ট্রেন চলাটাই যেন ‘যথেষ্ট’ উত্তর-পূর্বের পাহাড়ে
কালের ট্রেন আসে দুপুরে। দুপুরের ট্রেন রাতে। কিন্তু এই ‘লেট’ নিয়ে বিশেষ তাপ-উত্তাপ নেই উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ‘পাহাড়লাইনের’ যাত্রীদের। অধিকাংশ দিনই কখনও মালগাড়ি উল্টে, কখনও ইঞ্জিন বিগড়ে, কখনও বৃষ্টিতে ধস নেমে, আবার কখনও জঙ্গি হামলায় বন্ধ হয়ে যায় ট্রেন। মাঝেমধ্যে দীর্ঘ কিছুদিনের জন্যও। তাই এ লাইনের যাত্রীদের মনোভাব হল, ট্রেন যে চলছে এটাই যথেষ্ট। তাই রেললাইন অবরোধ কিংবা বিক্ষোভ দেখানোর চল এ দিকে নেই। পাহাড়লাইন বলতে অসমের লামডিং থেকে শিলচর ও আগরতলা রেলপথ।
বাইরে থেকে কেউ এসে যদি প্রথমবার এ লাইনের ট্রেনে চাপেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে তিনি মুগ্ধ হবেনই। কোথাও পাহাড়ের বুক চিরে, কোথাও সবুজ ঘন বনের মধ্য দিয়ে, কোথাও পরের পর টানেল বা সেতু পেরিয়ে ট্রেন কখনও নামছে, কখনও উঠছে। স্টেশনগুলোও যেন খেলনার। এই মুগ্ধতার আবেশ কাটতে অবশ্য নতুন যাত্রীর দেরি হবে না যখন এ লাইনের অভিজ্ঞ কোনও যাত্রী তাঁকে জানাবেন, আঁকাবাঁকা এই রেলপথের পদে পদে জঙ্গি হামলার আশঙ্কা। জঙ্গিদের গুলিতে ট্রেনের চালক ও যাত্রীর মৃত্যু, বিস্ফোরণে ট্রেন বেলাইন হওয়া— এ সবই নতুন কিছু নয়। আছে জীর্ণ সেতু ও রেললাইন ভেঙে ট্রেন খাদে গড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও।
পাহাড় জঙ্গল পেরিয়ে এই ট্রেনের যাত্রা মাঝে মধ্যেই দুঃস্বপ্ন হয়ে ওঠে। শান্তনু ঘোষের তোলা ছবি।
উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলপথে উজানি অসমের লামডিং থেকে শিলচর ২১৫ কিলোমিটার, আর আগরতলা ৪১২ কিলোমিটার। পাহাড়ি পথ বেয়ে এ দূরত্ব পাড়ি দেয় মিটার গেজ ট্রেন। লামডিং স্টেশন ছেড়ে পাহাড়ি পথে বাঁশগাছের জঙ্গল ও চিরসবুজ বন ছুঁয়ে ১০ কিলোমিটার গেলেই মান্দারদিশা স্টেশন থেকে শুরু হচ্ছে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার বর্গ কিলোমিটারের ‘উত্তর কাছাড় পাহাড়’ (এনসি হিলস্) এলাকা (এখন ডিমা হাসাও জেলা)। যার ব্যাপ্তি শিলচর ও আগরতলা যাওয়ার আগে ১৫৬ কিমি দূরত্বের দামছাড়া স্টেশন পর্যন্ত।
