|
|
|
|
কলকাতার হয়েই সওয়াল অক্সফোর্ডের |
গৌতম চক্রবর্তী |
ইস, এই শহরে কোনও জেফ্রি আর্চার নেই! তিনি অক্লেশে বলে দিতে পারতেন, সমানদের মধ্যেও কে এগিয়ে থাকে। হয়ে ওঠে ‘ফার্স্ট অ্যামং ইকোয়্যালস’!
সওয়া তিনশো বছরের কলকাতা আর খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দী-প্রাচীন লন্ডন কি এক? আদতে কলকাতা কি সত্যিই লন্ডন হতে পারবে? কলকাতা-লন্ডন স্লোগানের প্রবক্তা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন ইন্ডোরে সশরীরে হাজির ছিলেন না। কিন্তু বরখা দত্তর কথায় চলে এল তাঁর নামহীন উপস্থিতি। ‘কলকাতা যদি লন্ডন থেকে চলে, ভালই। শুধু একটা সমস্যা হবে। ব্রিটিশরা এ দেশে রেল এনেছিলেন ঠিকই। কিন্তু এখন রেলমন্ত্রী কে হবেন, তা নিয়ে সমস্যা হতে পারে,’ বলছিলেন বরখা। তিনি, স্বপন দাশগুপ্ত, কপিল দেব, রাজীবপ্রতাপ রুডি এবং ঋতুপর্ণ ঘোষ এ দিন প্রস্তাবের সমর্থনে। ‘সভার মতে, কলকাতাকে লন্ডন থেকে আরও ভাল ভাবে শাসন করা যায়’ বিড়লা সান লাইফ ও ব্যালান্টাইনের পৃষ্ঠপোষণায় এ বারের ‘টেলিগ্রাফ বিতর্ক’-র প্রস্তাব ছিল এটাই।
আর প্রস্তাবের বিপক্ষে, কলকাতার সমর্থনে দাঁড়াল লন্ডনের অদূরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের বিতর্ক-সংস্থা ‘অক্সফোর্ড ইউনিয়ন’। দুনিয়ার প্রাচীনতম, ১৮৯ বছরের পুরনো বিতর্ক-সংস্থার এই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের বাইরে পা রাখা। প্রস্তাবের বিপক্ষে বলতে উঠে বারংবার জানালেন তাঁরা, হাল আমলের ব্রিটিশ জমানা মোটেই কলকাতা বা ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রতি সুবিচার করতে পারত না। ভারতীয় সমস্যা বুঝতেই পারত না তারা। ব্রিটিশ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বহুদলীয়, বহুবর্ণ ভারতীয় গণতন্ত্র চালাতে হিমসিম খেত। ইন্ডোর স্টেডিয়ামের সমবেত জনতা তাঁদের কথাই মেনে নিল। বিপুল ভোটে পরাজিত বিতর্ক-প্রস্তাব। কলকাতার সম্মান বাঁচিয়ে দিল অক্সফোর্ড। |
 |
টেলিগ্রাফ বিতর্ক অনুষ্ঠানে (বাঁ দিক থেকে) ঋতুপর্ণ ঘোষ, রাজীবপ্রতাপ রুডি,
স্বপন দাশগুপ্ত,
বরখা দত্ত, জো ফ্যানন, ম্যাথু হ্যান্ডলি, হাসান ডিন্ডজার,
কপিল দেব,
ক্যাথরিন ব্রুকস এবং র্যাচেল ক্রুক। ছবি: দেবাশিস রায় |
এর পরেও বলা যাবে না ‘ফার্স্ট অ্যামং ইকোয়্যালস’-এর কথা? ওই নামেই তো জেফ্রি আর্চারের জনপ্রিয় উপন্যাস। সেই উপন্যাসের অন্যতম নায়ক সাইমন কেরস্লাক। অক্সফোর্ড ইউনিয়নে প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে সে বক্তা হিসাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। বিতর্কের বিষয়: লর্ড নয়, এই সভা সাধারণ মানুষ হয়ে উঠতে পছন্দ করে। চার্চিলের বক্তৃতা চলছে, সভাকক্ষে দর্শকাসনে বসে চার্লস সেমুর। কেরস্লাকের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সম্পর্ক তার। দর্শকাসনে বসেই সেমুর ঠিক করল, ভবিষ্যতে সে রাজনীতিতে নামবে। কে না জানে, ছাত্রাবস্থায় জেফ্রি আর্চার অক্সফোর্ড ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন!
