ওপর ছবি বানানো শুরু করে দেব।’ লিখেছেন তারেক।
এস এম সুলতান বাংলাদেশের এক ক্ষণজন্মা চিত্রকর, তাঁকে নিয়ে ছবি করতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে ঘুরতে হত তাঁর মতো করেই, বলতেন ‘রাখুন না ক্যামেরা, যন্ত্রটন্ত্র থাকুক’, বা কখনও বলতেন ‘ছবি থেকে জীবন অনেক বড়’। এ রকম অসাধারণ এক মানুষের সঙ্গে ঘুরতে-ঘুরতে নানা লোক-উৎসবে যাচ্ছেন, বাংলাদেশকে নতুন করে আবিষ্কার করছেন, পুরো ব্যাপারটাই প্রায় যাত্রাপথের আনন্দগান হয়ে উঠছিল তারেকের কাছে, এর মধ্যে এতটাই প্রাপ্তি ছিল যে ছবি বানানোটা অনেকটা উপজাতের মতো ছিল। ‘এ রকম করে এক ধরনের বাউলাঙ্গের চলচ্চিত্র নির্মাণে আমরা জড়িয়ে গিয়েছিলাম।’ লিখেছেন তারেক।
তখন থেকেই তারেক তাঁর উপলব্ধিতে যে বিষয়টি নাড়া দেয়, সেটির উপর সময় নিয়ে শুদ্ধ ভাবে ছবি তৈরির চেষ্টা করেন। নানা ধরনের মানুষ শামিল হতে থাকেন তাঁর এই ফিল্মযাত্রায়। যেমন লিয়ার লেভিন ব্যক্তিগত উদ্যোগে পুরোপুরি তাঁর পেশাদার চলচ্চিত্র-ইউনিট নিয়ে শামিল হয়েছিলেন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে। মার্কিন নাগরিক ও বিজ্ঞাপন-নির্মাতা হওয়ায় তিনি চিহ্নিত হন সন্দেহভাজন হিসেবে, তাঁকে শাস্তিও পেতে হয়। অথচ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘মুক্তির গান’ ছবি করার সময় তারেক তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখেন, কী মমতায় তিনি মুক্তিযুদ্ধের ফুটেজগুলো সংরক্ষণ করে রেখেছেন। আমেরিকা ইংল্যান্ড কানাডা ফ্রান্স ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছিল। ‘সেগুলো দেখে মনে হয়েছে, লিয়ারের কাজের সামনে লাখো ঘণ্টার ফুটেজও কিছু না। তাঁর ফুটেজ ও তাঁর সহযোগিতায় মুক্তির গান-এর অস্থিমজ্জা দাঁড়িয়েছে।... যে প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, তাদের কাছে লিয়ার লেভিনের এ ফুটেজের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ হাজির হয়েছে।’ লিখেছেন তারেক।
তারেকের ‘মাটির ময়না’ শুধু কান ফিল্মোৎসবেই পুরস্কৃত হয়নি, সারা পৃথিবীর নানান ফিল্মোৎসবে আমন্ত্রিত ও প্রদর্শিত হয়েছিল। ততদিনে নিউইয়র্ক দ্বিতীয় নিবাস হয়ে উঠেছে তারেকের। সেখানকার মিউজিয়ম অব মডার্ন আর্ট ও লিঙ্কন সেন্টার-এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক উৎসবের শেষ দিনে দেখানো হয় ছবিটি। কিন্তু আমেরিকার ইরাক আক্রমণের ফলে কয়েক দিন আগেই নিউইয়র্কের যুদ্ধবিরোধী মানুষের প্রতিবাদ-বিক্ষোভে শামিল হয়েছিলেন তারেক। সেই মিছিলে পুলিশের লাঠি, ঘোড়া, কাঁদানে গ্যাসের মুখোমুখি হন তিনি।
এরপর যখন ‘মাটির ময়না’ শুরুর আগে বলতে বলা হল তাঁকে, নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা করলেন তিনি। বললেন ‘এই ছবিটির চিত্রনাট্যের প্রাথমিক ধারণাটি আমি ধারণ এবং বিশদ করতে পেরেছিলাম এই শহরের মিশ্র সংস্কৃতি ও মিশ্র ধর্মের জীবনপ্রবাহের অনুপ্রেরণায়। এ জন্য আমি আমার পাঁচ বছরের নিউইয়র্ক-জীবনের অভিজ্ঞতার কাছে ঋণী।... কিন্তু একই সঙ্গে এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক যে, এমন একটা সময় ছবিটি দেখাতে হচ্ছে, যখন অন্যায় যুদ্ধের কারণে ঠিক এই মুহূর্তে মারা যাচ্ছে হাজার হাজার নিরীহ মানুষ এবং যে যুদ্ধ পশ্চিম ও মুসলিম বিশ্বের মধ্যে আরও দূরত্ব ও দেয়াল তৈরি করছে।’
তারেকের লেখালেখি থেকে এটুকু আঁচ করা যায় যে, সিনেমাকে সঙ্গী করেই হাঁটেন তিনি, তবে সে-হাঁটা সব সময় হাওয়ার দিকে নয়, হাওয়ার বিরুদ্ধেও হাঁটেন অনেক সময়। তাঁর এই পথচলায় যেমন দেশজ পরিক্রমা আছে, আবার সে সীমা ছাপিয়ে আন্তর্জাতিকতাতেও পৌঁছনো আছে। যেন ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে দেখতে-দেখতেই হাঁটেন, আবার হাঁটতে-হাঁটতেই দেখেন। ‘অনেক দূর থেকে যখন দেখা হয়, তা পূর্বের বা পশ্চিমের যে দৃষ্টি দিয়েই দেখা হোক না কেন, এমনকি চাঁদকেও সমতল লাগে। যত কাছে যাওয়া যায়, খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলো ধরা পড়ে, পূর্বানুমিত নিশ্চিত ধারণার বিপরীতে বিষয়বস্তুর জটিলতাগুলো বেরিয়ে আসে।’ লিখেছেন তারেক।
গত পঁচিশ বছর ধরে এ ভাবেই লিখে গিয়েছেন তারেক, তাঁর ফিল্মযাত্রার সঙ্গে জড়ানো নানা অভিজ্ঞতা, আত্মস্মৃতি, সংকট, এবং অবশ্যই অপূরিত স্বপ্ন নিয়ে। সিনেমা নিয়ে পথচলাতেই তাঁর আনন্দ ছিল, আর পথ-দুর্ঘটনাতেই মৃত্যু হল তাঁর। ফলে তাঁর লেখাগুলো জড়ো করে বই প্রকাশ করা প্রায় প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল ক্যাথরিনের তারেকের সর্বক্ষণের সঙ্গী ও সহধর্মিণীর। চার খণ্ডে সমাপ্য তারেকের রচনাগুলির থেকে প্রথম বইটির কাজ শেষ করতে পেরে ভূমিকায় তিনি লিখেছেন ‘গর্ব এ কারণে যে গত কয়েক মাসের মানসিক যাতনার ভেতরেও আমরা একটা দল হিসেবে কাজ করতে পেরেছি এবং সফলভাবে বইটি প্রকাশ করতে পেরেছি।’
বইটির নাম চলচ্চিত্রযাত্রা— তারেকের মননের তুল্য নামই বটে!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.