লামডিং স্টেশন ছাড়ার পরে মন্দারদিশা স্টেশন থেকেই ডিমা হাসাও জেলার অন্তর্গত ২৪ টি ছোট্ট পাহাড়ি স্টেশনে খেয়াল রাখলে যাত্রী-হকার-মালপত্রের ভিড়ের মধ্যেই চোখে পড়বে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরিহিত স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র হাতে রেলরক্ষী জওয়ানদের। প্রায় সব স্টেশনেই বালির বস্তার বাঙ্কারের পিছনে আগ্নেয়াস্ত্রের ট্রিগারে আঙুল রেখে তাঁরা নজর রাখেন প্ল্যাটফর্মের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। কিন্তু এই নজরদারি সত্ত্বেও বনজঙ্গল-পাহাড়ের মধ্য দিয়ে যাওয়া রেলপথে জঙ্গিদের নাশকতা সব সময় রোখা সম্ভব হয় না। এ ছাড়া যাত্রী কামরায় মাঝেমধ্যেই ঘটে রেলডাকাতিও। ভাঙাচোরা কামরা, টিমটিমে আলো, ট্রেনের শ্লথ গতি, চলন্ত ট্রেনে রক্ষীর স্বল্পতাএ সবই নিত্যদিনের আতঙ্কের কারণ।
লামডিং স্টেশন থেকে প্রতিদিন কাছাড়, বরাক ভ্যালি, হিলকুইন ও আগরতলা এক্সপ্রেস— এই চারটি ট্রেন যাতায়াত করে শিলচর, আগরতলা ও লোয়ার হাফলং এর মধ্যে। যাত্রীদের অভিযোগ, এ লাইনে চলা যাত্রী ট্রেন এবং মালগাড়ি— সবেরই অবস্থা লড়ঝড়ে। ইঞ্জিনগুলিরও একই হাল। যখনতখন বিগড়ে যায়। ট্রেনের সর্বোচ্চ গতি ঘন্টায় ৪০ কিলোমিটারের বেশি নয়। তবে লাইন দুর্বল বলে অধিকাংশ সময়েই চলে এর অর্ধেক গতিতে। মিটার গেজ রেললাইন, রেলসেতু, কালর্ভাটএ সবের অবস্থাও ভাল নয়। কোনও মতে জোড়াতাপ্পি দিয়েই চলছে।
ব্যবসার কাজে প্রায়ই মাহুর থেকে লামডিং আসতে হয় সুমন দত্তকে। তাঁর কথায় “ইঞ্জিন গরম হয়ে বা অন্য কারণে একবার বিগড়ে গেলে আর রক্ষা নেই। অনেক সময় পুরো দিনের জন্যই বন্ধ হয়ে যায় ট্রেন চলাচল। পাহাড়-জঙ্গলের মাঝে বসে থাকা ছাড়া কোনও উপায় থাকে না। রাত হলে অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে ওঠে। কামরায় টিমটিমে আলো। শৌচাগারে জল থাকে না। প্ল্যাটফর্মগুলির অবস্থাও তথৈবচ। নিরাপত্তা বলতে কিছুই নেই যাত্রীদের।”
অনুরূপ কথাই শোনা গেল এনএফ রেলওয়ের লামডিং ডিভিশনের কর্মচারী সংগঠনের সম্পাদক মানিক দে-র মুখেও। তিনি বলেন, “ট্রেন ও রেল সেতুগুলির অধিকাংশেরই জীর্ণ দশা। জোড়াতাপ্পি দিয়েই চলছে। ফলে বিপত্তিও ঘটে। প্রায়ই ট্রেন লেট হয়। কর্মীর সংখ্যাও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।”
স্টেশনগুলিও যেন জরাগ্রস্ত। বাঁধানো প্ল্যাটফর্ম নেই বললেই চলে। তা-ও এত নীচু যে রাতে নামতে গিয়ে আছাড় খাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। হাতে গোনা কয়েকটি স্টেশনে রয়েছে যাত্রী শেড, বসার জায়গা ও পর্যাপ্ত আলো। রাতের প্ল্যাটফর্মগুলির চেহারা আরও ভয়ঙ্কর। চুরি-ছিনতাইয়ের পর্যাপ্ত সুযোগ।
সবুজের বুক চিরে তবু এই ট্রেন চলে যেন স্বপ্নের মতোই।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.