সাহিত্যের চরিত্র নয়, অক্সফোর্ড ইউনিয়নের রক্তমাংসের চরিত্ররা ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। প্রস্তাবের সমর্থনে প্রথমে বলতে উঠে ঋতুপর্ণ ঘোষ স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, লন্ডন শাসনভার নিলে অন্তত কলকাতার রাস্তাগুলো পুরনো নামে ফিরে আসবে। জঘন্য মূর্তিগুলোকে আর চোখের সামনে দেখতে হবে না। লর্ড কার্জন বা লর্ড ডালহৌসির শিল্পসম্মত নান্দনিক মূর্তিগুলি আবার ফিরে আসবে। অক্সফোর্ডের ওয়াডহ্যাম কলেজের ছাত্রী ক্যাথরিন ব্রুকস তাঁর বিপক্ষে দাঁড়িয়ে জানালেন, লন্ডনের থেকে কলকাতা মানুষের ভালবাসায় অনেক বেশি উষ্ণ। এ দেশের দারিদ্রের জন্য তো দায়ী ব্রিটিশ শাসন। তারা সমাজের এক অংশের উন্নয়ন ঘটিয়েছিল, বাকিরা বঞ্চিত ছিল। নান্দনিকতার থেকেও বড় সমস্যা সেখানেই। ‘পূর্ব আকাশে এক নতুন তারার জন্ম হয়েছে’ বলে ১৪ অগস্ট মধ্যরাত্রে জওহরলাল নেহরুর বিখ্যাত বক্তৃতা থেকেও উদ্ধৃতি দিলেন তিনি। সঞ্চালক রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায় রসিকতা সামলাতে পারলেন না, ‘ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী কেমব্রিজের ছাত্র ছিলেন। অক্সফোর্ড ইউনিয়ন যে তাঁকে উদ্ধৃত করবে, ভাবা যায়নি।’
প্রস্তাবের সমর্থনে এ বার ব্যঙ্গের কষাঘাত নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন বিজেপি-র রাজীবপ্রতাপ রুডি। ‘এ দেশের সুপ্রিম কোর্টে সাড়ে ৩৩ হাজারের বেশি মামলা ঝুলছে, ৪৫ শতাংশ শিশু অপুষ্টিতে। কিন্তু আমরা ওয়েস্টমিনস্টার ধাঁচে সংসদীয় গণতন্ত্র পেয়েছি!! স্বাধীনতার পর ৯৪ বার সংবিধান সংশোধিত হয়েছে। এ দেশে এক রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী জেলে যাওয়ার আগে তাঁর স্ত্রীকে গদিতে বসিয়ে যান। কিন্তু আমরা ওয়েস্টমিনস্টার ধাঁচে সংসদীয় গণতন্ত্র পেয়েছি!!’ বলতে বলতে সপাটে ছক্কা মারলেন তিনি, ‘লন্ডন কলকাতা শাসন করে কি না জানি না। কিন্তু কলকাতা দিল্লি শাসন করে।’ বিপক্ষে বলতে উঠলেন ১৩৭৯ সালে তৈরি, অক্সফোর্ডের অন্যতম প্রাচীন ‘নিউ কলেজ’ থেকে আসা হাসান ডিন্ডজার। ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব এই কলেজেরই ছাত্র ছিলেন। ‘লন্ডনের রাজনীতির গুণমান কলকাতার চেয়ে তেমন কিছু ভাল নয়। ভারত যে ভাবে আর্থিক মন্দা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, দেখার মতো’, বলছিলেন তিনি। |
...আমি তোমাদেরই লোক
 |
ভক্তের ভগবান: ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ বিতর্কের মঞ্চে সই-শিকারিদের আবদার
মেটাচ্ছেন কপিল দেব।
শনিবার, নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। ছবি: দেবাশিস রায় |
