ট্যাক্সি নৈরাজ্য
মর্জির স্ট্যান্ড
কাল ১১টা। বালি খাল। শিয়ালদহে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাওয়ার জন্য ট্যাক্সি ধরতে ওই মোড়ে এসে বেজায় বিপদে পড়লেন বছর পঁচিশের স্বপন কুমার। স্ট্যান্ডে ছ’-সাতটি ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে থাকলেও কেউই মিটারে শিয়ালদহ যেতে রাজি নয়। অগত্যা সঠিক ভাড়ার থেকে কয়েক গুণ বেশি টাকা দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছতে হল তাঁকে।
এই ঘটনা ব্যতিক্রম নয়। অভিযোগ উঠেছে, হাওড়া শহরের ‘লাইফ লাইন’ জিটি রোডের ধারে যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের ভোগান্তির কবলে পড়তে হয় যাত্রীদের। তাঁদের বক্তব্য, পুলিশ কমিশনারেট হওয়ার পরে হাওড়া স্টেশন চত্বরে ট্যাক্সির জুলুমবাজি কমাতে ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ। ফলে আগের থেকে হাওড়া স্টেশন চত্বরে ট্যাক্সির নৈরাজ্যের ঘটনাও অনেকাংশে কমেছে। কিন্তু সমস্যা বেড়েছে অন্যত্র। হাওড়া বাসস্ট্যান্ড চত্বর থেকে শুরু করে বালি খাল পর্যন্ত যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা ট্যাক্সি স্ট্যান্ড জুড়ে কার্যত নৈরাজ্য চলছে। যাত্রী ও বাসিন্দাদের অভিযোগ, এ সব স্ট্যান্ডে চালকের মর্জিই শেষ কথা।
হাওড়া স্টেশন পার করে বাসস্ট্যান্ড চত্বর থেকে শুরু করে মাঝে হাওড়া ময়দান, ডবসন রোড, পিলখানা, সালকিয়া, বেলুড়, বালি খাল পর্যন্ত জিটি রোডের ধারে ধারে প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকায় গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য অস্থায়ী ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। কোথাও দু’টি, কোথাও চারটি, কোথাও ১০টি, কোথাও আবার ২০টি ট্যাক্সি নিয়ে তৈরি হয়েছে স্ট্যান্ড। আবার প্রতিটি ট্যাক্সিরই যে নির্দিষ্ট স্ট্যান্ড রয়েছে তা-ও কিন্তু নয়। যেমন, সকালে যে ট্যাক্সিটি লিলুয়ায় দাঁড়িয়েছিল, দুপুরে সেটিই বেলুড় কিংবা বালিতে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। লিলুয়া বড় গেটের সামনে দাঁড়ানো এক ট্যাক্সিচালক মোহন্ত সিংহের কথায়: “যখন যেখানে জায়গা থাকে তখন সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ি।”
শহরের বিভিন্ন জায়গায় ট্যাক্সির এহেন অরাজকতা দেখা গেলেও পুলিশ কার্যত কোনও ব্যবস্থা নেয় না বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। তাঁদের কথায়, ট্যাক্সি প্রত্যাখ্যান সম্পর্কে এ শহরে নির্দিষ্ট ভাবে অভিযোগ জানানোর কোনও ব্যবস্থা নেই।
যদিও এই অভিযোগ অস্বীকার করে হাওড়া সিটি পুলিশের ডিসি (ট্রাফিক) অখিলেশ চর্তুবেদী বলেন, “হাওড়া পুর এলাকায় ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের জন্য কোনও নির্দিষ্ট জায়গা নেই। বিষয়টি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার জন্য পুরসভাকে জানানো হয়েছে। ট্যাক্সির জন্য সব সময়েই কেস দেওয়া হচ্ছে। ফেব্রুয়ারিতে ১৯৬৩টি ট্যাক্সির কেস হয়েছে।”