হাসান রাজনীতির গুণমানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যকে সমান করে দিতে পারেন, কিন্তু কপিল দেব? ব্রিটিশের দেওয়া ক্রিকেট সারা ভারতকে আজও এক সুতোয় বেঁধে রেখেছে, বললেন দেশের প্রথম বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক। তাঁর বক্তব্য, এ দেশে গণতন্ত্র নামেই। প্রতিষ্ঠানগুলিতে একনায়কতন্ত্র। কখনও জগমোহন ডালমিয়া, কখনও শরদ পওয়ার! ক্রিকেট বোর্ডকে এ ভাবেই এক হাত নিয়ে কপিল জানালেন, তার চেয়ে ব্রিটিশ গণতন্ত্র ভাল। বিপক্ষ থেকে সোমারভিল কলেজের ছাত্রী জো ফ্যানন তাঁকে জানালেন, ব্রিটেনে এখন হাতে গোনা লোক ক্রিকেট দেখে। তিনি নিজেই খেলাটার সঙ্গে তেমন সড়গড় নন।
বাঙালির সঙ্গে অক্সফোর্ড ইউনিয়নের সম্পর্ক কি আজকের? ১৮৩০ সালে এই বিতর্ক-সংস্থার প্রেসিডেন্ট ছিলেন ক্রাইস্টচার্চ কলেজের ছাত্র উইলিয়াম গ্ল্যাডস্টোন। তার ৫০ বছর পরে, ১৮৮০ সালে ভোটে জিতে তিনিই ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তাঁর উদারনীতি তখনকার অক্সফোর্ডের কিছু ছাত্রের পছন্দ নয়। ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট তখন বেলিয়ল কলেজের এক ছাত্র। তাঁর নেতৃত্বে বিতর্ক-প্রস্তাব নেওয়া হল, ‘সাধারণ নির্বাচনের ফলের জন্য ইউনিয়ন দুঃখিত।’ প্রস্তাব তুমুল ভাবে জিতল। কয়েক বছর পর অক্সফোর্ড ইউনিয়নের এই প্রেসিডেন্ট ভারতের গভর্নর জেনারেল হিসাবে কলকাতায় পা রাখবেন। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল নির্মাণ থেকে শুরু করে রাজভবনে প্রথম লিফ্ট বসবে তাঁরই উদ্যোগে। ভদ্রলোকের নাম লর্ড কার্জন।
প্রস্তাবের পক্ষে এনডিটিভি-র বরখা দত্ত বলছিলেন অন্য কথা। লন্ডন থেকে কলকাতাকে শাসন করা গেলে আপত্তি কী? লন্ডনের বেশির ভাগ রেস্তোরাঁয় এখন ভারতীয় কারি, বালতি চিকেন-এর রমরমা। এনিড ব্লাইটন, আগাথা ক্রিস্টির কথাও ভেসে এল তাঁর বক্তব্যে। স্বপন দাশগুপ্তও প্রস্তাবের সমর্থনে মজা করে বলছিলেন, ‘কলকাতার সঙ্গে লন্ডনের অনেক মিল। বাঙালি কুকুরের নাম সাধারণত টমি রাখে। আর তার সঙ্গে ইংরেজিতে
কথা বলে। দুটো শহরের আদানপ্রদান হতেই পারে, তার মানে ‘মা-মাটি-মানুষ’কে ‘মা-মাটি-ম্যাঞ্চেস্টার’-এ পরিণত করা নয়।’
অক্সফোর্ড ইউনিয়ন অবশ্য এ সব রসিকতার উত্তরে সিরিয়াস-ই রয়ে গেল। র্যাচেল ক্রুক কখনও রেগে গিয়ে জানালেন, ’৪৭ সালের আগে ভারতীয়রা সেনাবাহিনীতে ব্রিগেডিয়ার হতে পারত না। ম্যাথু হ্যান্ডলি বললেন ভারতের অগ্রগতির কথা। তাঁদের পক্ষেই হাত তুলল জনতা। জিতে গেল কলকাতা।
জেতার কথাই ছিল। কলকাতা জানে, আমাদের জীবনের ভাল জিনিস সবই ব্রিটিশদের হাতে তৈরি। তাদের হাতেই সেগুলি ধারালো হয়েছে। সিভিস ব্রিটানিকাস সাম! |
|
|
 |
|
|