পাশাপাশি রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র বলেন, “যেখানে সেখানে স্ট্যান্ড বানালেই চলবে না। আমরা হাওড়া, শিয়ালদহ ও এয়ারপোর্টের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের উপর পুলিশকে নজরদারি করতে বলেছিলাম। ফলও মিলেছে। এ বার রাস্তার যেখানে সেখানে যে সব স্ট্যান্ড বানানো হচ্ছে সেগুলির ব্যাপারেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। হাওড়া পুলিশের সঙ্গে আমি এ বিষয়ে কথা বলছি।”
প্রায় সারা দিনই রাস্তার এক পাশ দখল করে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে থাকায় যানজটের পাশাপাশি দুর্ঘটনার আশঙ্কাও থেকে যায় বলে পথচারী থেকে বাসিন্দাদের অভিযোগ। আচমকা গজিয়ে ওঠা এই সব স্ট্যান্ডে পরিষেবার থেকে সমস্যাই বেশি হচ্ছে বলে দাবি ভুক্তভোগীদের। তাঁদের কথায়, ওই সব ট্যাক্সি কেউই কম দূরত্বের গন্তব্যে যেতে রাজি হয় না। গেলেও মিটার বেশি ওঠার জন্য ঘুরপথে যায় কিংবা থোক টাকা চায়। যেমন, জিটি রোড ধরে বালি থেকে হাওড়া স্টেশন মিটারে গেলে ভাড়া হয় ১০০ থেকে ১২০ টাকা। কিন্তু বালির অধিকাংশ ট্যাক্সিচালকই জিটি রোড দিয়ে যেতে চান না। বালি থেকে হাওড়া স্টেশন যেতে তাঁরা দুই ও ছয় নম্বর জাতীয় সড়ক হয়ে কোনা এক্সপ্রেসওয়ে ধরে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছন। তাতে প্রায় ৩০০ টাকা ভাড়া ওঠে। জিটি রোড ধরে তাঁরা যেতে চান না কেন? এক ট্যাক্সিচালকের কথায়: “জিটি রোডে অনেক যানজট থাকে। তাই কম সময়ে যেতে চাইলে হাইওয়েই সুবিধাজনক।”
বালি খাল স্ট্যান্ডে প্রায় ২০টি ট্যাক্সি রয়েছে। অভিযোগ, সেখান থেকে প্রায় কোনও সময়েই মিটারে ট্যাক্সি পাওয়া যায় না। মর্জিমতো গন্তব্য না হলে চালকেরা যেতে চান না। বালির বাসিন্দা রূপেশ মুখোপাধ্যায়ের অভিজ্ঞতা: “বাবাকে আর জি করে নিয়ে যাওয়ার জন্য ট্যাক্সি ধরতে গেলাম। কিন্তু বালি খাল থেকে মিটারে কেউ যেতে রাজি হল না। যেখানে মিটারে ১০০ টাকাতে হয়ে যায় সেখানে ওরা চাইল ২০০ টাকা।” একই ছবি বেলুড় মঠ স্ট্যান্ডেও।
আবার জিটি রোড থেকে ধর্মতলা রোড ধরে বেলুড় স্টেশনের দিকে যেতে গেলে এলাকার ভিতরে দেখা যাবে, ৩-৪টি ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে। স্থানীয় বাসিন্দা সৃঞ্জয় ঘোষের অভিযোগ, “এলাকার ভিতরে ট্যাক্সি থাকলেও চালকরা সব জায়গায় যেতে চান না। গেলেও মিটারের তোয়াক্কা না করে অনেক বেশি ভাড়া চান। তাই আমরা রাস্তা থেকে ফ্লাইং ট্যাক্সি ধরে নিয়ে আসি।” যাঁদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ, সেই ট্যাক্সিচালকদের বক্তব্য: কলকাতা বা হাওড়ার দিকে মিটারে গেলে ফিরতি পথে অধিকাংশ সময়েই ফাঁকা ফিরতে হয়। তার উপর হাওড়ার গাড়ি কলকাতার দিকে গিয়ে যাত্রী তুলতে গেলে রয়েছে পুলিশি হয়রানি।
হাওড়া শহরের এই ট্যাক্সি নৈরাজ্য নিয়ে সিটুর জেলা সভাপতি নিমাই সামন্ত বলেন, “হাওড়া জেলার অধিকাংশ ট্যাক্সি স্ট্যান্ডই এখন সিটু নিয়ন্ত্রিত। ট্যাক্সির জোরজুলুম যে নেই তা বলা যায় না। তবে সে বিষয়ে ও যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা স্ট্যান্ডের বিষয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ এলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।”

ছবি: রণজিৎ নন্দী




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.